E-Paper

ধর্ম বলতে বুঝতেন ধারণ

আমাদের দায়িত্ব মনে রাখা যে, রামমোহন রায় শৈশব থেকে বিভিন্ন ধর্মের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। গ্রামে এক জন মৌলবির কাছে তিনি ফারসি ভাষা শেখেন। পটনায় গিয়ে আরবি ভাষা শেখেন এবং কোরান অধ্যয়ন করেন।

সন্দীপন মিত্র

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:০৭

সম্প্রতি বিজেপি নেতা তথা মধ্যপ্রদেশের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ইন্দর সিংহ পারমার বলেছেন যে, রাজা রামমোহন রায় ব্রিটিশদের দালাল হিসেবে কাজ করতেন এবং বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে গণধর্মান্তরের লক্ষ্যে তিনি একটি দুষ্টচক্র শুরু করেছিলেন। পরে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে ভদ্রলোক ক্ষমা চেয়ে বলেন যে, মন্তব্যটি তিনি অনিচ্ছাকৃত ভাবে করে ফেলেছিলেন।

এখন প্রশ্ন হল, বক্তা ক্ষমা চেয়েছেন বলে কি আমাদের এই ঘটনাটিকে উপেক্ষা করা উচিত? উত্তর হল, না। এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিগত বেশ কিছু বছর যাবৎ, আমরা দেখছি যে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বাংলার বরেণ্য মানুষদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে, তাঁদের অবমাননা করার চেষ্টা করছেন। অভাবনীয় অজ্ঞতা, গভীর ঘৃণা এবং তীব্র শ্রেষ্ঠত্ববোধ থেকে জাত মন্তব্যটি সেই ধারায় নবতম সংযোজন। লাগাতার চলতে থাকা এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। সেই প্রয়াসের প্রথম ধাপ হল আধুনিক ভারতীয় চিন্তাজগৎ নির্মাণে রামমোহন রায়ের ভূমিকা, বিশেষ করে তাঁর ধর্মীয় মতামত এবং তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান স্মরণ করা।

আমাদের দায়িত্ব মনে রাখা যে, রামমোহন রায় শৈশব থেকে বিভিন্ন ধর্মের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। গ্রামে এক জন মৌলবির কাছে তিনি ফারসি ভাষা শেখেন। পটনায় গিয়ে আরবি ভাষা শেখেন এবং কোরান অধ্যয়ন করেন। পটনা থেকে ফিরে বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যয়নের জন্য তিব্বতে যান। কিন্তু লামাদের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে সেখানে তিনি বেশি দিন থাকতে পারেননি। সংস্কৃত ভাষা শিখতে এবং হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করার জন্য তিনি বারাণসী যান।

১৮০৩ সালে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব দফতরে যোগ দেন এবং টমাস উডফোর্ডের দেওয়ান হিসেবে মুর্শিদাবাদে যান। সেখানে থাকাকালীন, ফারসি ভাষায় লেখা, তাঁর প্রথম বই তুহফাত-উল-মুওয়াহিদিন (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার) প্রকাশিত হয়। সেই বইতে তিনি মূর্তিপূজা এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধাচারণ করেন। ১৮০৫ সালে তিনি জন ডিগবির সহকারী রূপে যোগ দেন। ডিগবি সাহেবের কাছে তিনি ইংরেজি শেখেন। কয়েক বছর পর ডিগবি সাহেবের সঙ্গে তিনি রংপুরে যান। সেখানে তিনি হরিহরানন্দ তীর্থস্বামীর কাছে তন্ত্র অধ্যয়ন করেন। পাশাপাশি ‘কল্পসূত্র’ এবং অন্যান্য জৈন ধর্মীয় গ্রন্থও অধ্যয়ন করেন।

১৮১৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি ছেড়ে স্থায়ী ভাবে কলকাতায় বাস করতে শুরু করলে ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আত্মীয় সভার আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সকলে যে তাঁর মতের সঙ্গে একমত হতেন এমনটা নয়, কিন্তু তাঁরা সভার আলোচনা থেকে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে আগ্রহী ছিলেন। বেদ ও উপনিষদের চর্চা বহু কাল কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই চর্চা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য, রামমোহন রায় বেদ ও উপনিষদ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করতে শুরু করেন, যার ফলে বাংলা গদ্যের প্রভূত বিকাশ ঘটে।

কেবল এটাই নয়। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান এবং দর্শনের পাশাপাশি বেদান্ত দর্শনের পাঠ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত কলেজ। তাঁর লক্ষ্য ছিল প্রমাণ করা যে সমস্ত হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গ্রন্থগুলিতে এক নিরাকার দেবতার উপাসনাকে সর্বোচ্চ উপাসনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর বক্তব্য হিন্দু সমাজের গোঁড়া অংশের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সংবাদপত্রে তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হয়। পাণ্ডিত্য এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সমস্ত সমালোচনার উত্তর দেন রামমোহন রায়।

১৮২০ সালে রামমোহন রায় খ্রিস্টান পাদরিদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের উপর লেখা তাঁর বই শ্রীরামপুরের পাদরিদের ক্ষুব্ধ করে। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় পাদরিরা ঈশ্বরের একত্ব সম্পর্কে তাঁর মতকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন। ব্রাহ্মণ সেবধি পত্রিকায় রামমোহন রায় সেই আক্রমণের যোগ্য জবাব দেন। তাঁর উত্তরগুলি থেকে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বে তাঁর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব অনুধাবন করার জন্য তিনি গ্রিক এবং হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। রামমোহন রায়ের লক্ষ্য ছিল সমস্ত ধর্ম অধ্যয়ন করে, সকল ধর্মের সর্বোত্তম শিক্ষা থেকে আরোহিত জ্ঞানের ভিত্তিতে ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাসী একটি সর্বজনীন ধর্মের রূপরেখা তৈরি করা। একাত্মবাদীদের আশা ছিল, তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবেন। রামমোহন রায় ধর্মান্তরিত হননি। কাউকে ধর্মান্তরিত হতেও বলেনি। ১৮২৮ সালে তিনি ধর্মের প্রতি যুক্তিসঙ্গত এবং নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য ‘ব্রাহ্ম সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হয়।

রামমোহন রায়কে আমরা মূলত এক জন সমাজ সংস্কারক হিসেবে মনে রেখেছি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং সতীদাহ নিষিদ্ধকরণে তাঁর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এর বাইরেও তাঁর অনেক অবদান ছিল। রামমোহন রায় ১৯২৩ সালে সরকারি নীতির সমালোচনাকারী ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য সরকার কর্তৃক পাশ করা প্রেস নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরোধিতা করেন। এটি ভারতে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সংগঠিত প্রথম আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ছিল জনগণের মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের একত্রিত হওয়ার প্রথম উদাহরণ। ১৮২৬ সালে রামমোহন রায় জুরি আইনেরও বিরোধিতা করেন। কারণ, ওই আইনে বলা হয় যে খ্রিস্টানরা হিন্দু এবং মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কিত মামলায় জুরি হতে পারবেন, কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমানরা খ্রিস্টানদের সঙ্গে সম্পর্কিত মামলায় জুরি হতে পারবেন না।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হওয়া সত্ত্বেও, রামমোহন রায় কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি কৃষকদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন। বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর কাছে তিনি বিষয়টি বিশদে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মত ছিল যে, জমিদারদের কাছ থেকে সংগৃহীতরাজস্বের পরিমাণ কমানো উচিত যাতে কৃষকদের খাজনার ভার লাঘব হয়। তাঁর প্রস্তাব ছিল, রাজস্ব হ্রাস বিলাসবহুল পণ্যের উপর কর বৃদ্ধি করে এবং উচ্চ বেতনভোগী ইউরোপীয়দের পরিবর্তে প্রশাসনিক পদে ভারতীয়দের নিয়োগ করে পূরণ করা উচিত।

ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বলেছেন যে রামমোহন রায় এমন একটি মুৎসুদ্দি গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যে-গোষ্ঠী ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতিকর দিকগুলির বিরোধিতা করেনি। আমাদের বুঝতে হবে যে একে রামমোহন রায়ের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা বা ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি আনুগত্য হিসাবে দেখা যায় না। তিনি যে সময়ের মানুষ ছিলেন, যখন ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্ণ রূপ উন্মোচিত হয়নি। তাই তাঁর কাছ থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের সামগ্রিক সমালোচনা আশা করা অনুচিত। রামমোহন রায় ব্রিটিশদের সাংবিধানিক ব্যবস্থার সমাদর করতেন, তিনি চাইতেন সেই ব্যবস্থা কর্তৃক নাগরিকদের প্রদত্ত স্বাধীনতা ও অধিকার ভারতীয়রাও পান। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার নিপীড়নমূলক দিকগুলি নিয়ে তিনি সর্বদা সরব ছিলেন, ঠিক যেমন সমস্ত ধর্মের তত্ত্ব শ্রদ্ধার সঙ্গে অধ্যয়ন করা সত্ত্বেও, সেই সব ধর্মের অহিতকর দিকগুলির বিরুদ্ধে তিনি কড়া অবস্থান নিতেন।

আশিস নন্দী বলেছেন উপনিবেশবাদ দুই ধরনের: রাজনৈতিক উপনিবেশবাদ এবং সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ। দ্বিতীয় প্রকারটি অনেক বেশি সূক্ষ্ম, গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। এটি চেষ্টা করে উপনিবেশিত মানুষের মন থেকে তাঁদের নিজেদের মূল্যবোধগুলি মুছে ফেলে, উপনিবেশবাদীদের মূল্যবোধগুলিকে ঢুকিয়ে দিতে, যার ফলে তাঁদের মধ্যে পরিচয়ের সঙ্কট দেখা দেয়। বিজেপি ভালই জানে যে, রাজনৈতিক ভাবে বাংলাকে জয় করার পথে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হল এই রাজ্যের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, যা রামমোহন রায়ের মতো ব্যক্তিদের মুক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তার ফসল। তাই তারা বাংলার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করার জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করে, রামমোহন রায়ের মতো ব্যক্তিদের কাজের ভুল ব্যাখ্যা প্রচার করছে।

এই কাজে সফল হলে, তবেই তারা সক্ষম হবে এই রাজ্যের মানুষের মনে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে, যা তাদের রাজনৈতিক উত্থানের পথ প্রশস্ত করবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Social Reformer Religions BJP

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy