বাংলায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে মুসলমানদের সরকারি কাজে ও নীতি নির্ধারণে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর দাবি, প্রচেষ্টা এবং এর বিরোধিতা, দুই-ই অনেক পুরনো। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এ তৎকালীন অখণ্ড বাংলার জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরির নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে, তাঁরা যে আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বাঙালি— এই যুক্তিই তখন বড় হয়ে উঠেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই, সেই সময় উচ্চবর্গের নেতারা তাঁদের সমর্থক সমাজের দিকে তাকিয়ে, নিজেদের ক্ষমতার আধিপত্য ধরে রাখতে এই চুক্তি বাতিল করেন। একশো বছর পর আজও দেখা যাচ্ছে সেই একই ধরনের বিরোধিতা।
লক্ষণীয়, এই বিরোধিতার অন্যতম কারণ বাঙালি মুসলমানদের একমাত্রিক ধর্মীয় পরিচিতি দেখার প্রবণতা। অথচ বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচিতির বেড়াজাল ভেঙে একটু দৃষ্টি প্রসারিত করলে দেখা যায়, তাঁদের একটি বড় অংশ পিছিয়ে পড়া অন্ত্যজ হিন্দুদের মধ্য থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। তাঁদের পশ্চাৎপদতা আজও চোখেমুখে স্পষ্ট, দারিদ্রের হার অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি। সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে এই সংরক্ষণ জরুরি, ধর্মীয় পরিচিতির কারণে নয়।
স্বাধীন ভারতে ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে সংরক্ষণের সুযোগ না থাকলেও, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতো সংরক্ষণের আওতায় মুসলমানদের আনা যেতে পারে— এমন ইঙ্গিত মণ্ডল কমিশন, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়েও স্পষ্ট ছিল। ধর্মীয় পরিচিতি নয়, বরং আর্থ-সামাজিক ভাবে পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী হিসাবে উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে মুসলমানদের সংরক্ষণের সুবিধা দিতে তামিলনাড়ু, কেরল ও তেলঙ্গানার মতো রাজ্য অনেক দিন ধরে সক্রিয়।
মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অনিচ্ছা ও অনাগ্রহ সুবিদিত। এমনকি ১৯৯৪ সালের প্রথম রাজ্য ওবিসি তালিকায় কোনও মুসলিম গোষ্ঠীর নাম ছিল না। পরে কেন্দ্রীয় ওবিসি তালিকায় আটটি গোষ্ঠীর নাম যুক্ত হলেও, সামগ্রিক ভাবে বাঙালি মুসলমানরা কেন্দ্রীয় ওবিসি সংরক্ষণের বিশেষ সুযোগ নিতে পারেননি। সেই কারণেই বাম আমলে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্ট মুসলমানদের দুর্দশার কথা তুলে ধরলে বাম নেতৃত্বের সম্বিৎ ফেরে।
বাম আমলে মুসলমানদের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল, বর্তমান শাসনকালে তার কিছুটা ফলাফল দেখা যাচ্ছিল। ওবিসি হিসাবে উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের উপস্থিতি খানিকটা চোখে পড়ার মতো। স্নাতক স্তরে প্রায় ১৪.৮১ শতাংশ পড়ুয়া মুসলমান।
সংরক্ষণে কিছু সুবিধা মুসলমানরা যখন পেতে শুরু করেছেন, তখনই কিছু সুবিধাভোগী ও বিভেদকামী মানুষ সংরক্ষণের বিরোধিতা শুরু করেছেন। আজকের পশ্চিমবঙ্গে তীব্র মেরুকরণের রাজনীতি সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে তাঁরা ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। কেবলমাত্র নির্বাচনী রাজনীতিতে কিছুটা সুবিধা তুলতে বলা হচ্ছে মুসলমানরা সরকারি চাকরিতে বেশি সুযোগ পাচ্ছেন— অথচ এমনিতেই সরকারি চাকরি ক্রমশ কমছে, দীর্ঘ কাল পিছিয়ে থাকার কারণে মুসলমানদের অংশগ্রহণ আশানারূপ নয়। বাম আমলে যেখানে শতাংশের হিসাবে আনা যেত না, এমন কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে, যেমন রাজ্যের সরকারি ও সরকার পোষিত কলেজে মুসলমান শিক্ষক প্রায় ৮ শতাংশ, আর বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত করলে ৬.৮২ শতাংশ। বিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে ১২ শতাংশ।
বিগত লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন কলকাতা হাই কোর্ট রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণকে অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করে। এর মধ্যে হাই কোর্ট ওবিসি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার বৈধতাকে প্রশ্ন করেছে। এই মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। রাজ্যের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় রাজ্য সরকার একের পর এক সময় চেয়েছে। রাজ্যের মুসলমান সমাজের চাপে রাজ্য প্রশাসন দেশের বেশ কয়েক জন খ্যাতনামা আইনজীবী নিয়োগ করেছে। এ ছাড়া মুসলমান সমাজের সচেতন নাগরিক দল নিজস্ব উদ্যোগে আইনজীবী নিয়োগ করে সামাজিক ন্যায়ের লড়াই করে চলেছেন।
প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হলেও কিছু সুরাহা না হওয়ায়, অন্য দিকে বিধানসভা ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেই শাসক দল ‘ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস কমিশন’-কে দিয়ে নতুন করে বেঞ্চমার্ক সমীক্ষা ও জনশুনানি করে তিন মাসের মধ্যে ১৪০ জাতিগোষ্ঠীর নতুন ওবিসি তালিকা মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মামলাকারী এই সিদ্ধান্ত হাই কোর্টের গোচরে আনতেই কলকাতা হাই কোর্ট নতুন ওবিসি বিজ্ঞপ্তির উপর স্থগিতাদেশ দেয়। আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে।
রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণ বিরোধী গোষ্ঠীর মূল অভিযোগ— ওবিসি সংরক্ষণ ফের সঠিক পদ্ধতি মেনে হয়নি। পদ্ধতিগত ত্রুটি যে আবারও হতেই পারে, এ সতর্কবার্তা এক বছর আগেই দিয়েছিলেন সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (‘জাতিগণনাই কি সমাধান’, আবাপ, পৃ ৪, ১৯ জুন ২০২৪)। কলকাতা হাই কোর্ট যে সব প্রশ্ন তুলেছিল, তা মাথায় রেখে এর সমাধানে রাজ্যে আটঘাট বেঁধে নামা উচিত ছিল।
২০২৩ সালে জাতীয় অনগ্রসর কমিশন এই বিষয়ে জানতে রাজ্য পরিদর্শন করে। তাঁদের পরিদর্শনের ফলে ওবিসি সংরক্ষণে কিছু প্রক্রিয়াগত ভুল তাঁরা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। প্রথম থেকেই এই ঢিলেমির মূল উৎস রাজ্য সরকারের হাতে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব।
প্রথমত, রাজ্যের মুসলমানরা কতখানি পিছিয়ে আছেন, এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কাছে প্রায় কোনও তথ্যই নেই, যার ভিত্তিতে তাঁদের সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে সংরক্ষণ প্রয়োজন। এই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার এক বছর হয়ে গেলেও মামলায় নিযুক্ত আইনজীবীর হাতে প্রয়োজনীয় তথ্য এক বছরেও তুলে দিতে পারেনি। ফলে কার্যত সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার কোনও শুনানি হয়নি।
অথচ এ বছরের মার্চ মাসে তাড়াহুড়ো করে ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস কমিশনকে পুনর্গঠিত করে তিন মাসের মধ্যে বেঞ্চমার্ক সমীক্ষা ও নানা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শুনানির ব্যবস্থা করা হয়। এই কমিশনে অনভিজ্ঞ দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে পুরো ব্যবস্থাপনার ভার দেওয়া হয়, অথচ জাত গণনা এক জটিল প্রক্রিয়া। এটি একটি গভীর সমাজতত্ত্বের বিষয়— রাজ্যের যাঁরা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করেই জুন মাসে ১৪০টি ওবিসি গোষ্ঠীর নাম-সহ নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এই নতুন তালিকা হাই কোর্টের নজরে আসতেই স্থগিতাদেশ জারি হয়।
প্রথমত, মুসলমান জনগোষ্ঠীর কয়েকটি গোষ্ঠীকে ওবিসি ‘এ’ থেকে ‘বি’-তে স্থানান্তরিত করা হল, এবং অমুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু ওবিসি গোষ্ঠী যারা দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের সুবিধা পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে তাদেরকে মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড ভুক্ত অর্থাৎ ওবিসি ‘এ’-তে আনা হল। এবং একই সঙ্গে বেশ কিছু ওবিসি গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। ওবিসি সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, যে-সব মুসলমান জনগোষ্ঠী পিছিয়ে আছেন, উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানে তাঁদের সুযোগ করে দেওয়া। অথচ এই নতুন তালিকায় কেবলমাত্র বয়সের ছাড় ছাড়া কিছু সুবিধা তাঁরা পাবেন না। অর্থাৎ, তাঁরা নতুন করে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। তাঁদের লড়াইটা একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে। যাঁরা দীর্ঘ দিন ‘ওবিসি’ সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করে এসেছেন তাঁদের যে-ভাবে ওবিসি ‘এ’-তে আনা হল, তাতে অনেকেই মনে করছেন এই নতুন বিজ্ঞপ্তিতে এক নরম হিন্দুত্বের ছোঁয়াও আছে।
মোট কথা, এখন রাজ্যের তীব্র মেরুকরণের আবহে, রাজনীতির শিকার হতে চলেছেন তিন কোটি বাঙালি মুসলমান। স্বাধীনতা ও দেশভাগের প্রায় আট দশক পুরতে চলল, তাঁদের বঞ্চনার পরম্পরা আজও বহাল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)