১৯৮৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুরন্ত ব্যাটিং কপিল দেব এবং কিরণ মোরের। পর দিন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একটি সংবাদপত্রে লিখেছিলেন, বড়ে মিয়া তো বড়ে মিয়া, ছোটে মিয়া ভি সুবহানাল্লা!
এখনকার দিনে হয়তো খাপ পঞ্চায়েত বসানো হত, কেন নিখাদ দুই হিন্দু-সন্তানের প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি আবার মিয়া-টিয়া আনলেন?
হয়তো কেন বলছি, খাপ পঞ্চায়েত বসতই। যে ভারতে বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই, এমন ভাষ্য সগর্বে লেখা হয়, এবং তা পিঠ চাপড়ানিও পায়, যেখানে মুসলমান মানেই গোমাংস খাওয়ার ‘অপরাধ’-এ পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়, সেখানে হিন্দুসন্তানকে মিয়া বলা? তোবা, তোবা!
মহম্মদ সিরাজ, আপনি লেখাটা মনে করালেন। ৪ অগস্ট, ভারতীয় সময় বিকেলে বার্তা বিভাগ যখন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে দু’হাত তুলে, সমাজমাধ্যমে শুধু আপনার ছবি আর প্রশংসা, অনেকেই মনে করিয়েছেন দ্বিতীয় টেস্টে জয়ের পর আর সকলের নাম উল্লেখ করলেও আপনার নাম ঊহ্য রেখেছিলেন আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ, প্রথম ইনিংসে আপনার ৬ উইকেটের সাফল্য সত্ত্বেও। কেন?
বলার অপেক্ষা রাখে না। জয়ের আগের দিন আপনি ক্যাচ ধরে বাউন্ডারির সীমা পার করেছিলেন, পার পেয়ে শতরান করে ফেলেন হ্যারি ব্রুক। দেখছিলাম আনাচকানাচ থেকে উঠে এসেছে সেই বিষধরেরা, যারা মুসলমান মানেই গদ্দার, জঙ্গি ভাবতে অভ্যস্ত। কেন মহম্মদ সিরাজ, কেন আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে আপনি গদ্দার নন?
আমরা যাঁরা আজ আপনাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত, জবাবদিহি তাঁদেরও করতে হবে যে এই রকম একটা দেশ আমরা তৈরি হতে দিলাম কেন? যেখানে বহু লোক বিশ্বাস করে যে ভারত শুধু হিন্দুদের বাসস্থান। কেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইদের শুভেচ্ছা জানালে তা খবর হয়, আগে তো এই শুভেচ্ছা ছিল সংবাদপত্রের ‘ফিলার’ মাত্র। সব উৎসবে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি শুভেচ্ছা জানাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। আর কে না জানে যা স্বাভাবিক, তা সচরাচর খবর হয় না।
কিন্তু এই দেশে তো আর কিছুই স্বাভাবিক নয়। স্বাভাবিক শুধু ধর্মান্ধের হিংস্র আচরণ।
মহম্মদ সিরাজ, বিরাট কোহলি তাঁর মিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ম্যাচের পরে, যে বিরাট, যে অধিনায়ক বিরাট বুক দিয়ে আগলেছিলেন মহম্মদ শামিকে, তাঁকে নিয়ে ‘ট্রোল’ হওয়ার পর। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন সতীর্থকে অপমানের, যে সাহস দেখাতে পারেনি ভারতীয় বোর্ড।
মহম্মদ সিরাজ, আপনি অনেক কিছু লিখতে বাধ্য করছেন। লিখতে বাধ্য করছেন এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গের কথা, যেখানে এখন বিরোধী দলনেতা চিৎকার করে বলতে পারেন যে কোনও চাচার দোকান থেকে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ হিন্দুরা যেন না খান। মুসলিম-প্রধান রাজ্য তাই হিন্দুরা যেন কাশ্মীরে বেড়াতে না যান। এতটাই ধর্মান্ধতা, এতটাই স্পর্ধা।
আর হ্যাঁ, যে দেশের সংবিধান সর্বধর্মের ভারতকে রক্ষার কথা লিখেছে, সেখানে সংবিধান-বিরোধী কথা বলেও পার পাওয়া যায় ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গে।
আসলে এই লেখাটা সে দিনই লিখব ভেবেছিলাম, যে দিন পহেলগামে নিহতের শিশুপুত্রকে নিয়ে লোফালুফি খেলছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা।
ধর্ম, ধর্ম, ধর্ম। মুসলমান, মুসলমান, মুসলমান। এই ছাড়া গীত নেই ভোটের পশ্চিমবঙ্গে।
পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, ভয় পেলেন নাকি? নেতাদের নাম নিচ্ছেন না? আজ্ঞে না। এই লেখাটায় এক জনেরই নাম থাকবে। মহম্মদ সিরাজ, আপনার।
আসলে পুরো লেখাটাই একটা ভণ্ডামি, জানেন। পুরো লেখাটাই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মর্মবাণীর অবমাননা। কেন লিখতে হবে বলুন তো? মহম্মদ সিরাজ ভারতীয় ক্রিকেটার, ভারতের টিমের এক জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁর বোলিংয়ের গুণে, তাঁর ধর্ম এখানে ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। এক কালে মহম্মদ আজহারউদ্দিন ভারতের ক্রিকেটপ্রেমী জনতার চোখের মণি ছিলেন। সেটাই তো স্বাভাবিক।
আর এখন? যে কারণে মুসলমানরা ইদের নমাজ পড়তে যান ভারতের জাতীয় পতাকা কাঁধে নিয়ে, সেই একই কারণে মহম্মদ শামি, মহম্মদ সিরাজকে বার বার প্রমাণ করতে হয় তাঁরা গদ্দার নন, সাচ্চা দেশপ্রেমিকের মতো তাঁরা বার বার দেশকে জেতাবেন বা বাঁচাবেন পরাজয় থেকে। অন্য দিকে, তাঁদের একটি ভুলও ক্ষমার অযোগ্য।
কারণ, ভারতের মুসলমানদের প্রমাণ করতে হচ্ছে তাঁরা দেশপ্রেমিক। কারণ, পশ্চিমবঙ্গেরই দুর্গাপুরে গরু পাচারকারী সন্দেহে বৃদ্ধ মুসলমানদের দড়ি দিয়ে বেঁধে শাসানো হয়, মারধর করা হয়। আর সেই বৃদ্ধেরা কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে বলছিলেন তাঁরা আর এমন কাজ করবেন না।
নাহ্, দৃশ্যটা দেখে আমাদের বুক কাঁপেনি, লজ্জা বোধ হয়নি। নিশ্চয় হয়নি। লজ্জা হলে, অপমানবোধ হলে আমরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতাম। আমরা, নাগরিকরা হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতাম।
ভারত যে হিন্দুদের দেশ, এখানে অন্য ধর্মের মানুষদের তো দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে— এই ধারণাটা আমরা বদ্ধমূল হতে দিচ্ছি। রাজনৈতিক দলের নেতারা কথা ছোড়াছুড়ি করে চলেছেন আর আমরা ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকেরা সমাজমাধ্যমে সামান্য স্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে নিজেদের পিঠ নিজেরা চাপড়াচ্ছি।
এটুকু স্পষ্ট করে, জোর গলায় বুক ঠুকে বলার সাহস কারও নেই যে এটা ভারত, এই দেশ সবার সব ধর্মের। কারও মৌরসিপাট্টা নয়। তার অন্যথা ঘটলে দেশের আইন অনুসারে শাস্তি পেতে হবে। যাঁদের হাতে দেশের আইন, তাঁরা তো রাজধর্ম নয়, তাঁরা ধর্মের রাজনীতি করেন। ফলে মুসলমান মরলে, ধর্ষিত হলে, খ্রিস্টানকে পুড়িয়ে মারা হলে কারও কিছু আসে যায় না।
মহম্মদ সিরাজ, আজ আমরা পলাশির যুদ্ধ, সিরাজউদ্দৌলা ইত্যাদি নানা কথা বলছি, আপনাকে কাল গদ্দার বলতে আমাদের বাধবে না। এতটুকুও বাধবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)