E-Paper

প্লাস্টিক দূষণ থেকে মুক্তির পথ

গত দুই দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন তুঙ্গে উঠেছে। ২০১০ সাল থেকে এ-যাবৎ যা হয়েছে, তার পরিমাণ গোটা বিংশ শতকের চেয়েও বেশি। এবং প্রতি বছর যা তৈরি হয় তার অর্ধেকেরও বেশি এক বার ব্যবহারযোগ্য।

সিদ্ধার্থ জি সিংহ

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৩৫

আশা করা যেতে পারে, আর দু’দিনের মধ্যে হয়তো একটি ঐতিহাসিক চুক্তি রূপায়িত হবে, যা অবশেষে প্লাস্টিক দূষণের সমস্যার অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নেতৃত্বাধীন ‘দ্য গ্লোবাল প্লাস্টিকস ট্রিটি’ সংক্রান্ত আলোচনা প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য, উৎস থেকে শুরু করে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত সমগ্র পর্যায়গুলিতে প্লাস্টিক দূষণের মোকাবিলায় এক আইনত বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক কাঠামোর রূপরেখা নির্মাণ।

বৈশ্বিক বিষয় হিসাবে প্লাস্টিক দূষণের সমস্যাটি প্রথম উঠে আসে ২০১২ সালে, ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট অ্যাসেম্বলি (ইউএনইএ)-তে। প্রাথমিক আলোচনাগুলি সীমাবদ্ধ ছিল মূলত সামুদ্রিক বর্জ্যের উপর। কিন্তু ধীরে ধীরে এর পরিসরটি বিস্তৃত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক, এবং পরবর্তী কালে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহারের মতো বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের দিকে। ২০১৮ সালে স্বীকৃতি পায় এক অমোঘ সত্য— প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধুমাত্র সমুদ্রে গিয়েই শেষ হয় না। এটি একটি ধারাবাহিক সমস্যা, যা আমরা যে ভাবে এটি তৈরি করি, ব্যবহার করি এবং বাতিল করি, তার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ক্রমবর্ধমান সচেতনতা আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সঙ্ঘবদ্ধ এক প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করে। ২০২২ সাল নাগাদ ইউএনইএ এক আন্তঃসরকার আলোচনা কমিটি (আইএনসি) প্রতিষ্ঠা করে, যার কাজ— প্লাস্টিকের উৎস থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সমস্ত পর্যায়ে এবং সামুদ্রিক পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণের অবসান ঘটাতে এক বাধ্যতামূলক চুক্তি তৈরি। তার পর থেকে পাঁচ দফা আলোচনা চলেছে দেশগুলির সঙ্গে এই অত্যন্ত জটিল বিষয়ের এক সর্বসম্মত সমাধানের প্রচেষ্টায়। জেনিভায় চলছে এরই পঞ্চম পর্বের দ্বিতীয় দফার সম্মেলন।

তবে এই চুক্তির উদ্দেশ্য সমস্ত ধরনের প্লাস্টিক বর্জন নয়। মূল ভাবনাটি হল— এক নমনীয় অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী সমঝোতায় আসা যা প্লাস্টিকের অত্যাবশ্যক ব্যবহারের ক্ষেত্রটিকে ঘেঁটে না ফেলেই এর পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত, এবং সামাজিক ক্ষতির দিকটিকে তুলে ধরবে। আইএনসি হল সেই পরিসর যেখানে রাষ্ট্রপুঞ্জের সমস্ত সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এই আলোচনাগুলি চলছে। এটি শুধুমাত্র সরকারের প্রতিনিধিত্বই করছে না, করছে সেই সব মানুষেরও যাঁরা ইতিমধ্যেই ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের শিকার।

আলোচনায় দু’টি বৃহত্তর প্রশ্ন আছে। প্রথমত, দেশগুলির কী ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক এবং আইনি পদক্ষেপ করা উচিত? এবং দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সিদ্ধান্ত কী ভাবে নেওয়া হবে? কিছু দেশ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেও, অন্যরা জাতীয় স্তরে নির্ধারিত পদক্ষেপের পক্ষেই সায় দিয়েছে। তবে অনেকেই মিশ্র মডেল গ্রহণের পক্ষপাতী, যেখানে আইনত বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বতঃপ্রণোদিত সাড়া দেওয়ার বিষয়টিও থাকবে।

গত দুই দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন তুঙ্গে উঠেছে। ২০১০ সাল থেকে এ-যাবৎ যা হয়েছে, তার পরিমাণ গোটা বিংশ শতকের চেয়েও বেশি। এবং প্রতি বছর যা তৈরি হয় তার অর্ধেকেরও বেশি এক বার ব্যবহারযোগ্য। প্লাস্টিক উৎপাদনে রাসায়নিকের প্রয়োগ আরও এক উদ্বেগের কারণ। এগুলি হামেশাই অ-দৃশ্য এবং অ-নিয়ন্ত্রিত থেকে যায়, যা খাবার, জল এবং মানবশরীরে মিশে যেতে সক্ষম। গবেষকরা হরমোনের ভারসাম্য ব্যাহত করা এবং প্রজনন সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসমস্যার সঙ্গে এই ধরনের কিছু রাসায়নিককে সংযুক্ত করছেন। ‘রিসাইক্লিং’ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েও এই দূষিত বস্তুগুলি দিব্যি অক্ষত থেকে যায়। ‘রিসাইক্লিং’-এর প্রতিশ্রুতিটিও ব্যর্থ। বিশ্বে প্লাস্টিককে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার পদ্ধতির হারটি কখনও ১০ শতাংশের গণ্ডি ছাড়ায়নি। সারা বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্যের দুই-তৃতীয়াংশই অব্যবস্থাপনার শিকার, কখনও এদের ঠাঁই হয় আবর্জনার স্তূপে, কখনও নদী, সমুদ্র, মাটির মতো প্রাকৃতিক পরিবেশে। পরিণতিতে, মাইক্রোপ্লাস্টিক আর ন্যানোপ্লাস্টিক এখন ছড়িয়ে পড়ছে প্রায় সর্বত্র, উত্তর মেরুর বরফ চাদর থেকে মানবশরীরের অভ্যন্তরে। ফলে, প্লাস্টিক দূষণ শুধু পরিবেশের সঙ্কট নয়, প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জও বটে।

ইতিমধ্যে দেশগুলি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া, ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলিকে বিকল্প বেছে নিতে সহায়তা দান, এবং বর্তমান প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় কৌশল উদ্ভাবনের প্রয়োজন বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেছে। কিন্তু সদিচ্ছার তীব্রতা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণে স্বচ্ছতার ক্ষেত্রটি এখনও প্রশ্নের মুখে। দুই গুরুত্বপূর্ণ ধারা এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তিন নম্বর (প্লাস্টিক পণ্য এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক) এবং পাঁচ নম্বর (প্লাস্টিক পণ্যের নকশা)। তিন নম্বর ধারা কয়েক ধরনের এক বার ব্যবহারযোগ্য পণ্যের মতো সমস্যা সৃষ্টিকারী প্লাস্টিকের ব্যবহার ধাপে ধাপে কমানোর রূপরেখা নির্দেশ করে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে, ১২০টি দেশ ইতিমধ্যেই জাতীয় স্তরে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার সঙ্গে এটি একযোগে কাজ করতে পারে। তাতে ধারাবাহিকতার অভাবের কারণে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাকে এড়ানো যাবে। পাঁচ নম্বর ধারার মূল লক্ষ্য পণ্যের নকশা। প্লাস্টিককে এমন ভাবে তৈরি করা, যাতে কোনও রকম ক্ষতিকারক রাসায়নিক নিঃসরণ না করেই তাকে পুনর্ব্যবহার করা যায়। এই দুই ধারা একযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, ব্যবহার হ্রাস, এবং নতুন ভাবে নির্মাণের মাধ্যমে এক লক্ষণীয় পরিমাণ প্লাস্টিকের ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম, যা সরকার এবং ব্যবসার পক্ষে সাশ্রয়কারী হয়ে উঠতে পারে। তবে সম্ভবত সবচেয়ে সমস্যার ক্ষেত্রটি হল অর্থ। দেশগুলি আর্থিক, কৌশলগত এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রয়োজনের বিষয়টিতে জোর দিয়েছে। এই সহায়তা শুধুমাত্র পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেই নয়, শ্রমিক, ব্যবসা এবং স্থানীয় প্রশাসনকে বিকল্প পথে এগোনোর ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়ে উঠবে।

সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Pollution Environment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy