ছোট ভাই পড়াশোনায় ভাল। কিন্তু পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে সে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মিটিং-মিছিল-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছে। দলে রয়েছে একটি মেয়েও। এক দিন অনুষ্ঠান ভাঙতে বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় মেয়েটি তার সঙ্গেই চলে আসে। ছোট ভাই খুব ভাল করেই জানে, রাগী বড়দার এ সব একেবারে না-পসন্দ। তাই দাদাকে লুকিয়েই সে মেয়েটিকে রাতে নিজের ঘরে আশ্রয় দেয়। দাদা পরে জানতে পেরে তাকে ‘রাস্তার নোংরা মেয়ে’ বলে ধরে নেন। মেয়ে কিন্তু দমে যায় না তাতে। বরং তাকে বলতে শোনা যায়, “আমরা রিফিউজি মেয়ে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আমাদের মান-লজ্জা সব ভেঙে গিয়েছে। সারা ছোটবেলা রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে কেটে গিয়েছে... এত সহজে আমাদের কষ্ট হয় না।”
১৯৬১ সালের দুই ভাই ছবির দৃশ্য (পরিচালনা: সুধীর মুখোপাধ্যায়)। মন্দ্র স্বরে কথাগুলো ছুড়ে দিচ্ছেন সুলতা চৌধুরী। পরে বড়দা উত্তমকুমার যখন মেয়েটিকে আরও ভাল করে জানছেন, তার সাংসারিক দায়দায়িত্ব, তার রোজগারের তাগিদ, তার হাড়ভাঙা খাটুনির কথা জানছেন, আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করছেন, “এত কিছুর মধ্যে দেশোদ্ধারের কাজ করা হয় কখন?” তাঁকে অবাক করে দিয়ে সুলতা বলেন, “ওই ফাঁকে ফাঁকে। ওই সময়টুকুই তো বেঁচে থাকি দাদা!”
১৯৬০। মেঘে ঢাকা তারা ছবিতে সংসারের চাপে রোজগারের সবটুকু দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়া নীতার কাহিনি ছিল শুধুই নিষ্পেষণের। দুই ভাই-এর সুলতা কিন্তু প্রায় একই অবস্থানে থেকেও, সংসারের বাইরে খুঁজে নিচ্ছেন অন্য জীবনের স্বাদ। নিজেকে জুড়ে নিচ্ছেন এক বৃহত্তর লড়াইয়ের সঙ্গে। ‘দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম’-এর হাহাকার থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ‘ওই সময়টুকুই তো বেঁচে থাকি দাদা’ বলে ওঠার জায়গায় আসতে পারছেন!
বাংলা ছবিতে কর্মরতা মেয়েরা কেমন ভাবে প্রতিভাত হয়েছেন, সেই সংক্রান্ত আলোচনা অতীতেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু আফসোসের কথা হল, বেশির ভাগ আলোচনা আজও মূলত নিবদ্ধ থেকে যায় তিনটি চরিত্রকে ঘিরে— নীতা (মেঘে ঢাকা তারা, ১৯৬০), আরতি (মহানগর, ১৯৬৩) আর চিনু (একদিন প্রতিদিন, ১৯৮০)। বাংলা ছবিতে চাকরিরত মেয়েদের তিন আইকনিক প্রতিনিধি নিশ্চয় তাঁরাই। একে অপরের পরিপূরকও। নীতার কাহিনি, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মূলত সংসারের জাঁতাকলে পিষে যাওয়ার। আরতির আখ্যান উত্তরণের, ক্ষমতায়নের। আর ক্ষমতায়নের অসম্পূর্ণতার প্রতিমা যেন চিনু। কিন্তু তাই বলে যাবতীয় চর্চা যদি এই তিন জনকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তা হলে মনে হতে পারে, এর বাইরে এ-পারের বাংলা ছবিতে চাকরি-করা মেয়েরা বুঝি অনুপস্থিত। এমনকি এ ধারণাও তৈরি হতে পারে যে, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের মতো জ্যোতিষ্করা ছাড়া মেয়েদের বাইরে বেরোনোর ক্রমবর্ধমান ‘ট্রেন্ড’টাকে আর কেউ ধরার চেষ্টাই করেননি।
কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাংলা জনপ্রিয় মূলধারার ছবিও কি সময়ের এই বাঁক বদলকে নিজের মতো করে নথিভুক্ত করেনি? সপ্তপদী (১৯৬১) থেকে দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯), বিপাশা (১৯৬২) থেকে সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), হসপিটাল (১৯৬০) থেকে হারানো সুর (১৯৫৭)— সুচিত্রা সেন কি নন কর্মরত নারী? সুপ্রিয়া দেবীর চিত্রপঞ্জিতে নীতা চরিত্রের পাশাপাশি নেই কি স্বয়ম্বরা (১৯৬১), সূর্যশিখা-র (১৯৬৩) মতো ছবিও? বিজ্ঞান-গবেষণায় জীবন উৎসর্গ করে দেওয়া মেয়ের গল্প বলেনি অগ্নিসম্ভবা (১৯৫৯)? গাঁয়ের মেয়ে থেকে অভিনেত্রী হয়ে ওঠার যাত্রাপথ চিত্রিত করেননি পদ্মা দেবী (গাঁয়ের মেয়ে, ১৯৫১)? আরও পিছিয়ে গেলে চাকরিপ্রার্থী বাঙালি খ্রিস্টান মেয়ের চরিত্রই কি ১৯৩৫ সালে কানন দেবীকে সুপারস্টার বানায়নি মানময়ী গার্লস স্কুল ছবিতে? চলাচল (১৯৫৬) বা জতুগৃহ-র (১৯৬৪) অরুন্ধতী দেবী আত্মনির্ভর নারীর আইকন নন? বাংলা ছবির কর্মরত মেয়েদের নিয়ে আলোচনায় এঁরা সব যেন আজও এক-একটি মেঘে ঢাকা পড়ে থাকা তারা।
দুই ভাই ছবির কথা বলেছি আগেই। আরও কয়েক বছর পিছিয়ে গিয়ে অনুপমা (পরিচালনা: অগ্রদূত) ছবিটি যদি দেখি, কাহিনিসারের দিক থেকে তাকে অনেকাংশে মেঘে ঢাকা তারা-র পূর্বসূরি বলে মনে না হয়ে পারে না। সুশীল জানার সূর্যগ্রাস উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এই ছবিতে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পিতার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে অনুপমার (অভিনয়ে অনুভা গুপ্ত) উপরে। তার প্রেমিক তাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দেয়। অনুপমার মা তার পর থেকেই পরিকল্পনা করতে থাকেন, বালবিধবা অনুপমাকে সংসারে ধরে রেখে কী করে তার বোনের সঙ্গে অনুপমার প্রেমিকের বিয়ে দেওয়া যায়। অন্য দিকে প্রেমিকের সঙ্গে অনুপমার সম্পর্ক এমনিও চিড় খেতে থাকে। কারণ অফিস ইউনিয়নে লড়াকু ভূমিকা নেওয়া প্রেমিক সেখানে অনুপমাকে পাশে পায় না। সংসারের মুখ চেয়ে অনুপমাকে আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে হয়। অর্থাৎ অনুপমার লড়াইটা শুধু যে সংসারে নয়, সংসারের বাইরেও— কর্মক্ষেত্র নিজেও যে হয়ে উঠছে লড়াইয়ের একটা অন্য ময়দান— সেই দিকটাও ছবিতে এসে পড়ে খুব স্বাভাবিক গতিতেই। এবং শেষ পর্যন্ত অনুপমা যখন বস-এর মুখের উপরে ‘না’ বলে, সেই মুহূর্তে সে নীতা থেকে আরতি হয়ে ওঠার পর্বটাও যেন ছুঁয়ে ফেলে। অনুপমা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল কেউই তখনও পরিচালক হিসাবে দর্শকের দরবারে আত্মপ্রকাশ করেননি। অথচ এই অনুপমা বাংলা ছবির লড়াকু মেয়েদের আলোচনায় ব্রাত্য থেকে যায় অনেকাংশেই।
কিংবা ধরা যাক, ১৯৬১ সালের আর একটি ছবির কথা— আজ কাল পরশু (পরিচালনা: নির্মল সর্বজ্ঞ)। একই সঙ্গে দু’টি ঘটনা ঘটে ছবিতে। প্রৌঢ় কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর ন্যায্য প্রোমোশন থেকে বঞ্চিত করে মাথার উপরে বসিয়ে দেওয়া হয় মালিকের আত্মীয়কে। সেই নতুন বস এক দিন অফিসেরই এক মহিলা কর্মীকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে। মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে চাকরি যায় কানুবাবুর। ছবিতে ঘটনাটি তাঁর ট্র্যাজেডি হিসাবেই দেখি। কিন্তু অলক্ষিত থাকে না, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রটিও প্রস্তুত হচ্ছে। ঠিক যেমন কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম্পর্কের সমীকরণে নতুন নতুন পরতও যোগ হচ্ছে। মৃণাল সেনের পুনশ্চ-তে এন বিশ্বনাথন আর কণিকা মজুমদার, মহানগর-এ হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় আর মাধবী মুখোপাধ্যায়ের উদাহরণ মনে করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আবার মহানগর-এরই চায়ের দোকানের দৃশ্যটি মনে করা যাক। যেখানে মাধবী স্বামীর রোজগার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন আর অনিল চট্টোপাধ্যায় শুনে ফেলছেন পিছনে বসে। এই বানিয়ে বলা আর শুনে ফেলার দিকটুকু বাদ দিয়েও কিন্তু দৃশ্যটি আলাদা করে নজর কাড়ে। নজর কাড়ে নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেম-ভালবাসার বাইরেও এক সহজ কথালাপের পরিসর তৈরি হওয়াকে কেন্দ্র করে। ছোটবেলার বন্ধু বা সহপাঠী বাদেও কর্মক্ষেত্র যে নতুনতর বন্ধুত্ব আর সহজতার রাস্তা খুলে দিচ্ছে, সেটা আলগোছে ধরা থাকে ওই ছোট্ট দৃশ্যের মধ্যে।
আবার একই সঙ্গে চেনা সম্পর্কেরও কত অচেনা দিক যে তৈরি হয়! পুনশ্চ-তেই দেখি, কণিকা অফিস সেরে বাড়ি ফিরছেন। ভিড় বাসে মহিলা সিটে জায়গা পেয়েছেন। পাশে এসে দাঁড়ালেন পাহাড়ী সান্যাল। বৃদ্ধ বাবাকে সিট ছেড়ে দিতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠল মেয়ে। এই যে ছোট থেকে অফিস-ফেরত বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখার অভ্যাস, কালের গতি সেই বাবাকে এক দিন একই বাসের সহযাত্রী হিসাবে আবিষ্কার করাল। বাবা আর মেয়ে এক সারিতে এসে দাঁড়াল। এই চাকরি-রোজগারকে কেন্দ্র করেই লিঙ্গ-সম্পর্কের কত উত্থান-পতন! স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে কত ধরনের টেনশন! কাঁচ কাটা হীরে (১৯৬৬, পরিচালনা: অজয় কর) ছবির লিলি চক্রবর্তী। বড়লোকের ছেলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রায়শ অফিসে ফোন করেন, গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করেন। সহকর্মীদের ট্যারা চোখ তাড়া করে বেড়ায়। এই অসম সম্পর্ক কর্মক্ষেত্রে অসুবিধা করবে না তো? ভাবতে হয় লিলিকে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের উপন্যাস অবলম্বনে উত্তম-সুচিত্রার ইন্দ্রাণী (পরিচালনা: নীরেন লাহিড়ী)! মহানগর-এর পাঁচ বছর আগে তৈরি এই ছবিতে দু’জনের সম্পর্ক একটা সময় ভেঙেই যায় আহত পৌরুষের অভিঘাতে! আজ কাল পরশু-তে কানুবাবুর বেকার ছেলে অনুপকুমার ভালবাসেন মাধবীকে। ইতিমধ্যে এক পরিচিতের সূত্র ধরে মাধবীর একটা চাকরির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অনুপের মুখটা নিমেষে অন্ধকারে ঢেকে যায়।
শুধুই অন্ধকার? আলো নেই? এ বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত অঞ্জনা ভৌমিকের দু’টি ছবি ফিরে দেখা যেতে পারে। চৌরঙ্গী (পরিচালনা: পিনাকী মুখোপাধ্যায়) আর কখনো মেঘ (পরিচালনা: অগ্রদূত)। ১৯৬৮-র এই দু’টি ছবিতেই অঞ্জনা শুধু চাকরিরত নন, একা মেয়ে। একা থাকা, একা বাঁচা মেয়ে। পদাতিক (১৯৭৩)-এর সিমি গরেওয়ালের পূর্বসূরি যেন— স্বনির্ভর, স্বাধীনচেতা, সপ্রতিভ, সাহসী। তাঁর প্রেমের ভাষাও অনেকটা অন্য রকম। কখনো মেঘ ছবির শেষ দৃশ্যে তিনি যে ভাবে অবলীলায় উত্তমের চুলের মুঠি চেপে ধরেন, ললিতলবঙ্গলতা অবয়ব খসিয়ে সমানে সমানে টক্কর দেওয়া এক নারী পর্দায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে!
মূলধারার ছবির এই সর্বাঙ্গীণ চালচিত্রটি মনে রাখলে বোঝা যায়, মেঘে ঢাকা তারা-মহানগর-পুনশ্চ বা একদিন প্রতিদিন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। বাংলা ছবির তিন মহারথীর ছবিতেই যে নতুন যুগের মেয়েরা উঠে এলেন, তার জমি জনপ্রিয় সংস্কৃতির অঙ্গনেও তৈরি হচ্ছিল আগে থেকেই। ভিনধারা আর মূলধারা— সময়কে পড়তে পিছিয়ে ছিল না কেউই। প্রশ্ন একটাই। আমরা তাদের যথাযোগ্য মর্যাদায় পাঠ করেছি কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy