E-Paper

একটি চিঠির আশায় জীবন

অশোকস্তম্ভহীন কাগজে দু’কলম লেখা নোটশিট যাঁদের একমাত্র নিয়োগপত্র বলে বিবেচিত হয়, তাঁদের চাকরির ভিত নড়বড়ে হবেই। সেই অনিশ্চয়তার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন উচ্চস্তরের কিছু আধিকারিক।

সন্দীপন নন্দী

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৫ ০৫:২৪

মহাশয়, সবিনয় নিবেদন, হারানো বেতন ফিরিয়ে দিন।” আকুতি-ভরা এক লাইনের চিঠি চিত হয়ে অফিসের ডাকে পড়ে থাকে। পত্রলেখক তাঁর ক্যানসার-আক্রান্ত দিদির চিকিৎসায় পনেরো দিন অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন। সরকারি দফতরে তাঁর পরিচয় ‘ডিআরডব্লিউ’— ডেলি রেটেড ওয়ার্কার, বা দৈনিক বেতনের কর্মী। কাজের ভিত্তি— ‘নো ওয়ার্ক নো পে’— কাজ না করলে টাকা নেই। তাই বলে বারো মাস ডিউটিরত এক কর্মীর অর্ধেক মাসের বেতন এক কোপে কাটা পড়ে যাবে, তা-ও সহজে মানা যায় না। বেশি বড় চিঠি লিখলে যদি কাজটাই না থাকে, তাই ভয়ে ভয়ে একটিই বাক্য লিখেছেন তিনি। যাঁর কাজ, সরকারি দফতরের নানা ঘরের নানা টেবিলে চিঠি পৌঁছে দেওয়া।

এঁর মতো অগণিত কর্মী, যাঁদের উপর নির্ভরশীল সরকারি দফতরের ছোট-বড় শতসহস্র কাজ, চিরকাল সার্ভিস রুলের বাইরেই রয়ে যান। নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াও বিভিন্ন সেকশনের দরকারি কাগজপত্র ফটোকপি করা, জলবহন থেকে আধিকারিকের টিফিন বাক্স ধোয়া, টেবিল সাফ করা, এমনকি বাড়ির বাজারও তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে থাকে। চেয়ারহীন, টেবিলহীন ভ্রাম‍্যমাণ কর্মী এঁরা। কর্মীর অপ্রতুলতায়, দ্রুত কাজ সারার প্রয়োজনে, পরিশ্রম-সাপেক্ষ কাজের জায়গায় এঁদের বার বার ডাক পড়ে। দেরি হলে, ভুল হলে, জোটে চরম অপমান। হাড়িকাঠে মাথা-দেওয়া ছাগশিশুর মতো, যে কোনও মুহূর্তে কাজ খতম হতে পারে জেনেও তাঁরা উপরওয়ালার আদেশের অপেক্ষা করে চলেছেন।

প্রতি মুহূর্তে এই কর্মীদের মনে করানো হয়, তাঁরা ‘বহিরাগত’। বায়োমেট্রিক স্বাক্ষরব‍্যবস্থা চালুর পরেও ঘড়ি ধরে রোজ অফিসের হাজিরাখাতায় সই দেন তাঁরা। তাঁদের কাজ কোনও লিখিত নির্দেশের রূপ নিয়ে আসে না। মুখে মুখেই নির্ধারিত কাজের নির্দেশগুলো অফিসময় ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ শুধু আধিকারিকের মুখের কথায় নিমেষে বদলি হয়ে যান এক দফতর থেকে অন‍্য দফতরে। খানিকটা একুশে আইনের চালে চলে এঁদের কর্মজীবন— কোনও কর্মস্থলে অস্থায়ী কর্মীদের দু’জায়গায় সই করতে বাধ‍্য করা হয়, কোথাও আবার অর্জিত ছুটির দিনেও বেতন কাটা পড়ে। অশোকস্তম্ভহীন কাগজে দু’কলম লেখা নোটশিট যাঁদের একমাত্র নিয়োগপত্র বলে বিবেচিত হয়, তাঁদের চাকরির ভিত নড়বড়ে হবেই। সেই অনিশ্চয়তার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন উচ্চস্তরের কিছু আধিকারিক। তাঁদের কাছে এঁরা কেবল নির্দেশ পালনকারী কিছু দেহ।

কাছাকাছি যাঁরা থাকেন, তাঁরা যন্ত্রের মতো নির্দেশ পালন করে-চলা কর্মীদের অভ্যন্তরের মানুষটির আভাস পান। “গত বার লোকসভা ভোট ঘোষণার পর দশটা টিউশন চলে গেল। বাড়ি ফেরার সময়-অসময় কিছু ছিল না তো!” কথাগুলো বলতে বলতে টেবিলে ক’টা চিঠি রেখে চলে গেলেন এক অস্থায়ী। গুনগুন করে ভেসে আসল তাঁর গাওয়া সুর, “সবার শেষে বাকি যা রয় তাহাই লব।” এম মিউজ় করেছিলেন, গানের শিক্ষকতা হারানোর পর এখন তাঁর একমাত্র পরিচয় অস্থায়ী চাকরির পিয়ন। আর এক জন এক দিন জানালেন, “নেভিতে চান্স পেয়েও যাইনি। মা বলেছিল, সরকারি কাজ ছাড়িস না, এক দিন পার্মানেন্ট হবেই।” আজও পাকা চাকরির আশায় অফিস করে যাচ্ছেন এই ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। যদিও এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে তাঁর বেতন বন্ধ— প্রকল্পে বরাদ্দের স্রোত শুকিয়ে গিয়েছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই যুবকও বেতনপ্রাপ্তির প্রার্থনা করে এক লাইনের চিঠি ভয়ে ভয়ে লিখে ডাকে জমা দিয়েছেন।

একটি জেলার জেলাশাসকের দফতরের রেকর্ড রুম থেকে জানা যায়, অনেক ধরাধরির পরে পঞ্চান্ন বছরে একটা অস্থায়ী চাকরি পান তালমন্দিরা গ্রামের বিদুর বর্মণ। চাকরিরত অবস্থাতেই মৃত্যু হয় তাঁর। পরিবার অফিস থেকে কানাকড়িও পায়নি। এটাই অস্থায়ী চাকরিজীবীদের ভবিতব‍্য। এ রকম লক্ষ লক্ষ ‘বিদুর’ আজ খেটে যাচ্ছেন মুখ বুজে। কখনও ‘চাকরি খেয়ে নেব’ কখনও ‘বেতন কমিয়ে দেব’— নানা হুমকি তাঁদের তাড়া করে। এ-ও কি কর্মস্থলে ‘থ্রেট কালচার’ নয়? তাঁরা সব মুখ বুজে সয়ে যান এই আশায় যে, এক দিন একটা চিঠি আসবে, পাকা চাকরির সুসংবাদ নিয়ে। সে দিন আসে না। শুধু দেখা যায়, ‘এসডিও কনফিডেনশিয়াল’ সেকশনে কর্মরত দুই ‘ডিআরডব্লিউ’-কে পাশাপাশি বসে কাজ করতে। এক জন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, অন্য জনের ডিগ্রি ইতিহাসে। হ্যাঁ, চাকরি অস্থায়ী, বেতন সামান্য, জেনেই তাঁরা ঢুকেছিলেন কাজে। কিন্তু এ-ও তো দেখছেন যে একই কাজে নিযুক্ত হয়ে, একই পরিমাণ কাজ করেও স্থায়ী কর্মীর ন্যূনতম বেতন চুক্তি কর্মীর মাইনের প্রায় দেড়গুণ!

চুক্তি কর্মীরা দেখছেন, তাঁদের চাকরি পাকা করার পরিবর্তে, আরও চুক্তি কর্মী নিয়োগ করছে সরকার। স্কুল-কলেজে সামান্য বেতনে শিক্ষক নিয়োগ থেকে সরকারি দফতরের কাজ— পাকা সরকারি চাকরি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে চুক্তির কাজে। অফিস করিডরে কানে ভেসে আসে, “এক জন স্থায়ী কর্মীর বেতনে দশ জন চুক্তিশ্রমিক পোষা গেলে সরকার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা নিয়ে স্থায়ী কর্মী নেবে কেন?” সরকার নিয়োগে আগ্রহী, দরিদ্রের বন্ধু বলে বেশি লোককে চাকরি দিতে চায়, এ যুক্তিও শোনা যাচ্ছে। কেবল আড়ালে থেকে যায় এই প্রশ্নটা— কেমন রয়েছেন চুক্তি কর্মীরা? এমন জীবনই কি তাঁদের প্রার্থিত ছিল?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Workers Staffs

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy