Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
coronavirus

নিরন্তর প্রশ্ন করে যেতে হবে

জনস্বাস্থ্য রাজনীতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সর্বদেশে, সর্বকালে।

স্থবির দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২১ ০৫:০৪
Share: Save:

জনস্বাস্থ্য বহাল রাখতে গিয়ে যে সব পদ্ধতি নেওয়া হয়, তাতে উপকারের সঙ্গে ক্ষতির দিকটাও দেখার কথা। কারণ, জনস্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দুর্ভাবনা সমাজের স্বাস্থ্য নিয়ে। তাৎক্ষণিক নিয়ম-নীতির চেয়ে এখানে দূরদৃষ্টি বেশি জরুরি। আমাদের কোনও পদক্ষেপের কারণে অসুখের ভার যদি সচ্ছল মানুষের থেকে অসচ্ছল, অসহায়দের কাঁধে চলে যায়, তা মর্মান্তিক।

যিনি অসুস্থ তাঁর রোগনির্ণয় অতি জরুরি; কিন্তু যিনি আপাতসুস্থ এবং উপসর্গহীন তাঁর উপর রোগনির্ণয়ের পরীক্ষা চালানো জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে ক্ষতিকর। জনস্বাস্থ্য দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাস আর আস্থার উপর। প্রশাসন আর চিকিৎসকদের উপর মানুষের ভরসা। দুনিয়াকে ‘কোভিড-শূন্য’ করার জন্য যুদ্ধের স্লোগান দিলে, আচার-আচরণে আতঙ্ক সৃষ্টি করলে সেই আস্থা আর থাকতে চায় না। প্রথমেই মানুষকে নির্বোধ, অপরিণত আর বিশৃঙ্খল ধরে নিলে ‘হাতে বন্দুক পায়ে বন্দুক’ ছাড়া রইলটা কী! তার চেয়েও বড় কথা, জনস্বাস্থ্য রক্ষার গুরুদায়িত্ব যাঁদের কাঁধে, তাঁদের সামনে প্রথম দাবিটার নাম সততা, যা প্রতিটি পদক্ষেপেই জরুরি।

এবং প্রয়োজন, সুস্থ, সভ্য বিতর্ক। আজকের যুগে বিপুল, বিচিত্র তথ্য যখন আমাদের হাতের মুঠোয়, তখন জীবনমরণ নিয়ে প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাই ধমক দিয়ে কাজ হবে না। তার চেয়ে ভাল মানুষের দুয়ারে যাওয়া, প্রতি দিন। তাঁরা কী ভাবেন, কী চান, জীবিকার সংস্থান কী ভাবে হবে, কী ভাবে রোগের সঙ্গে বোঝাপড়া করা যাবে, এই রহস্যের হদিস তাঁদের কাছেই আছে।

ঠিক এই ভাবে না-বললেও, উপরের কথাগুলো এসেছে ‘আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর ইকনমিক রিসার্চ’ নামে এক প্রখ্যাত সংস্থার কাছ থেকে— লেখক ডাক্তার মার্টিন কুলডর্ফ। তিনি জানিয়েছেন, ‘কোভিড’ অতিমারির অবসরে আমরা জনস্বাস্থ্যের নীতি আর আদর্শগুলো বিসর্জন দিয়েছি। অন্য অনেক স্থিতধী মানুষও বলেছেন, “এ ভাবে নয়, এ ভাবে হয় না।” যদি কেউ বলেন, কী ভাবে হয়— তার উত্তর লুকিয়ে আছে অনুশীলনে। দশ হাজার বছর ধরে সেই অনুশীলনের অভিজ্ঞতা আছে মানুষের ঝুলিতে। তার সারাংশ আমরা ভুলতে বসেছি। তাই রোগের মতিগতি, রোগনির্ণয়, প্রতিষেধক আর চিকিৎসা নিয়ে হাহাকার আর থামতে চায় না।

এই হাহাকারের মধ্যে কি নিষ্প্রশ্ন থাকাই উচিত? ডাক্তাররা কী করবেন? যথেষ্ট তথ্য আর যুক্তির জন্য অপেক্ষা না-করে তাঁরা কি খড়কুটো ধরেও বাঁচার, বাঁচাবার দিকেই নজর দেবেন? না কি গবেষণার গুণমান, ওষুধের কার্যকারিতা, টিকার চরিত্র আর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন? তা নিয়ে কিছু কাল আগে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ তর্কসভা বসেছিল। তাতে এক পক্ষ বললেন, স্বাভাবিক সময়কালে ডাক্তাররা নতুন গবেষণাপত্র, ওষুধপত্র বা তথ্যপ্রমাণ নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকেন। কিন্তু এখন চলছে এমন এক অতিমারি, যার জন্য আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না। তাই এখন আর যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ, স্বচ্ছতা, যুক্তি ইত্যাদি দাবি করলে চলবে না। সেগুলো যথাসম্ভব থাকলে ভাল, না-থাকলেও বা আপাতত তথ্য গোপন থাকলেও তেমন ক্ষতি নেই। বরং মৃত্যুর স্রোত রোধ করাই ডাক্তারদের কর্তব্য। কিন্তু প্রতিপক্ষ বললেন, অতিমারির ইতিহাস নতুন না, তাই আমাদের অভিজ্ঞতাও কম না। আমরা সেই ওষুধ আর সেই চিকিৎসার উপরেই ভরসা রাখি, যার পিছনে স্বচ্ছতা আছে। অন্যথায় বিপদ আরও বাড়ে। প্রথম বিপদ, সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে যে কোনও ওষুধকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অতি-উপকারী বলে দেখানো, আর দ্বিতীয় বিপদ, ওষুধের কুফলগুলোকে প্রায় ধামাচাপা দেওয়া। কোম্পানিগুলো এ সব ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। তাই তথ্যের স্বচ্ছতা অপরিহার্য।

অর্থাৎ, তর্ক চলছে। বিজ্ঞান সভায় যেমন, জনমনেও তেমনই। অথচ, আজকাল অনেকে প্রশ্ন তুললেই রাজনীতির গন্ধ পান। তাঁরা ভেবে দেখেন না, জনস্বাস্থ্য রাজনীতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সর্বদেশে, সর্বকালে। ‘নিউ নর্মাল’ বা ‘কর্পোরেট’ ব্যবস্থার কথা উঠলে অনেকে বিরক্ত হন, চমকে ওঠেন। অথচ, এমন ইঙ্গিত আমাদের রাষ্ট্রের নতুন শিক্ষানীতিতেই স্পষ্ট দেওয়া আছে। সেখানে আমরা যে শিল্প সভ্যতার ‘চতুর্থ’ যুগে প্রবেশ করেছি, সে কথা গোপন থাকেনি। তার মানে যে ডিজিটাল যুগ, তা না-বোঝার মতো নয়। সব রাষ্ট্রেরই একটা পরিকল্পনা থাকে, ভাল-মন্দ দুই অর্থেই। সেটা অবাঞ্ছিত নয়।

সাধ্যমতো চেষ্টা করে আমরা যে আজকের বিপর্যয় অতিক্রম করব, সত্যি। কিন্তু, “কোনও হুমকির সামনে আমি আমার ডাক্তারি বিদ্যাকে এমন ভাবে ব্যবহার করব না, যাতে নাগরিক স্বাধীনতা আর মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়”— ডাক্তারদের এই অঙ্গীকারও বদলে যায়নি। তাই গণ টিকাকরণ কতটা যুক্তিগ্রাহ্য, লকডাউন কার সর্বনাশ ডেকে আনে, এই প্রশ্ন ন্যায্য। কোভিডে ভোগান্তি, মৃত্যুর চেয়ে অনাহারের বিপন্নতা আর মৃত্যু মহীয়ান কি না, এ সব কথা তুলতেই হবে। এই সমাজ গণতান্ত্রিক। কোনও কোনও সুনাগরিক যে কেন সেই কথা ভুলিয়ে দিতে চান, জানি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

COVID-19 coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE