E-Paper

না, কেবল চৌকিদারি নয়

নবান্নের প্রস্তাবগুচ্ছ বার বার পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলছে— কর্মস্থলে আলো থাকবে, অ্যাম্বুল্যান্স থাকবে, প্রশিক্ষিত রক্ষী থাকবেন, পুরুষ সহকর্মীরা মেয়েদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন জানবেন।

রত্নাবলী রায়

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২৫ ০৬:২৮

রাতের শিফ্‌টে কর্মরত নারীদের সুরক্ষার কী কী ব্যবস্থা রাখতে হবে, সে বিষয়ে একগুচ্ছ নির্দেশিকা তৈরি করেছে নবান্ন। এই খসড়া প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে, পরামর্শের জন্য। খসড়া প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে, যে সব কর্মক্ষেত্রে মহিলারা রাতে কাজ করবেন, সেখানে থাকতে হবে সিসিটিভি, মহিলা নিরাপত্তারক্ষী, অ্যাম্বুল্যান্স, চিকিৎসার ব্যবস্থা, বিশ্রাম কক্ষ। রাতের শিফ্‌টে এক-তৃতীয়াংশ মহিলাকর্মী রাখাও নাকি বাধ্যতামূলক হবে। এই সব নির্দেশিকা সরকারি এবং বেসরকারি, দু’ধরনের কর্মক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রয়োগ হবে কি না, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া এই নির্দেশিকা সর্বত্র যথাযথ ভাবে পালিত হবে কি না, তা দেখার দায়িত্ব কার? নির্দেশের অন্যথা হলে জবাবদিহি কারা করবে?

এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। নারী-কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে সরকারি স্তরে যে একটি আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে, সেটা ভাল। কিন্তু প্রশ্ন হল, সরকার-প্রস্তাবিত এই ‘সুরক্ষাকবচ’ কি আদতে নারীর ক্ষমতায়নের পথ খুলে দিচ্ছে? না কি মেয়েদের শরীরকে ‘রক্ষণীয়’ বস্তু বলে পেশ করছে সবার কাছে? এই বিজ্ঞপ্তির ভাষা এবং কাঠামোতেই লুকিয়ে আছে সমস্যা। রাতে কাজ করলে সুরক্ষা দিতে হবে, এই ঘোষণা করা, এবং তার পর সুরক্ষার জন্য বিস্তারিত বন্দোবস্তের প্রস্তাব পেশ করা, এতে যেন ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে, মেয়েদের রাতে কাজ করা ‘স্বাভাবিক’ নয়। কাজের সময় অনুসারে নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা করার চেয়ে, যে কোনও সময়, যে কোনও ধরনের কাজের পরিবেশ মেয়েদের জন্য নিরাপদ হওয়া জরুরি— এই মৌলিক দর্শনটা নির্দেশিকায় অনুপস্থিত।

আর একটা প্রশ্ন ওঠেনি। ‘নিরাপত্তা’ বলতে মেয়েরা কী বোঝেন? চুমকি দাস একটা সরকারি হাসপাতালে কর্মরত আয়া। তাঁর কথায়, “আমি চাই না কেউ আমাকে পাহারা দিক। আমি চাই, যখন রাতের বেলা ডিউটি করে ফিরি, তখন রাস্তায় কেউ টিপ্পনী না কেটে বলে, ‘এত রাতে একটা মেয়ে কোথা থেকে আসছে?’” নানা পেশায় কর্মরত মেয়েরা বার বার বলেন যে, কর্মক্ষেত্রে হয়রানির মতো, রাস্তায়, নিজের পাড়ায়, যে সব কথা শুনতে হয়, তা তাঁদের বিধ্বস্ত, আহত করে। নিরাপত্তার ধারণা যতখানি বাহ্যিক, ততখানিই সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। হয়রানি, নির্যাতনের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। অসম্মানের সঙ্গে লড়াই করাও সহজ নয়।

নবান্নের প্রস্তাবগুচ্ছ বার বার পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলছে— কর্মস্থলে আলো থাকবে, অ্যাম্বুল্যান্স থাকবে, প্রশিক্ষিত রক্ষী থাকবেন, পুরুষ সহকর্মীরা মেয়েদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন জানবেন। অথচ, নারী-কর্মীদের কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, পেশাগত সম্মানের সুরক্ষার বিষয়টি কোথাও উল্লিখিত নেই। বরং তাঁদের গতিবিধি, কাজের শর্তের উপর নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণের নানা সুপারিশ দেখা যাচ্ছে। আর এই ‘রাতপাহারা’-র চৌকিদার যারা, তারাই বা কতখানি নিরাপদ? অ্যাপ ক্যাব চালক শাহিন বেগম বলছেন, “সরকার বলছে সিকিয়োরিটি দেবে। কিন্তু আমি যখন কাস্টমার ছেড়ে ফিরি মধ্যরাতে, রাস্তার মোড়ে পুলিশ আমাকেই প্রশ্ন করে, ‘তুই কী করিস? এত রাতে বাইরে কেন?’ এই তো আমাদের নিরাপত্তা!”

বাস্তব কিন্তু এটাই। ‘সুরক্ষা’ কেবলই কিছু যন্ত্রের ব্যবহার, আর যান্ত্রিক ভাবে কিছু বিধিপালনের বিষয় নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে যখন নারী নিজেই সন্দেহের বস্তু, তখন কোনও সরকারি নির্দেশনামাই মেয়েদের নিরাপদ রাখতে পারে না। বস্তুত নবান্নের খসড়া নীতি মেয়েদের জন্য বিশেষ ‘রক্ষাকবচ’-এর প্রয়োজনের ধারণাকেই পুনরুজ্জীবিত করছে। এই সব নির্দেশ যেন মেয়েদের রাতে কাজ করাকে এক বিশেষ ‘ঝুঁকি’ বলে ধরেই নিচ্ছে। অথচ, মেয়েদের সুরক্ষিত রাখতে হলে পুরুষ-কর্মীদের আচরণেও যে বদল আনা জরুরি, তা কোথাও বলা হল না।

মেয়েদের ‘বিশেষ’ নিরাপত্তার উপর জোর দিয়ে নারী-পুরুষ অসাম্যকে ফের দাগিয়ে দিল এই নির্দেশ। কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায়, পরিবহণে নিরাপত্তা যে নারীর বিশেষ চাহিদা নয়, যে কোনও নাগরিকের তা অধিকার, মেয়েরাও পুরুষদের মতোই নাগরিক, সেটা বলা হল কী? না কি মেয়েদের কাজ, গতিবিধি, পেশাগত অবস্থানকে ‘অস্বাভাবিক’, ‘ব্যতিক্রমী’, ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে তুলে ধরা হল?

সুরক্ষার পরিকাঠামো অবশ্যই দরকার, কিন্তু কোনও সুরক্ষা-গণ্ডির মধ্যে মেয়েদের আটকে রাখতে চাইলে তার ফল হয় বিপরীত। কারণ শেষ পর্যন্ত কাজের স্বাধীনতা মানে শুধু চাকরি করা নয়, একটি মেয়ের সমাজের চোখে এক জন পূর্ণ নাগরিক হয়ে ওঠা। সেই সমাজ গড়ার দায় সরকার ও রাষ্ট্রের যেমন, তেমনই প্রতিটি নাগরিকেরও।

নবান্নের প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চাৎপদ। নারীদের নিরাপত্তা অবশ্যই চাই, কিন্তু একই সঙ্গে চাই সমতা। কোন জায়গা, কোন সময় মেয়েদের জন্য নিরাপদ, সেটা দাগিয়ে দেওয়া সরকার বা পরিবারের কাজ নয়। এই মানসিকতা থেকেই পরিবার, সমাজ মনে করে, মেয়েদের বলা যায় তাঁরা কী পরবেন, কার সঙ্গে ঘুরবেন, কার পাশে শোবেন। আজ আমাদের দরকার এমন নীতি যা মেয়েদের কাজের জন্য সর্বত্রবিস্তৃত সুরক্ষাবলয় তৈরি করবে। মেয়েরা দিনে বা রাতে স্বেচ্ছায় কাজের সিদ্ধান্ত নেবেন, কর্মক্ষেত্র বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন, সমাজের দৃষ্টিতে হবেন স্বাধীন নাগরিক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Security Safety

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy