উত্তরবঙ্গের ধস আর বন্যা বুঝিয়ে দিল, কেবলমাত্র কয়েকটা বাঁধ বা ইমারত নয়, ভেঙে পড়েছে গোটা ব্যবস্থাটাই। প্রতি বছরই কোনও না কোনও অঞ্চল ভেসে যায় বন্যায়। বাঁধ ভাঙে, পাহাড়ি পথ জুড়ে নামে ধস। ভিটেছাড়া হন বহু মানুষ। কেবল রাস্তায়, চাষের জমিতেই নয়, তাঁদের মনেও থৈ থৈ করে অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা আর ভয়। শুকনো খাবার, জামাকাপড়, ওষুধপত্র বিলি হয়, কিন্তু মনের মধ্যে যে বিপর্যয়, তার খবর কে রাখে?
খবরে প্রকাশ, নাগরাকাটার বামনডাঙা মডেল ভিলেজ-এর বাসিন্দা ১৭ বছরের রাখি ওরাওঁ থেকে-থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে। আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে গলা-জলে ভাসমান কারও সঙ্গে ধাক্কায় রাখি আর ওর মায়ের হাত ছেড়ে যায়। পরে দু’কিলোমিটার দূরে বাঁশঝাড়ে আটকে থাকা রাখিকে উদ্ধার করা গেলেও, ওর মা বাঁচেননি। রাখির মতো অন্তত পঁচিশ জন নাবালক-নাবালিকা এমন অঘটন-পরবর্তী মানসিক যন্ত্রণা বা ‘ট্রমা’-র শিকার। তাদের কাউন্সেলিং-এর জন্য মনোবিদের ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য দফতর।
উত্তরবঙ্গ যখন ভয়ঙ্কর দুর্যোগের আঘাতে বিধ্বস্ত, সেই সময়েই পালিত হল এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস (১০ অক্টোবর)। যার বিষয়, ‘বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থাকালীন মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রাপ্তির সুযোগ’। যা মনে করিয়ে দেয়, বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিত হওয়ার সমস্যাটি কেবল এ রাজ্যের, এ দেশের নয়। যে কোনও দেশেই কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কিংবা যুদ্ধ, দাঙ্গার মতো বড় মাপের সঙ্কট ঘটলে সরকার এবং অসরকারি সংস্থারা জরুরি ভিত্তিতে পৌঁছে দিতে চান খাদ্য, ব্যবস্থা করেন মাথা গোঁজার স্থানের, জামাকাপড় আর ওষুধের। এগুলোকেই বেঁচে থাকার রসদ বলে মনে করা হয়। মনের কথা ভাবেন ক’জন? ভাঙা বাড়ির মতো, ভাঙা মনকেও মেরামত করতে হয়।
সব বয়স, সব সামাজিক স্তরের মানুষের মধ্যে বড় বিপর্যয় নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ধস বা বন্যা সর্বগ্রাসী এক বিভীষিকা হয়ে দেখা দিতে পারে। প্রাণ হারানোর আতঙ্ক, চিরপরিচিত বাড়ি, পাড়া, খেত ভেসে যেতে দেখলে, নিকটজনকে প্রাণ হারাতে, বা হারিয়ে যেতে দেখলে মনের মধ্যে বিপুল ত্রাস, বেদনা, আক্ষেপ তৈরি হয়। সেই ক্ষতেরও চিকিৎসা প্রয়োজন। না হলে অনেকেই তা বয়ে চলেন বাকি জীবন। তখন তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত, কাজকে প্রভাবিত করে ত্রাসের স্মৃতি। ত্রাণ মানে তাই কেবল ত্রিপল,চিঁড়ে-গুড় নয়। বিপর্যয়ের ঢেউ বয়ে গেলেও মনে রেখে যায় যন্ত্রণা আর দুশ্চিন্তার যে পলিমাটি, তা সরাতে সাহায্য করাও ত্রাণ।
বড় বড় বিপর্যয়ের পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষা দেখিয়েছে এই সঙ্কটের তীব্রতা। লাতুর ভূমিকম্পের (১৯৯৩) পর একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন তাঁদের ৭৪ শতাংশ ভুগছেন ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার’ বা যন্ত্রণা-পরবর্তী মানসিক চাপে, ‘প্যানিক ডিজ়অর্ডার’ বা অতিরিক্ত উদ্বেগে ভুগছেন ২৮ শতাংশ, ‘মেজর ডিপ্রেশন’ বা গুরুতর অবসাদ রয়েছে দশ জনের মধ্যে ন’জনেরই। ওড়িশার সুপার সাইক্লোনের (১৯৯৯) এক বছর পরে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, দশ জনে প্রায় চার জন কোনও না কোনও সমস্যায় আক্রান্ত। এমন দেখা গিয়েছে প্রতিটি বড় দুর্যোগের পরে।
কোচবিহারে বড় ১৮ কোটা গ্রামে এক জন স্বেচ্ছাসেবীকে এক শরণার্থী মহিলা বলেছেন, “আমার ঘর খেয়েছে নদী। আর খেয়েছে আমার ঘুম। এখনও রাত বাড়লে নদীর শব্দে ঘুমোতে পারি না।” ঘুম না-আসা, ঘুম ভেঙে যাওয়া, সর্বক্ষণের আতঙ্ক, এগুলো মনের অসুখের লক্ষণ। বিষাদ, হতাশা, মানসিক জড়তা, অবিশ্বাস, সন্দেহ, এগুলিও। কেউ কেউ একেবারে গুটিয়ে নেন নিজেকে।
ভারতে এখনও এ সঙ্কটের সমাধনের উপযুক্ত নিয়ম-নীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি। ভারতের ‘ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (২০০৫)’ এবং ‘ন্যাশনাল ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনস’-এ ‘সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট’ কথাটা আছে বটে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনও প্রয়োগ নেই। ‘ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রাম’ অনেকটাই শহর-ঘেঁষা, তার তহবিলও অল্প। মনোরোগীর চিকিৎসার বাইরে গিয়ে বিপর্যয়স্তরের সহায়তার সুযোগ সেখানে নেই। বিপর্যয়ের সময় মানসিক যত্ন, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া নিয়ে কোনও পরিকল্পনাই নেই।
সে দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের এ বছরের বিষয়। যা আমাদের প্রণোদিত করে একটি জরুরি প্রশ্ন করতে— দুর্গত আসলে কে? বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কারা? ত্রাণ কী? স্বাস্থ্য মানে যদি হয় মানসিক স্বাস্থ্য তা হলে বিপর্যয়ের সময় মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয় না কেন?
কেবল চিকিৎসক নয়, আমাদের প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের, যাঁরা কাজ করেন জনসমাজে। যে কোনও ত্রাণে উদ্ধারকারী ও সহায়তাকারী দলের সঙ্গে সব সময়ে তাঁদের থাকা প্রয়োজন। বিপর্যয়ের পর এক সপ্তাহের জন্য কাউন্সেলর পাঠালেই হবে না। ত্রাণশিবিরগুলি যেন আর্ত মানুষের কথা শোনার জায়গাও হয়ে ওঠে।
বিপর্যয়ের সময় মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বের বিচারে শেষ সারিতে যেন না পড়ে, ‘সফট ইসু’ বলে উপেক্ষিত না হয়। বিপর্যয় বৈষম্যকে আরও দগদগে করে তোলে। গরিব, দলিত-আদিবাসী, মহিলা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষরা বরাবরই স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে অধিক বঞ্চিত, বিপর্যয়ের সময় তাঁরা একেবারে শেষের সারিতে পড়ে যান। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিলে এই বৈষম্যের ক্ষতও নজরে আসবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে তাই প্রত্যেকটি সমাজকল্যাণমূলক পরিকল্পনার অংশ করে তুলতে হবে। নয়তো বিপর্যয়ের ক্ষত ‘সারিয়ে তোলা’র কাজটি রয়ে যাবে অসম্পূর্ণ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)