E-Paper

আরও কোণঠাসা মধ্যবিত্ত

গোটা পৃথিবী জুড়ে গত দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আমরা যে সমাজব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত, তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান ও প্রভাব অপরিসীম। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ আধুনিক শিক্ষায় আগ্রহী। এই শ্রেণির মানুষজনের মধ্যে সমাজ সচেতনতা প্রবল।

মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:২৬

আয় বা ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে একটি দেশের জনসংখ্যাকে সাধারণত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: স্বল্প আয় বা নিম্নবিত্ত, মাঝারি আয় বা মধ্যবিত্ত ও উচ্চ আয় বা উচ্চবিত্ত। চিরাচরিত ধারণা অনুযায়ী উচ্চবিত্ত পরিবারগুলি ধনসম্পদের (যেমন জমিজমা, মূলধন বা পুঁজি ইত্যাদি) মালিক হয়ে থাকে, অর্থাৎ তাদের আয়ের উৎস জমির খাজনা, মূলধনের সুদ, মুনাফা ইত্যাদি। লক্ষণীয়, এই জাতীয় আয় শ্রমনির্ভর নয়। উচ্চবিত্তের আয়কে তাই অনাদায়ি বা বিনা পরিশ্রমে প্রাপ্ত আয় বলা হয়ে থাকে। অন্য দিকে, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের আয় কষ্টসাধ্য শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আয়।

গোটা পৃথিবী জুড়ে গত দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আমরা যে সমাজব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত, তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান ও প্রভাব অপরিসীম। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ আধুনিক শিক্ষায় আগ্রহী। এই শ্রেণির মানুষজনের মধ্যে সমাজ সচেতনতা প্রবল। মধ্যবিত্ত মানুষ উদ্যমী ও পরিশ্রমী। বাজারে মধ্যবিত্তের চাহিদা অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। অন্য দিকে, মধ্যবিত্তের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পরিচ্ছন্ন মানবিকতা বোধ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় প্রতিহত করে। এক কথায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট জাতির মেরুদণ্ড হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবিবর্তন তাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা যুক্তিযুক্ত। যে কোনও দেশে যে কোনও সময়ে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর্থসামাজিক অবক্ষয় প্রতিহত করে, সুস্থ স্থিতিশীলতা বজায় রাখে, উন্নয়নের পথে সমাজ ও দেশকে এগিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। আর এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি যদি বিবর্তনের গোলক-ধাঁধার ফাঁদে পড়ে নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারাতে শুরু করে ও ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে, মানবিক মূল্যবোধের অবলুপ্তির মাধ্যমে দুর্নীতি, অপসংস্কৃতি ও অপশাসনের পৈশাচিকতা তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে মানবসভ্যতার অপমৃত্যুকে করে বাস্তবায়িত।

কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি মানে ঠিক কী? অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা বা অর্গানাইজ়েশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (ওইসিডি) এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি পরিসংখ্যান-ভিত্তিক মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে। একটি দেশের আয় বণ্টনের মধ্যমার ৭৫% থেকে ২০০%-এর মধ্যে যে জনসংখ্যা বা পরিবারগুলি পড়ে তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, একটি দেশের মোট উপার্জনশীল জনসংখ্যা ১১। তাদের আয় (ভারতীয় টাকার অঙ্কে) যথাক্রমে ১২, ১৩, ১৫, ২০, ৫০, ৬০, ৭০, ৮০, ১১০, ২১০, ২৪০। এই আয় বিন্যাসে মধ্যমার মান ৬০। সুতরাং, ৪৫ থেকে ১২০-র মধ্যে মোট ৫ জন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত। প্রথম ৪ জন নিম্নবিত্ত ও শেষের ২ জন উচ্চবিত্ত। এই গাণিতিক মাপকাঠি বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও এই পদ্ধতির বিপক্ষেও অনেক যুক্তি আছে। কেন মধ্যমার ৭৫% থেকে ২০০%-এর মধ্যে, অন্য কিছু নয় কেন, তার সদুত্তর দেওয়া সহজসাধ্য নয়।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুণগত পরিচিতিও তাই সমান্তরাল ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবিজ্ঞানে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আয়ের উৎস, সম্পদের মালিকানা, জীবনশৈলী ও সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিভিন্ন নির্ণায়কের প্রেক্ষিতে বিচার করা হয়। মধ্যবিত্তের আয় দক্ষ শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বেতন, ছোট ব্যবসা থেকে আয়, সঞ্চয় থেকে প্রাপ্ত সুদ ইত্যাদি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য সুরক্ষিত বাসস্থান। আর এই মধ্যবিত্ত মানুষের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হল, সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকার প্রবণতা। হাটে-বাজারে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার খুব সচেতন ভাবে এমন দ্রব্য ও সেবা ক্রয় করে, যাতে পরিবারের সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষিত থাকে। এই মর্যাদা সচেতনতার জন্যই বিশেষ এক ধরনের জীবনশৈলী ও মূল্যবোধ আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারে লক্ষ করে থাকি।

অনুধাবনযোগ্য যে, মূল্যবোধ ও সামাজিক সম্মানের চেতনাজাত এই জীবনশৈলীই সমাজের স্থিতিশীলতা ও মনুষ্যত্বের প্রশংসাই গুণগুলিকে টিকিয়ে রাখে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে আর্থিকীকরণের বিচিত্র বৈচিত্র ও অধিকাংশ দেশের অর্থব্যবস্থায় এই আর্থিকীকরণের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এক দিকে কিছু মধ্যবিত্তের আয় উপার্জনের পরিসর কিছুটা দৃষ্টিকটু ভাবেই বাড়িয়ে দিয়েছে, এবং অন্য দিকে, বাকি মধ্যবিত্ত মানুষকে ক্রমাগত আর্থিক ক্ষমতার অবনমন ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ, আর্থিকীকরণের দৌলতে মধ্যবিত্ত আজ ক্রমবর্ধমান হারে দু’টি দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই নতুন বিবর্তন কর্পোরেট গণতন্ত্রের কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই বিবর্তনের এক দিকে আছে বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ক্রমাগত কলেবর বৃদ্ধি করা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বিভিন্ন দলের মধ্যে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার একপ্রকার দৃষ্টিকটু বৈষম্য ও অন্য দিকে আছে, এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের আবহে বিশ্বায়ন ও আর্থিকীকরণের পরিপূরক ভূমিকা। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ভারতে ১৯৮০ সালে গবেষণা শেষ করে এক জন মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপকের বেতন ছিল গড়পড়তা মাসে ৫,০০০ টাকা; ওই একই সময়ে কোনও আইআইএম-এর স্নাতক পেতেন মাসে গড়পড়তা ১০,০০০ টাকা। ২০২০ সালে এক জন সহকারী অধ্যাপক পেতেন মাসে প্রায় ৫০,০০০ টাকা; অন্য দিকে এক জন আইআইএম-এর স্নাতক পেতেন মাসে কয়েক লক্ষ টাকা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চিত্র একই রকম। এই ভয়ঙ্কর বেতন-বৈষম্যের ফলে উচ্চ মেধার গবেষণামুখী উচ্চ শিক্ষায় অনাগ্রহ মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিরন্তন বৈশিষ্ট্যকে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক করে তুলল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থাগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টিমুখী যন্ত্রণাদায়ক অথচ অনিশ্চিত গবেষণা-নির্ভর শিক্ষা ও তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জুড়ে থাকা মূল্যবোধ-নির্ভর সমাজব্যবস্থার থেকে চটজলদি মুনাফা সৃষ্টিকারী বাজারমুখী যোগ্যতাকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে থাকল।

অন্য দিকে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার, বিশ্বায়ন ও আর্থিকীকরণের প্রাদুর্ভাবের ফলে মেধাবী সাধারণ পরিবারের যুবক-যুবতীরা চাকরির বাজারে পিছিয়ে যেতে শুরু করল। বেকারত্ব, চাকরির অস্থায়িত্ব, স্বল্প ও অনিয়মিত বেতন ইত্যাদি তাদের হতাশার নিকষ কালো অন্ধকারে ঠেলে দিতে থাকল। সাধারণ মধ্যবিত্তের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা মূল্যবোধ ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্তরায় হয়ে উঠল। মূল্যবোধের অবনমন রাজনীতি ও অপরাধ জগতের মধ্যে মেলবন্ধনকে করতে থাকল সুদৃঢ়। বর্তমানের নৈরাজ্য তারই কুৎসিত কুফল।

বাকি রইল আর্থিকীকরণের সঙ্গে এই বিবর্তনের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা। অতি উচ্চ আয় সম্পন্ন পূর্বতন মধ্যবিত্তের জীবনশৈলীতে এল বিরাট পরিবর্তন। শেয়ার বাজারের বৈচিত্র আজ আকাশছোঁয়া। তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে দিনের যে কোনও সময় পৃথিবীর যে কোনও দেশ থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ শেয়ার, ডেরিভেটিভ, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণ-নির্ভর সিকিয়োরিটির বাজার ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এখন উচ্চ আয় সম্পন্ন মানুষের নেশা ও নিজ নিজ পেশার সঙ্গে অবলীলায় মিশে থাকা একটি দ্বিতীয় পেশা। ক্রমশ তারা আর নিজেদের ঠিক মধ্যবিত্ত পরিচয়ে আবদ্ধ থাকল না। তারা হয়ে উঠল অতি উচ্চ আয় সম্পন্ন পুঁজিপতিদের পরিপূরক এক নতুন শ্রেণি।

অন্য দিকে, সাধারণ মধ্যবিত্তের দিনযাপন প্রাণধারণ হতে থাকল দুর্বিষহ। ঋণের বোঝা, আধুনিক শিক্ষায় আগ্রহ হ্রাস, নিম্ন অনিশ্চিত আয় আর বেকারত্ব তাদের জীবন থেকেও মূল্যবোধকে দূরে ঠেলে দিতে থাকল। পরিচিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি হারিয়ে যেতে থাকল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি)-র সদস্য দেশগুলিতে বৈষম্য, কোণঠাসা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইত্যাদির আঙ্গিকে ঠিক কী ঘটে চলেছে, তার খানিকটা বিশ্বাসযোগ্য বিশ্লেষণ তাদের ২০০৮, ২০১১, ২০১৫, ২০১৮, ২০১৯-এর রিপোর্টে করার চেষ্টা করেছে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত টমাস পিকেটির বহু আলোচিত ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি পুঁজির বিবর্তন ও বৈষম্য নিয়ে বেশ কিছু তথ্য সামনে এনেছে। মূল্যবোধের আলোচনা আজ লুপ্তপ্রায়; সামাজিক ন্যায় ও স্থিতিশীলতা প্রতিযোগিতার বাজারে কোণঠাসা কিছু মানুষের হাহুতাশ। এই বিবর্তনের আরও গভীরে গিয়ে আর্থসামাজিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব তাই উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society Capitalism Economy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy