নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলো নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের জন্য নগদ অর্থ, মুফতে রেশন, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, রান্নার গ্যাস, মহিলাদের জন্য সরকারি বাসে ভ্রমণের সুবিধা-সহ নানা প্রকল্পের রূপায়ণে যে অজস্র মানুষ উপকৃত হন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকেরই মত, জনকল্যাণের মোড়কে এ-হেন সরকারি বদান্যতা, তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সুবিধা কেনার কৌশলমাত্র। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা দখল বা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় টিকে থাকাই লক্ষ্য, প্রতিপক্ষকে ঢিট করতে ‘মারি অরি, পারি যে কৌশলে’ই তাদের মূলমন্ত্র। নির্বাচন-পূর্ব সব প্রতিশ্রুতি যে ভোটে জয়ের পর রূপায়িত হয় তা-ও নয়। নেতারা জানেন, জনস্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। তাই বিদেশে লুকিয়ে রাখা কালো টাকা উদ্ধার, প্রত্যেক ভারতীয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ জমা হওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করেও তাঁরা পার পেয়ে যান।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ নামে এক নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে। প্রতিটি নির্বাচনী বুথের জন্য দশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে, আশি হাজার বুথের জন্যে মোট ব্যয় আট হাজার কোটি টাকা। অথচ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতার ২৫ শতাংশ মেটানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি যে রায় দিয়েছে, রাজ্য সরকার তা তো কার্যকর করেইনি, উপরন্তু প্রায় একই সময়ে রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থার কথা জানিয়ে বকেয়া মেটাতে ‘মিসেলেনিয়াস অ্যাপ্লিকেশন’ করে শীর্ষ আদালতের কাছে অতিরিক্ত সময় চাওয়া হয়েছে। যে নতুন প্রকল্পের জন্য সরকার এই বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে। রাজ্যের জনবিন্যাস সাধারণত পাড়া ও গ্রাম দ্বারা চিহ্নিত হলেও এই প্রকল্পে বুথ-ভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ ঘোষণায় প্রশ্নটা বাড়তি মাত্রা পেয়েছে, কারণ ‘বুথ’ একান্তই নির্বাচন-কেন্দ্রিক। নির্বাচকমণ্ডলীকে প্রভাবিত করার এক কৌশল হিসাবে প্রকল্পটিকে দেখছেন অনেকে। ব্যঙ্গ করছেন, ‘আমাদের টাকা, তোমাদের ভোট’।
রাজ্য সরকার অবশ্য বলছে, ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের মাধ্যমে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত ৯০ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন। এর বাইরে স্থানীয় স্তরে অল্পবিস্তর যে সমস্যা রয়ে গেছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা যাতে তা সহজে নির্বাহী দফতরের গোচরে আনতে পারেন, নির্বাহী দফতরগুলিও যাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তা নিরসন করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই নয়া প্রকল্পটির প্রকৃত উদ্দেশ্য।
স্থানীয় স্তরে যাবতীয় সমস্যা, যেমন রাস্তার বেহাল দশা, পানীয় জলের অপ্রতুলতা, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের নানা বিষয়, সরকারের জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলির সুবিধা থেকে প্রকৃত প্রাপকের বঞ্চনা ইত্যাদির সমাধানে আগে থেকেই সরকারের পৃথক পৃথক দফতর ছিল, যেগুলি আজও সক্রিয়। উপরন্তু, এলাকার অধিবাসীদের চাহিদা পূরণ ও প্রয়োজনভিত্তিক কর্মসূচির সুষ্ঠু রূপায়ণ যাতে নিশ্চিত হয়, তার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী ১৯৭৮-এ এ রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন বাম সরকার এই ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় স্বশাসনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে স্থানীয় স্তরে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে বা নতুন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিতে এলাকার প্রকৃত সুবিধাভোগীদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়, স্থানীয় মানুষও পান সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার। এক দিকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় স্বশাসন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, আবার গ্রামোন্নয়নের হাত ধরে গ্রামের পরিকাঠামো পুনর্গঠন তথা গ্রামীণ মানুষের আর্থ-সামাজিক বিকাশে গতি এসেছিল। একই ভাবে শহরাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের দায়িত্ব বর্তায় সংশ্লিষ্ট পুরসভা বা পুর নিগমের উপর। ওই সময়ে গ্রামের দরিদ্র মানুষের আর্থিক উন্নয়ন ও সামাজিক সম্মান প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ভূমি সংস্কার, কাজের বিনিময়ে খাদ্য-সহ যে প্রকল্পগুলির অবদান সর্বাধিক, তাদের সফল রূপায়ণে পঞ্চায়েতি রাজের ভূমিকা বিরাট। সময়ের সঙ্গে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্ব বেড়েছে, বেড়েছে অর্থের জোগানও।
তৎসত্ত্বেও সাধারণ মানুষের অভিযোগ-অনুযোগ শুনতে এবং তাঁদের কাছে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দিতে বাড়তি টাকা খরচ করে ‘দুয়ারে সরকার’ বা ‘দিদিকে বলো’-র মতো প্রকল্প হাতে নিতে হলে সরকারের দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বাম শাসনের মধ্যগগনেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ, পক্ষপাত ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। সময় যত এগিয়েছে, ব্যাধিগুলো প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। ২০২০-তে আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ বণ্টনে ব্যাপক দুর্নীতির কথা মনে পড়তে পারে; কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কর্তৃককোটি কোটি টাকার এই দুর্নীতির তদন্তের পর, ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও ত্রাণের টাকা আত্মসাৎকারীদের অনেকে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। তবে সরকার কথা দিলেও তাদের নামের তালিকা জনসমক্ষে আনা হয়নি। এর পরেও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ও একশো দিনের কাজে ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, বহু ক্ষেত্রে প্রমাণও মিলেছে। এরই প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ওই দু’টি প্রকল্প বাবদ রাজ্যের পাওনা বিপুল টাকা আটকে রেখেছে, ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রাজ্যের লাখো দরিদ্র মানুষ। তাঁদের ক্ষোভ, অবিশ্বাস যে বেড়ে চলেছে তাতে সন্দেহ নেই।
এ অবস্থায় সরকারও হয়তো ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ প্রকল্প রূপায়ণে গঠিত টাস্ক ফোর্সে তাঁরা ব্রাত্য না হলেও, পুলিশ-সহ সরকারি আধিকারিকদের আধিক্য অন্তত তেমনই ইঙ্গিত করে। যে পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠার দ্বারা এ রাজ্যে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জয়যাত্রা শুরু হয়, তার অন্তর্জলি যাত্রা কি আসন্ন? প্রকল্প যা-ই হোক, সরকারি সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে ক্রমবর্ধমান আমলা-নির্ভরতায় সেই আশঙ্কার মেঘ লুকিয়ে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)