E-Paper

সুস্থায়ী উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ

সুস্থায়ী উন্নয়নের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “বর্তমানের যে কোনও প্রয়োজন এমন ভাবে মেটানো, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব প্রয়োজন মেটানোর পথে বাধা সৃষ্টি না হয়।”

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫ ০৬:১২
Share
Save

গত এক দশকে বিজ্ঞানী থেকে পরিবেশকর্মী, এমনকি রাজনীতিকদের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে একটি শব্দবন্ধ— সাসটেনেব্‌ল ডেভলপমেন্ট বা সুস্থায়ী উন্নয়ন। এটি এমন একটি ধারণা, যার পরিধি আক্ষরিক অর্থেই বৈশ্বিক। সুস্থায়ী উন্নয়নের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “বর্তমানের যে কোনও প্রয়োজন এমন ভাবে মেটানো, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব প্রয়োজন মেটানোর পথে বাধা সৃষ্টি না হয়।” অর্থাৎ, এটা আসলে একটা দর্শন বা পন্থা, যা বিশ্ববাসীকে সুস্থায়ী ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এক সময় অবধি উন্নয়ন বলতে তো আমরা বুঝেছি; ‘আজ যাকে বলো বনভূমি তাকে জনভূমি বলো কাল’ (সবুজ ছড়া, শঙ্খ ঘোষ)। সেই উন্নয়নের ফলাফল হিসেবে যা যা পেয়েছি, তা খুব একটা সুস্থায়ী ভবিষ্যতের আশা দেখায়নি। পৃথিবীকে ক্রমাগত একটা ‘গ্রিন হাউস’-এ পরিণত করাই হোক, ভূগর্ভের জলতল ক্রমাগত নামিয়ে ফেলাই হোক, বা জীববৈচিত্র ধ্বংস করাই হোক— ‘উন্নয়ন’ কখনও ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি। কিন্তু, সামগ্রিক উন্নয়ন মানে যে শুধু বড় বড় বাড়ি-গাড়ি-যন্ত্রপাতি নয়, সুস্থায়ী উন্নয়নের দর্শন সে কথাটিই স্পষ্ট ভাবে বলে। পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা, কার্বন নিঃসরণ কমানো ইত্যাদি নিয়ে আমরা এখন কিছুটা হলেও ভাবি— কিন্তু সেগুলো কার্যকর করে তুলতে গেলে আসলে আরও কত বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, এই কর্মপন্থা সেইটা শেখায়। বলা যেতে পারে, পরিবেশ ও সম্পদ সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের মধ্যে সমন্বয় রেখে চলার নামই হল সুস্থায়ী উন্নয়ন। সরাসরি পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো এর সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কিত। কিন্তু তার বাইরেও সুস্থায়ী উন্নয়নের আওতার মধ্যে অনেক কিছু পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত পরিবেশ সংরক্ষণেও সহায়তা করে।

২০১৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষণা করে সাসটেনেব্‌ল ডেভলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) বা সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহ। মোট ঘোষিত লক্ষ্য ১৭টি, ২০৩০ সালের মধ্যে তা পূরণ করার কথা বলেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। গোটা পৃথিবী এবং তার সব অধিবাসীর জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করাই এসডিজি-র লক্ষ্য; পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের মোকাবিলা করাও। এসডিজি-র প্রথম তিনটি লক্ষ্য হল দারিদ্র দূরীকরণ; দুনিয়াকে ক্ষুধামুক্ত করা; এবং, সকলের সুস্বাস্থ্য ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ নিশ্চিত করা। ছয় ও সাত নম্বর লক্ষ্য হল সকলের জন্য পরিস্রুত পানীয় জল, ও নিকাশির ব্যবস্থা করা; এবং সুলভ দূষণহীন শক্তির ব্যবস্থা করা।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বিষয়গুলির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ ঠেকানোর সম্পর্ক কী? মাইক্রোসফট-এর প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস হাউ টু অ্যাভয়েড আ ক্লাইমেট ডিজ়াস্টার (২০২১) বইটিতে সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। বিল এবং তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ (বিএমজিএফ) নামে একটি অলাভজনক সংস্থা চালান— সংস্থাটি বিশ্ব-স্বাস্থ্য, লিঙ্গসাম্য, পরিবেশ দূষণ, সার্বিক উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্ব জুড়ে কাজ করে। সকলের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ ও উন্নয়নের দাবিকে (অর্থাৎ সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো) প্রতিষ্ঠা করা এই সংস্থার ঘোষিত নীতির মধ্যে পড়ে। সংস্থার কাজের ফলাফল ও তার বিশ্লেষণ থেকে বিশ্বের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার পিছনে দু’টি প্রাথমিক কারণ শনাক্ত করা যায়, যেগুলি পরিবেশের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত— এক, শক্তির ব্যবহার; এবং দুই, জলবায়ু পরিবর্তন। সংস্থার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ৮৬ কোটি মানুষের কাছে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। রান্না, আলো জ্বালানো ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজের জন্য তাঁরা কাঠকুটো-কয়লা-ঘুঁটে-তেল যাই ব্যবহার করুন, তা কার্বন নিঃসরণ করছে, ফলে নিয়মিত দূষণ ঘটছে। যত ক্ষণ তাঁদের জন্য বিদ্যুতের মতো সবচেয়ে দূষণহীন শক্তির ব্যবস্থা না করা হচ্ছে, তত ক্ষণ এই দূষণ ঘটেই চলবে।

অন্য দিকে, জলবায়ু বদলের কারণে গাছের ফল, খেতের ফসল ও জলজ প্রাণীর সংখ্যা ও জীবনচক্রে যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা কোটি কোটি মানুষের জীবনের প্রাথমিক চাহিদা জল ও খাদ্য নিরাপত্তাকে চূড়ান্ত ভাবে বিঘ্নিত করছে। এর মধ্যে অরণ্যবাসী মানুষ, পশুপালনকারী যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষ যেমন আছেন, তেমনই কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, মউলিদের মতো বিভিন্ন প্রকৃতিনির্ভর পেশাদাররাও আছেন। এই ফলাফলের সামনে দাঁড়িয়ে আর সব উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে যায়। তাই সুলভে দূষণহীন বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং তা সকলের কাছে পৌঁছে যাওয়া তো বটেই, জলবায়ু বদলের প্রতিরোধ করাও সুস্থায়ী উন্নয়নের আবশ্যিক লক্ষ্য।

তার জন্য শিল্পের পরিকাঠামোকে অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক করে তুলতে হবে, যাতে নতুন নতুন উদ্ভাবনকে অগ্রগতির হাতিয়ার করে তোলা যায় (এসডিজি-র নবম লক্ষ্য)। বিল গেটসও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের কথাই বলেছেন, যা জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। আর আবহাওয়া-জলবায়ু-পরিবেশ এই সবই জল ও স্থলের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের উপরে নির্ভরশীল; তাই সুস্থায়ী উন্নয়ন মানে যে আসলে জঙ্গলের গভীর থেকে জলের নীচে সর্বত্র জীবনকে নির্বিঘ্নে বিকশিত হতে দেওয়া, সে কথাও ১৪ ও ১৫ নম্বর লক্ষ্যে উল্লেখ করা আছে। তবে সুস্থায়ী উন্নয়নের সব লক্ষ্যই পূরণ হতে পারে একমাত্র সার্বিক ও যথার্থ শিক্ষার মাধ্যমে; তাই সার্বিক শিক্ষার প্রসারকেও তালিকার চার নম্বরে রাখা হয়েছে।

সুস্থায়ী উন্নয়ন যে-হেতু আসলে সার্বিক উন্নয়ন, তাই লিঙ্গসাম্য (নারী-পুরুষ অনুপাতের সমতা) এবং নারীর ক্ষমতায়ন এর একটি আবশ্যক উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে যায় (পঞ্চম লক্ষ্য)। ক্ষমতায়নের ফলে নারী ও নারীশ্রম অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু তা ছাড়াও মহিলারা তাঁদের সঞ্চয়মুখী ও সাশ্রয়মুখী স্বভাবের কারণে নানা ধরনের সম্পদ সংরক্ষণের দিকে যে পদক্ষেপ করে থাকেন, তা পরিবেশের পক্ষে সর্বদাই অনুকূল হয়। সে বৃষ্টির জল ধরে রাখাই হোক আর নিবে আসা আগুনে ‘গমে গমে’ কিছু রান্না করাই হোক বা পুরনো কাপড় দিয়ে পোশাক, চাদর, পর্দা বানানোই হোক। পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উভয় অর্থেই নারী ক্ষমতায় থাকলে এই কাজগুলো অনেক বেশি ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে যা আসলে পরিবেশবিদ্যায় পড়া ‘থ্রি-আর’ (রিডিউস, রি-ইউজ়, রিসাইকল)-কেই সমর্থন করে।

এ ছাড়াও সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যের মধ্যে আছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈষম্য দূর করা, সম্পদের উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা, শহরগুলোকে সকলের বসবাসের উপযুক্ত ও নিরাপদ করে তোলা ইত্যাদি। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন ক্ষমতাবান দেশের দ্বিচারিতা যে বিশ্বের সামগ্রিক উন্নয়নের বিপরীতে যায় সে কথা বার বার প্রমাণিত হয়। তবে সব শেষে যে দু’টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে সেগুলো আলাদা করে উল্লেখ না করলেই নয়— সমাজে সার্বিক ভাবে শান্তি ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা করা (লক্ষ্য ১৬) এবং এই সমস্ত লক্ষ্য সাধনের জন্য সবাই মিলে লড়ে যাওয়া (লক্ষ্য ১৭)। এই মুহূর্তে পৃথিবীর দুই প্রান্তে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে বছরের পর বছর ধরে। আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ কোনও রকমে চাপা দেওয়া গেছে। এই সব যুদ্ধেই শক্তি, সম্পদ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণ ধ্বংস হয়েই চলেছে। এর পরেও আমাদের শান্তির উপরেই ভরসা রাখতে হবে।

রাষ্ট্রপুঞ্জ সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য প্রকাশ করার পর প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গেল। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জল-পরিবেশ কোনও দিকেই লক্ষ্যমাত্রার দিকে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বলে জানা যাচ্ছে। আমাদের সরকারের নানা রকম কার্যক্রমের শিরোনামেও বার বার এসডিজি-র কথা উল্লেখ হয়েছে, কিন্তু তার কর্মপদ্ধতিতে এই দর্শনের চিহ্ন তেমন দেখা যায়নি। কথাটা হতাশাজনক। কিন্তু বিশ্বের ১৯৩টি দেশ সম্মিলিত ভাবে যে কর্মপন্থায় সম্মত হয়েছে, তার উপরে ভরসা করতেই হবে। এ বিশ্বকে আগামীর শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার আর কোনও পথ নেই।

রসায়ন বিভাগ, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

causes of poverty Climate

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।