রজতবাবুর মৃত্যুসংবাদ যখন আমার ফোনে ভেসে উঠল, হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা দৃশ্য— প্রায় পাঁচ দশক আগে মধ্যপ্রদেশে, ট্রেনে ও বাসে আমরা ছাত্রছাত্রীরা তাঁর সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে চলেছি। একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত উনি আমাকে ‘লিড’ করতে বলতেন: ‘আজ খেলা ভাঙার খেলা’।
১৯৭৫ সাল, আমরা তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সেই সময়েই পুরনো ভবনের দোতলায় ১৭ নম্বর সেমিনার রুমটিতে যেন এক ঝলক তরতাজা বাতাস নিয়ে এলেন অধ্যাপক রজত কান্ত রায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পিএইচ ডি করে এসে স্নাতক স্তরের ছাত্রদের সামনে একেবারে অন্য রকমের ক্লাস-লেকচার দিতে শুরু করলেন, সেই সময়ের একেবারে নয়া, হাতে-গরম, আধুনিকতম ইতিহাস-গবেষণার ধারাকে মিশিয়ে নিয়ে। পাণ্ডিত্য ও শিক্ষকতার মধ্যে যে এক অবিচ্ছেদ্য যোগ আছে, এই কথাটিতে তিনি বিশ্বাস করতেন। আমাদের মধ্যে যারা বিচ্ছু, তারা নকল করে দেখাত জ্ঞানগর্ভ লেকচারগুলোর সময় ওঁর উত্তেজিত হস্ত-সঞ্চালন। আমরা কিন্তু ওঁকে ভালবাসতাম, কারণ তিনি আমাদের ওঁর সমকক্ষ মনে করতেন। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা খাজুরাহো-সহ মধ্যপ্রদেশের অনেক ঐতিহাসিক স্থানে শিক্ষা-সফরে গেলাম, রজতবাবু ছিলেন আমাদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে। স্থাপত্য-ইতিহাস নিয়ে তাঁর প্রগাঢ় বৈদগ্ধে তখন অভিভূত হয়েছিলাম। যোধপুর পার্কে ওঁর বাড়ির দরজা ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব সময় খোলা থাকত।
রজতবাবু ওঁর ডক্টরেট স্তরের গবেষণা করেছিলেন জাতীয়তাবাদী ভাবধারার তথাকথিত ‘কেমব্রিজ স্কুল’-এর আবহে। কিন্তু তিনি এই গোষ্ঠীর কিছু উন্নাসিক প্রবণতার যৌক্তিক বিরুদ্ধতা করেছিলেন ‘পলিটিক্যাল চেঞ্জ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ শিরোনামের পথিকৃৎসম প্রবন্ধে। তাঁর প্রথম লেখার মূল বিষয় ছিল ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরের সময়কালে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস। পাশাপাশি রত্নলেখা রায়ের সঙ্গে জোরকলমে লিখেছিলেন ঔপনিবেশিক আমলে কৃষি-ইতিহাস নিয়েও। যুক্তি দিয়ে ভাবার, পুরনো ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শিক্ষা ওঁর থেকেই শিখেছি— সেই মতোই আমি কেমব্রিজে আমার নিজের গবেষণায় কৃষি-সমাজ কাঠামোর একটা বিকল্প বিশ্লেষণ তুলে ধরি। ওঁর প্রিয় ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক সমালোচনাও উনি যে ভাবে খোলামনে গ্রহণ করতেন, তা দেখে বিস্মিত লাগত।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস, দুই পরিসরেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ— বিশেষত শিল্পায়ন ও শিল্পনীতির ইতিহাসের ক্ষেত্রে ওঁর গবেষণা ছিল চোখ খুলে দেওয়ার মতো। দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ভারত মহাসাগরের ও-পারে পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে জুড়েছিল যে বাজার এবং সুদূরবাহী ঋণ ও অর্থব্যবস্থা, তা নিয়ে ওঁর চমৎকার দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে। ওঁকে এ নিয়ে একটা বই লিখতে বলেছিলাম, তবে তিনি তাঁর সহজ ঔদার্যে সে দায়িত্বটি পরের প্রজন্মের ভারত মহাসাগর বিষয়ক ইতিহাসবিদ-গবেষকদের হাতে তুলে দিয়েই খুশি ছিলেন।
তাঁর সুদীর্ঘ, বিশিষ্ট অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারের পরের দিকে তিনি সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাসের গবেষণায় মন দিয়েছিলেন। আবেগগত ইতিহাস ও ‘ফেল্ট কমিউনিটি’ নিয়ে তাঁর লেখালিখির প্রসাদগুণ আমাদের সম্পদ; আধুনিক জাতীয়তাবাদের ধারণা তৈরি হওয়ার আগেও এ দেশে কেমন ভাবে দেশীয় সত্তার ভাবনা, বোধ ও আবেগ তৈরি হয়েছিল, তার ইতিহাস ধরা আছে তাঁর বইতে। একুশ শতকের গোড়ার দিকে এক বার হার্ভার্ডে এসে আমার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর উপাচার্য পদে থাকাটা তাঁর মুকুটে শ্রেষ্ঠ পালক। তবে, আমার শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই শিক্ষা-প্রশাসনের এত গুরুভার বোঝা বহন করছেন, ব্যক্তিগত ভাবে এ নিয়ে আমি খুব একটা উচ্ছ্বসিত ছিলাম না। এক বার তাঁকে দেখেছিলাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তির সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করতে, যেন মহাপুরুষের কাছে দিক্নির্দেশ চাইছেন। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র ধারণা নিয়ে তাঁর আগ্রহ আবারও জেগে ওঠে, জীবনের শেষ দিকে এই বিষয়ে বাংলা ভাষায় লেখালিখিতে তিনি মন দিয়েছিলেন।
আর একটা ক্ষেত্রেও খুব কাছ থেকে ওঁকে দেখেছি। কয়েক দশক ধরে তিনি ছিলেন নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো-র কাউন্সিল-সদস্য। নেতাজি ভবনে আন্তর্জাতিক স্তরের অ্যাকাডেমিক সম্মেলন আয়োজনের ক্ষেত্রে আমি ও আমার মা কৃষ্ণা বসু ওঁর পরামর্শ নিতাম। সে সব সম্মেলনে ওঁর উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য, উজ্জ্বল। ইতিহাসের সেমিনারগুলি সভামুখ্য রূপে পরিচালনা করতেন দক্ষ হাতে।
ভারতের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে এই কিংবদন্তিপ্রতিম পণ্ডিত-অধ্যাপকের প্রয়াণে একটা বিরাট শূন্যতার অনুভব হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা ও ইতিহাস-পাঠের উপরে হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের আক্রমণের মুখে রুখে দাঁড়াতে তিনি ছিলেন সাহসী, সোজাসাপটা। এ ক্ষেত্রে তাঁর উত্তরটি ছিল— সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতাবাদের মধ্যে সেঁধিয়ে না গিয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধিক ঐতিহ্যগুলিকে তাদের পরিপূর্ণ বিস্তারে তুলে ধরা। বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতি সব দিকেই যখন এক অন্ধকারের অবক্ষয় নেমে আসছে, আমার শিক্ষক রজত কান্ত রায় তার মধ্যে যেন একটি প্রদীপ জ্বেলে গিয়েছেন, যার শিখাটি চির অনির্বাণ।
গার্ডিনার প্রফেসর, ওশানিক হিস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাফেয়ারস, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)