সচ্ছল পরিবারের গৃহবধূ অজন্তার গৃহসহায়িকা ঝর্না। মেয়েটি অজন্তারই সমবয়সি, রান্নার হাত চমৎকার, কথাও বলেন বেশ গুছিয়ে। এক দিন কথায় কথায় ঝর্না বলে ফেলেছিলেন ব্যক্তিগত কিছু সুখ-দুঃখের কথা। বাড়িতে তাঁর ছোট্ট মেয়েটা একাই থাকে সারা দিন, প্রতিবেশীরা পালা করে খেয়াল রাখেন। তিনটে বাড়িতে কাজ সেরে ঝর্নার বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্বামী মনোজ কাজ করেন কেরলে, বছরে দু’বার আসেন। আরও একটা সন্তানের ইচ্ছে ঝর্নার, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। শুনতে শুনতে অজন্তা নিজেদের কথা ভাবেন। তাঁর স্বামী সোমনাথ তো সন্তান নিতেই রাজি ছিলেন না। অজন্তাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন যে, পৃথিবীটা ক্রমশ আরও কঠিন জায়গা হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ, দাঙ্গা, জলবায়ু পরিবর্তন— কী দরকার জেনেবুঝে আর একটা মানুষকে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে আসার? অনেক টালবাহানার পরে, বিয়ের প্রায় চার বছর পর অজন্তার কোলে এসেছিল তুতুন। আর একটি সন্তানের স্বপ্ন দেখা? ম্লান হেসে অজন্তা স্নানে ঢুকে যান।
ঝর্না, অজন্তারা ব্যতিক্রম নন, বরং তাঁদের মতো মানুষদেরই এ বারে কেন্দ্রে রেখেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউএনএফপিএ-র স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৫। বিশ্ব-জনসংখ্যা বিষয়ক এই প্রতিবেদনটি ১৯৭৮ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। গত কয়েক দশক ধরে জনসংখ্যার আলোচনা দু’টি বিপরীত বিন্দুর মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। কখনও তুলে ধরা হয়েছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের আতঙ্ক— এই বুঝি ফুরিয়ে এল শস্য, জল, অরণ্য, সব প্রাকৃতিক সম্পদ; আবার কখনও তার ঠিক উল্টোটা— ধনী দেশগুলিতে মানুষ বিয়েতে অনাগ্রহী, সন্তানের জন্ম দিতে নারাজ, বৃদ্ধদের তুলনায় তরুণদের সংখ্যা কমছে। কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমলে অর্থনীতির পতন অনিবার্য।
এই দু’মুখো সতর্কবার্তা থেকে সরে এসেছে এ বারের রিপোর্ট। বিশ্বের চোদ্দোটি দেশে নানা বয়সের চোদ্দো হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করে তুলে ধরেছে এক অন্য রকমের ছবি— অগণিত মানুষের মধ্যে ইচ্ছামতো পরিবার গঠন করতে না পারার অক্ষমতার আক্ষেপ।
অজন্তা, ঝর্নাদের মতো আরও অনেকের না বলা আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাঁদের বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্ব। সন্তানধারণ, পরিবার পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে এই ‘স্বাধিকারের সঙ্কট’ যে কয়েক জন ব্যক্তির সমস্যা নয়, তা যে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে-পড়া এক সঙ্কট— এই তথ্য ধরা পড়েছে এই প্রতিবেদনের পাতায় পাতায়।
একটু খেয়াল করলে এ দেশের আনাচেকানাচে এই সঙ্কটের প্রতিধ্বনি শোনা যেতে পারে। হালফিলে বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যে জন্মহারের গতি শ্লথ হয়েছে। মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) নেমে গিয়েছে প্রতিস্থাপন মাত্রা (রিপ্লেসমেন্ট লেভেল)-র নীচে। যার অর্থ, জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে যত সন্তানের জন্ম দেওয়া দরকার, তত সন্তান জন্মাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের অনেক রাজ্যেই প্রজনন হারের এই নিম্নগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রশাসনিক মহলে সাধারণত একে পরিবার পরিকল্পনার সাফল্য হিসাবে দেখা হয়। ইউএনএফপিএ-র প্রতিবেদনটি কিন্তু আমাদের আরও গভীরে ভাবতে বাধ্য করছে। এই পরিবর্তনগুলো কি সত্যিই স্বাধীন ও সচেতন সিদ্ধান্তের প্রতিফলন, না কি এগুলো নানা ধরনের জটিল চাপের কাছে নতিস্বীকার? পরিবার সম্পূর্ণ হওয়ার সন্তুষ্টি, না কি অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার আক্ষেপ?
ইউএনএফপিএ-র গবেষণা দেখাচ্ছে যে, কেবল ভারত নয়, মেক্সিকো, ব্রাজ়িল, তাইল্যান্ড, জার্মানি, মরক্কো, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, নাইজিরিয়ার মতো দেশেও বহু মানুষ তাঁদের প্রজনন-বিষয়ক নানা ইচ্ছা পূরণ করতে পারছেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার আফসোস যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে কম সন্তান হওয়ার কষ্ট। আবার রয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার হতাশা, দুশ্চিন্তাও। সমীক্ষার বিশ্লেষকদের মতে, এই অদ্ভুত মিশ্র অবস্থার কারণগুলো মোটামুটি পরিচিত— অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, লিঙ্গবৈষম্য, জীবনসঙ্গী এবং সমাজের অসহযোগিতা, নিম্নমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা। এই সব কিছু মিলিয়ে প্রায়ই ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গভীর হতাশা তৈরি হচ্ছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি, শিক্ষার প্রসার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এত সবের মধ্যেও নিজেদের ইচ্ছা-পছন্দ অনুযায়ী সন্তানধারণ করতে না পারার ব্যর্থতা রয়ে যাচ্ছে। যা অগণিত জীবনে বাহ্যিক সার্থকতার পাশাপাশি অন্তরের অপূর্ণতার দিকে ইঙ্গিত করছে।
এই প্রতিবেদনই আবার তুলে ধরেছে তিন প্রজন্মের নারীর কথা, যা এক পরিবর্তনশীল ধারাবাহিকতার আখ্যান। ১৯৩০-এর দশকে জন্মানো সরস্বতী দেবীর বিয়ে হয় ষোলো বছর বয়সে, ত্রিশ বছরের মধ্যে জন্ম নেয় তাঁর পাঁচ-পাঁচটি পুত্রসন্তান। বিহারের প্রত্যন্ত এলাকায় তো বটেই, দেশের অন্যত্রও এ সময় এ রকম বড় পরিবার ছিল স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক যুক্তিতে তা ছিল রীতিমতো প্রয়োজনীয়, গর্ভনিরোধক ব্যবহারের ধারণা প্রায় ছিল না বললেই চলে। সন্তানধারণ নিয়ে মেয়েদের ইচ্ছা-পছন্দের কথা সরস্বতী দেবীর মতো মেয়েরা নিজেরাও কোনও দিন ভাবেননি, অন্যরা তো দূরের কথা। কয়েক দশক পরে পুত্রবধূ অনিতা দেবী বিয়ে হয়ে আসেন। তত দিনে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে মোটামুটি, তবুও নিজের স্বামী ও শাশুড়ির পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষার কারণে একে-একে অনিতাও জন্ম দিয়ে ফেলেন ছ’টি সন্তানের। গল্পটা আলাদা হয়ে যায় অনিতার স্নাতক মেয়ে পূজা কুমারীর ক্ষেত্রে। বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করেছেন পূজা। স্বামী-স্ত্রী মিলে সচেতন ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দু’টি সন্তান নেওয়ার। সংখ্যার গণ্ডির বাইরে এসে তাঁরা ভাবছেন সন্তানদের শিক্ষা, সুরক্ষিত ভবিষ্যতের কথা। সরস্বতী দেবী থেকে পূজা— সিদ্ধান্ত নিতে চাওয়া, নিতে পারার এই দীর্ঘ পথ এখনও অনেকটাই বাকি। বহু পূজা এখনও আটকে যাচ্ছেন নানা বাধাবিপত্তির বেড়াজালে।
আকাঙ্ক্ষিত পরিবার গঠনে যে এখনও আর্থিক অবস্থাই এ দেশে সবচেয়ে বড় বাধা, তা অন্য বেশ কিছু গবেষণার মতো ইউএনএফপিএ-র সমীক্ষাতেও প্রমাণিত। এর পরই আসে বেকারত্ব, অনিশ্চিত জীবিকা, বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ে পরিচিত উদ্বেগ। এর পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, যা প্রায়শই দম্পতিদের সন্তানধারণের সময় পিছিয়ে দিতে, বা সন্তানধারণে বিরত থাকতে বাধ্য করে। এ ছাড়াও রয়েছে মেয়েদের সক্ষমতার প্রশ্ন। গত কয়েক দশকে শিক্ষা ও রোজগারে মেয়েরা এগিয়ে এলেও বেতনহীন গৃহকাজের বোঝা তাঁদের উপরেই অসম ভাবে রয়ে গেছে। এই প্রতিবেদনে স্পষ্ট যে, সব দেশে গৃহস্থালি বা সন্তান পালনে পুরুষদের অনাগ্রহ মেয়েদের সন্তানধারণ থেকে নিরুৎসাহ করছে। এ দেশে তো বটেই। কাজ ও সংসারের ‘ডাবল বোঝা’ অনেক মেয়েকে বাধ্য করে নিজের ইচ্ছে-পছন্দের বাইরে গিয়ে সন্তানধারণের সময়, সন্তান-সংখ্যা মেনে নিতে।
জনসংখ্যা-চর্চার মূল কাজ কেবল বাড়া-কমার রেখচিত্র তৈরি করা নয়, নানা বয়সের মানুষ যেন প্রজনন জীবন সম্পর্কে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেই স্বাধিকারের নিশ্চয়তাই তার প্রধান লক্ষ্য। এর জন্য যা যা প্রয়োজন, তার অন্যতম হল উপযুক্ত সময়ে সঠিক যৌন ও প্রজনন-সম্বন্ধীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করা। তাতে যেমন থাকতে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, তেমনই বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসাকেও সুলভ করতে হবে। চাই প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যভিত্তিক শিক্ষা। বৃহত্তর সমাজে দরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, লিঙ্গ-সমতা তৈরির উপযুক্ত নীতি। দরকার শিশু পরিচর্যার সুলভ ব্যবস্থা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, পুরুষদের সন্তান-পরিচর্যায় আগ্রহী করার নীতি। জনসংখ্যার হিসাব ছাড়িয়ে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুস্থ ও সাম্যময় সমাজ গড়ার এই হল পথ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)