পঞ্চাশে পড়ল সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য। তাঁর যে কোনও ছবির অর্ধশতাব্দী পেরোনো তো বাঙালির কাছে আনন্দময় উদ্যাপন, কিন্তু এ ছবির ক্ষেত্রে যেন একটু বিষাদেরও ছায়া লেগে। যে ছায়া ঘনাচ্ছিল সত্তর দশকের কলকাতায়, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালির ইতিহাসের এক ভাঙনকাল ছুঁয়েছিলেন সত্যজিৎ, এমনই এক পরিবারের অন্দরে এক সন্ধ্যায় রেডিয়োতে বাজিয়েছিলেন ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা যেমন সরাসরি ঢুকে পড়েছিল অপুর গল্পে, এই রবীন্দ্রগানের সঙ্গে জন অরণ্য ছবির সোমনাথের জীবনের তেমন যোগ নেই। তবু সে গান একটা তীব্র জ্বালার মতো ছুঁয়ে থাকে পরিবারটিকে।
এখানে আছেন বয়স হলেও বুড়ো-না-হওয়া এক পিতা, যিনি সব জানতে, বুঝতে চান। আছেন সরলমনা বৌদি। আছেন প্রতিষ্ঠিত দাদা, যিনি একটু একটু করে ঘুণ ধরতে থাকা ‘সিস্টেম’টাকে মেনে নিয়েছেন। আর আছে যুবক সোমনাথ, যে হাতের লেখার জন্য অনার্স পায় না, চাঁদের ওজন জানে না বলে চাকরি পায় না। তবু তারও আছে আশাবাদ, হাসিমুখে সে অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ করে। কিন্তু এক দিন যখন জানতে পারে, অর্ডার পেতে তাকে নারীসঙ্গ জোগাতে হবে ক্লায়েন্ট কোম্পানির অফিসারকে, সে দিন বুঝতে পারে সে ঢুকে পড়েছে অরণ্যের মধ্যে, ফেরার পথ আছে কি না তার জানা নেই। সে দিন লোডশেডিং হয়, বাড়ি ফিরে অন্ধকারে বসে থাকে সোমনাথ। পর্দা জুড়ে সেই অন্ধকার আমাদেরও যেন টেনে নিতে চায়। বিষণ্ণ, ক্লান্ত, বৃদ্ধ বাবা শুনছেন গান, ‘ছায়া ঘনাইছে...’। বৌদিকে সোমনাথকে বলে, তার কাজটা খুব বাজে, ‘অর্ডার সাপ্লাই’-এর একটা বাংলা নাম আছে, ‘দালালি’।
ছবির শুরুতে সোমনাথ ছিল আলাদা। পরীক্ষার হল-এ যে গণটোকাটুকি করা জনতার মাঝে একা, যে সততার সঙ্গে পরীক্ষা দিতে চায়। আর ছবির শেষ দিকে সে ঢুকতে চলেছে জন-অরণ্যে, যেখানে সে গড্ডলিকারই অংশ। কিন্তু সে ঢুকতে চাইছে না, সেটাই তার যন্ত্রণা। তার মধ্যে তখনও সেই ‘মোরাল ফাইবার’টা আছে, যেটা আর নেই বলে ঘোষণা করে দিয়েছিল করুণার স্থূলকায় স্বামী। চা বাগানের ম্যানেজার তিনি, বিবেককে মদে ডুবিয়ে এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গেও বসে চা খেতে যাঁর অহমিকায় লাগে। তিনি ছিলেন সত্যজিতের দশ বছর আগের ছবি কাপুরুষ-এ। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প ‘জনৈক কাপুরুষের কাহিনী’ থেকে তৈরি তা, গল্পটা স্বাধীনতার বছর দশ আগে লেখা। সেখানে এই নৈতিকতার নামগন্ধও নেই, সত্যজিতের ছবিতে আছে। স্বাধীনতার বহু পরে বাঙালি সমাজে এক চোরা পরিবর্তন লক্ষ করছেন সত্যজিৎ, তাই গল্পটা বদলে নিচ্ছেন। সত্যজিতের আগের নায়কেরা সৎ, আদর্শবাদী; কাপুরুষ-এ এসে সে সংশয়ান্বিত, পলায়নপর। বিচ্ছিন্নতা তার প্রধান অসুখ।
এই বিচ্ছিন্নতা, আমি-সর্বস্বতা চূড়ান্ত হয়ে ওঠে সত্তর দশকে তাঁর কলকাতা ট্রিলজি-র প্রথম দু’টিতে, প্রতিদ্বন্দ্বী ও সীমাবদ্ধ। নগরমুখী যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল সর্বজয়া ও অপুর মধ্যে, তারই চূড়ান্ত সম্প্রসারণ যেন জন অরণ্য-র সোমনাথ ও তার বাবার দূরত্ব। সোমনাথের বাবা পুরনো মানবিকবাদী মূল্যবোধের মানুষ, যার সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব তৈরি হচ্ছে নতুন সংশয়ী সোমনাথদের।
মূল্যবোধের এই সঙ্কটের শুরু মূলত ষাটের দশকে, বাংলায় কমিউনিজ়ম যখন ক্রমশ তার আদি বিশুদ্ধ চেহারাটি হারিয়ে ফেলতে থাকে। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণিও তখন পরিবর্তিত হচ্ছে ভিতরে ভিতরে, তার উদার মানবিকতা আবছা হচ্ছে সমাজ-রাজনীতির কুয়াশায়। এই পরিবর্তন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি সত্যজিৎ।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার ছেলেখেলায় সোমনাথের চাকরি হয়নি, কিন্তু সে ক্ষতি তার গায়ে লাগেনি। সে দিব্য অর্ডার সাপ্লায়ের ব্যবসা করছিল। কিন্তু অর্ডার ধরতে যখন ক্লায়েন্টের কাছে বন্ধুর বোনকে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠল, তখন সে বুঝল তার কাজটা দালালির। তাই শঙ্খ ঘোষও লেখেন, “সত্যজিৎ রায়ের জন-অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসি মাথা নিচু করে। ভয় হয়, আমাদের তিনি এবার দেখে ফেলেছেন পুরোপুরি।”
পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের আজকের দিনও তো ছায়াময়। আমাদের সমস্ত বারুদ আজ দেশলাই কাঠির মুন্ডিতে জমা, মোমবাতির আগুন থেকে যে বারুদ আগুন নিয়ে জ্বালায় সোমনাথের সিগারেট। আজকের জন-অরণ্যে মিশে আছে সেই দুই বেকার বন্ধু, শংকরের জন-অরণ্য প্রকাশিত হওয়ার পর দিন যারা দেখা করতে এসেছিল তাঁর সঙ্গে: “ছেলে দুটি বললো, ‘আমরা দুই বেকার বন্ধু— অনেকটা আপনার সোমনাথ ও সুকুমারের মতন। আমরা আপনার কাছ থেকে সুধন্যবাবুর জামাই— যিনি কানাডায় থাকেন— তাঁর ঠিকানা নিতে এসেছি। এদেশে তো কিছু হবে না, বিদেশে পালিয়ে গিয়ে দেখি।” সুধন্যবাবু এবং তাঁর কানাডাবাসী জামাই নিতান্তই কাল্পনিক চরিত্র— কিন্তু ছেলে দুটো আমাকে বিশ্বাস করলো না।... বিষণ্ণ বদনে বিদায় নেবার আগে তারা সজল চোখে বললো, ‘জন-অরণ্য উপন্যাসের একটা লাইনও যে বানানো নয় তা বোঝবার মতো বিদ্যে আমাদেরও আছে শংকরবাবু। আপনি সুধন্যবাবুর জামাইয়ের ঠিকানা দেবেন না তাই বলুন।’”
সেই ছায়া আজও ঘনিয়ে আছে, জনারণ্যে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)