জুতিয়ে খাল খেঁচে দিতে চাইছেন ঋত্বিক ঘটক। তাঁদের, রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা ছোট করতে চান। এক সাক্ষাৎকারে কথাবলতে বলতে এমন মারাত্মক ইচ্ছেটা যে প্রসঙ্গে হল, সেটা রবীন্দ্র গুপ্তের একটা লেখা। এ নামের আড়ালে ছিলেন বামপন্থী নেতা ভবানী সেন। কমিউনিস্ট পার্টির বেআইনি যুগে ভবানী সেন-সম্পাদিত তাত্ত্বিক পত্রিকা মার্কসবাদী-র চতুর্থ সঙ্কলনে ‘বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা’ নামে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়। পরিচয় পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী এবং সে কালের নামী লেখকেরা তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন তার। সেই প্রতিবাদের উত্তরেই ওই লেখা, মার্কসবাদী-র পঞ্চম সঙ্কলনে।
প্রশ্নটা ছিল, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এখনও কী পেতে পারেন? ঋত্বিকের উত্তর, “সব-কিছু। রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রগুপ্ত নাম দিয়ে... আমাদের একটা কমরেড ‘মার্কসবাদী’ মাসিকে... রবীন্দ্রনাথকে ডিক্রাই করা—। ওটা হচ্ছে বি. টি. রণদিভের পিরিয়ডে। আমাদেরকে, প্রত্যেক পার্টি কমরেডকে বারণ করে দিয়েছিল... এবং যাচ্ছেতাই গালাগাল রবীন্দ্রনাথকে যে, বুর্জোয়া... দিস অ্যান্ড দ্যাট। সেদিন আমি একটি মেয়েকে পড়াতুম, শোভা সেনের ছোট বোন ইলা। মানে ও আই. এ. পড়ত, আমি টিচারি করতুম। ইলার কাছে আমি বলতে গেছি এই রবীন্দ্রগুপ্তের নাম্বার ফাইভ ‘মার্কসবাদী’। মেয়েটা ক্ষেপে বোম হয়ে গেল। রবিবাবু আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে আছেন। রবিবাবু ছাড়া কোনো দিকে যাওয়া যায় না... এই (যে) মেয়েটা একেবারে ক্ষেপে বোম হয়ে গেল মানে দ্যাট ইজ দি রিঅ্যাকশন।”
বিরোধিতার এই ভাষা ঋত্বিকের তীব্র আবেগ থেকেই। তা ভক্তি বা প্রেমে অন্ধ ছিল না। রবীন্দ্রভক্তদের তোয়াক্কা না করে সাফ বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস লিখতে জানতেন না: “রবিবাবুর প্রায় প্রত্যেকটা উপন্যাসই তো ন্যাকা-ন্যাকা উপন্যাস, মানে অত্যন্ত বাজে ক্লাসের, ভদ্রলোক তো উপন্যাস লিখতে জানতেন না। হ্যাঁ, কিন্তু ওই চতুরঙ্গটা একটা ফাটিয়েছিলেন।” জীবনে ওই একটিমাত্র ‘ফাটানো’ রবীন্দ্র-উপন্যাস অবলম্বনেই সিনেমা করতে চেয়েছিলেন ঋত্বিক, হয়ে ওঠেনি। চিত্রনাট্য লেখা হয়ে গিয়েছিল।
সত্যজিৎ রায়ের হয়ে ওঠার সময়টায় বেশ খানিকটা ছিল শান্তিনিকেতন, তাঁর সিনেমা-জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রবল, প্রত্যক্ষ উপস্থিতি। দেশের বেড়া-টপকানো যে মানবতা বাঙালির চিন্তায় রবীন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয়, সত্যজিতেও তার পরিচয়। ঋত্বিক কিন্তু তাঁর হয়ে ওঠার আদিপর্বে রাজনৈতিক মতাদর্শ-প্রভাবিত যে গণনাট্য সঙ্ঘে ছিলেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের স্থান বড় একটা ছিল না। তাঁর সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সম্পর্ক জীবনের শেষ পর্বে, রামকিঙ্কর বেজকে নিয়ে তথ্যচিত্র করার সময়। সেই সম্পর্কও শান্তিনিকেতনের চেনা ছবির বিপরীত: “দুজনে মিলে আমরা যে-সমস্ত মাতলামি করে বেড়িয়েছি এবং যেভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে-পড়তে পালিয়েছি, এগুলো লেখার খুব দরকার নেই।”
তবু, রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে পুনরাবিষ্কারের প্রয়োজন ঋত্বিকের হয়নি। তাঁর সিনেমার চরিত্রেরা চরম সঙ্কটে, তুঙ্গ আনন্দে রবীন্দ্রনাথের গান গায়। কিন্তু সেই টুকরো ব্যবহারই ঋত্বিকের রবীন্দ্রনাথ নন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন-সত্যেরই সমগ্র। তাঁরই পথ ধরে তিনি আগে সত্যনিষ্ঠ, পরে সৌন্দর্যনিষ্ঠ। ছবি তৈরির মুখ্য উদ্দেশ্য কী সে প্রশ্নে তাঁর উত্তর, “মানুষের ভাল করা। মানুষের ভাল না করতে পারলে কোনো শিল্পই শিল্প হয়ে দাঁড়ায় না। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন যে, শিল্পকে সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, তারপরে সৌন্দর্যনিষ্ঠ। এই সত্য মানুষের নিজস্ব ধ্যানধারণা থেকে আসে। কারণ, সত্য কোনো সময়েই শাশ্বত নয়... প্রত্যেককে নিজস্ব সত্য জীবনের গভীরতা দিয়ে অর্জন করতে হয়।”
সারা জীবন বার বার রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন অভিনয় করেন ঋত্বিক। আঠারো বছর বয়সে ঝাড়খণ্ডের কোলিয়ারি অঞ্চলেও নটীর পূজা-র মঞ্চাভিনয় করেন হিন্দিতে। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে চূড়ান্ত বিধ্বস্ত মানুষটির অবলম্বনও রবীন্দ্রনাথ। কুমার রায়ের স্মৃতি: “১৯৭২-৭৩ সালে দেখা হল অ্যাকাডেমিতে। পরপর বহুরূপীর দুটি নাটক দেখতে এল— ‘বাকি ইতিহাস’ এবং ‘ডাকঘর’।... সাজঘরে অভিনয় শেষে শম্ভুদার সঙ্গে... ওর দেখা হল... অনেক কথার মধ্যে শিল্পীর জীবন নিয়ে, শৃঙ্খলা ও শৃঙ্খলাহীন জীবন নিয়ে কথা উঠতেই শম্ভুদা ঋত্বিককে বেশ তিরস্কারের ভঙ্গিতেই বলেছিলেন, ‘ভুলে যাচ্ছ কেন, আমাদের সামনে রবীন্দ্রনাথ আছেন।’ কথাটা সেদিন সে মেনে নিয়েছিল। ওইরকম সময়েই একদিন সকালবেলায় পাম অ্যাভেনিউতে বাহাদুর খাঁর বাড়ির সামনে দেখা... আবারও সেই নাটকের হাতছানি— নইলে বলবে কেন ‘চল আবার বিসর্জন নাটকটা করি— তুই জয়সিংহ আর আমি রঘুপতি।’”
কী ব্যক্তিগত জীবনে, কী চার পাশের ইতর হয়ে আসা সমাজে আমৃত্যু যে নৈরাশ্যবাদী হয়ে পড়েননি ঋত্বিক, তারও একটা প্রধান জোর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজেই বলেছেন তাঁর সেই চূড়ান্ত নিজস্ব, মারকাটারি ভঙ্গিতে, “তাঁর মরার সময় শেষ যে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ ওটা আপনারা পড়ুন তাহলেই বুঝতে পারবেন যে... যদি কেউ বাঁদরামি করে সে বাঁদরামিগুলোর কোনো মূল্য নেই। শেষ অব্দি একটি কথাই... আমার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে যে, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। কাজেই আমি বিশ্বাস হারাব না। অর্থাৎ বিশ্বেস হারানোর সমস্ত সুযোগ ঘটে গেছে। কিন্তু ইট ইজ আ ক্রাইম, তাই আমি বিশ্বেস হারাব না।”
অবিশ্বাসীকে চুপ করিয়ে রবীন্দ্রনাথ কি তবে ছিল তাঁর রাজার চিঠি!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)