E-Paper

একটি ‘হাইফেন’-এর জন্য

২৫ বছর পরে পহেলগামে এমন সময়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা হল, যখন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৫ ০৬:৪০

মাঝে-মাঝে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বড় নিষ্ঠুর হয়। পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলা যেমন। পঁচিশ বছর আগে, ২০০০ সালের মার্চে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন তাঁর কন্যাকে নিয়ে ভারত সফরে এসেছিলেন। জয়পুর ও আগরা ছিল তাঁর সফরসূচিতে। কেন্দ্রে তখন বাজপেয়ী-সরকার। সফরটি ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ তার আগে পর্যন্ত আমেরিকার যে কোনও রাষ্ট্রনেতা ভারত সফরে এলেই একই সঙ্গে পাকিস্তানও ঘুরে যেতেন। ভারত ও পাকিস্তানের নাম এই ভাবে হাইফেন দিয়ে জুড়ে এক সঙ্গে উচ্চারণে নয়াদিল্লির প্রবল আপত্তি ছিল। বহু যুগ পরে সে বার প্রথম কোনও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে শুধু ভারত সফরে এসেছিলেন।

২১ মার্চ ক্লিন্টনের ভারত সফর শুরু হয়েছিল। ঠিক তার আগের দিন পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা কাশ্মীরের অনন্তনাগে হামলা চালায়। ৩৬ জন নিরীহ শিখ গ্রামবাসী নিহত হন। স্বাভাবিক ভাবেই ক্লিন্টনের সঙ্গে বাজপেয়ীর আলোচনায় প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে পাক-মদতপুষ্ট কাশ্মীরের সন্ত্রাস। আমেরিকার কাছে ফের ভারত-পাকিস্তানের নাম এক বন্ধনীতে চলে আসে।

২৫ বছর পরে পহেলগামে এমন সময়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা হল, যখন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। হামলার আগের দিনই ভান্স সপরিবারে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়েছিলেন। ভারত এবং নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসাও করেছিলেন।

ঠিক এই সময়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার পিছনে তিনটি উদ্দেশ্য স্পষ্ট। এক, মোদী সরকার ৩৭০ রদ করে, কাশ্মীরে নির্বাচন করিয়ে, শান্তি ফেরার বার্তা দিয়ে যখন কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে বলে প্রমাণ করতে চাইছে, ঠিক সেই সময়ই আমেরিকার শীর্ষনেতার সফরের সময় হামলা করা হল। দুই, ভারতকে আন্তর্জাতিক স্তরে অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। তিন, সন্ত্রাসবাদী হামলা করে ভারতকে পাল্টা প্রত্যাঘাত করার উস্কানিও দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রত্যাঘাত যদি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের রূপ নেয়, তা হলে কাশ্মীর ফের আন্তর্জাতিক আলোচ্য হয়ে উঠবে। ভারত, পাকিস্তানের নাম ফের একটি হাইফেনে জুড়ে এক সঙ্গে উচ্চারিত হবে। পাকিস্তানের সরকার থেকে সেনা নতুন করে নিজের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবে।

কূটনীতিতে একটা ‘হাইফেন’ও ফেলনা নয়। ভারত ও পাকিস্তানের নাম আলাদা ভাবে উচ্চারিত হবে, না কি একটি হাইফেন দিয়ে জুড়ে থাকবে, নয়াদিল্লির কূটনীতিকরা বহু বছর ধরেই এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলা নরেন্দ্র মোদী সরকারকে আরও এক বার সেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

কী সেই চ্যালেঞ্জ? এক দিকে, পহেলগামে ২৬ জন নিরীহ মানুষের উপরে হামলার জবাবে প্রত্যাঘাত করতে হবে। না হলে এখন সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় মোদী সরকারের পাশে দাঁড়ানো বিরোধীরাই অদূর ভবিষ্যতে ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। অন্য দিকে, প্রত্যাঘাত করতে গিয়ে কোনও ভাবেই সংঘাত এতখানি বাড়ানো চলবে না, যাতে ভারত-পাকিস্তান বিবাদ আন্তর্জাতিক মহলের আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে; ভারত-পাকিস্তানের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

পরিস্থিতি অনেকটা ইজ়রায়েলের মতো। ২০২৩-এর অক্টোবরে হামাসের সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে ইজ়রায়েল গাজ়ায় আক্রমণ করেছিল। সে সংঘাত এখনও চলছে। গাজ়ায় রক্তক্ষয় হয়েছে। কিন্তু তার ফলে ইজ়রায়েল ও প্যালেস্টাইন একই হাইফেনে জুড়ে গিয়েছে। গাজ়ার বিবাদ আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বিশ্বের সামনে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু শত চেষ্টা করেও ইজ়রায়েলকে প্যালেস্টাইনের থেকে আলাদা করতে পারেননি।

গেরুয়া শিবিরের একটা বড় অংশ মনে করছে, পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখল করাই পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদে মদত শেষ করার একমাত্র উপায়। একাত্তরে ইন্দিরা গান্ধী যেমন পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ করেছিলেন, ঠিক তেমন এ বার নরেন্দ্র মোদীর উচিত পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়া। যুদ্ধের জিগির তোলা এই উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ভুলে যান পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে চিনের উপস্থিতির কথা। সেখানে ভারতীয় সেনার হামলা চালানোর অর্থ কার্যত একই সঙ্গে পাকিস্তান ও চিন সীমান্তে যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে ফেলা।

শুধু পাকিস্তানের সঙ্গেই যদি ভারতের পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, দেশের অর্থনীতিতে তার কতখানি প্রভাব পড়বে, সে কথাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। এমনিতেই ভারতের অর্থনীতি খুব ভাল অবস্থায় নেই। আর্থিক বৃদ্ধির হার এখনও বেশ কম। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এক দিন স্বস্তির খবর এলে পরের দিনই দুশ্চিন্তার বার্তা মেলে। পুরোদমে যুদ্ধের ধাক্কা দেশের মানুষের রুটি-রুজিতে কতখানি ধাক্কা দেবে, সে কথাও মাথায় রাখা দরকার। স্বস্তির কথা হল, গেরুয়া শিবিরের প্রধান চরিত্র, আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত প্রত্যাঘাতের প্রয়োজনের কথা বললেও চিন্তাভাবনা করে পরিমিত প্রত্যাঘাতের পক্ষে সওয়াল করেছেন।

পহেলগামের জবাবে প্রত্যাঘাতের আগে, কেন পহেলগাম-হামলা ঘটল তারও ময়না তদন্ত প্রয়োজন। এতে কোনও ভুল নেই যে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করে, রাজ্য ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির পর থেকে কাশ্মীরের ঘরোয়া জঙ্গি আন্দোলন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। ২০২৪-এ কাশ্মীরে প্রায় ২ কোটি ৩৬ লক্ষ পর্যটক ভিড় জমিয়েছেন। মানুষের আয় বেড়েছে। কাশ্মীরের অর্থনীতিতে আলো ফুটেছে। প্রায় দশ বছর পরে কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরে ‘অল ইজ় ওয়েল’ বলে সরকারি প্রচার কোনও না কোনও ভাবে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যেও আত্মতুষ্টি তৈরি করেছে। অতীতে যে সব এলাকা পর্যটকদের জন্য বন্ধ থাকত, হালফিল তা খুলে দেওয়া হয়েছিল। অথচ সরকারের কাছে তথ্য ছিল যে, ১২০ জনের বেশি লস্কর-ই-তইবা সন্ত্রাসবাদী কাশ্মীর উপত্যকায় সক্রিয়। পহেলগামের হামলার পরে এখন আবার কাশ্মীরের বহু এলাকা পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যা এত দিন ধরে ‘কাশ্মীরের পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক’ বলে সরকারি প্রচারের উল্টো কথা বলে।

জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের পরে ওমর আবদুল্লার নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জম্মু-কাশ্মীর এখনও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু-কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের তকমা ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। তাই কাশ্মীরের নিরাপত্তার দায়িত্বে মোতায়েন ত্রিস্তরীয় বাহিনী— সেনা, আধাসেনা ও রাজ্যের পুলিশ, সবই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। মোদী সরকারের পক্ষে কোনও ভাবেই এই সন্ত্রাসবাদী হামলার দায় ওমর আবদুল্লা সরকারের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই নরেন্দ্র মোদীকে বার বার ‘কঠোর প্রত্যাঘাত’-এর কথা বলতে হচ্ছে।

অতীতে ২০১৬-য় উরি-হামলার পরে সেনাবাহিনী পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল। ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সেই কৃতিত্বের পুরো মুনাফা বিজেপি রাজনৈতিক ভাবে ঘরে তুলেছিল। একই ভাবে ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে হামলার জবাবে বালাকোটে বায়ুসেনার হামলার পুরো সুবিধা বিজেপি লোকসভা ভোটে তুলেছিল। এখন বিজেপির সামনে বছরের শেষে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন ও আগামী বছরের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরল, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে ভোট। পহেলগামের জবাবে ঠিক সময়ে, ঠিক নিশানায় প্রত্যাঘাত করতে পারলে বিজেপি স্বাভাবিক ভাবেই নির্বাচনগুলিতে তার লাভ পাবে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির শক্তিক্ষয়ের জেরে আরএসএস যে ভাবে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানকে যথার্থ প্রত্যাঘাত নরেন্দ্র মোদীর হাত আরও শক্ত করবে। কিন্তু এই প্রত্যাঘাত পরিমিত না হলে তা যে দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতির পক্ষে বিরাট ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে, আশা করা যায়, বিজেপি ও আরএসএস-এর শীর্ষনেতৃত্ব সে কথাও মাথায় রাখবেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Jammu Kashmir Massacre Central Government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy