এই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন বা মাগা-র অনুপ্রেরণায় তিনি পরিকল্পনা করছেন মিগা-র— মেক ইন্ডিয়া গ্রেট এগেন। দু’দেশের বাণিজ্যিক চুক্তি আগামী পাঁচ বছরে পঞ্চাশ-হাজার কোটি ডলার ছোঁবে, এমন প্রতিশ্রুতিও নাকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের থেকে তিনি আদায় করেছিলেন। কয়েক মাসেই পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। ভারতীয় পণ্যের উপরে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, আর ২৫ শতাংশ জরিমানা আরোপ করেছে ট্রাম্পের আমেরিকা। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ শুল্ক ভারতীয় পণ্যের উপরেই বসছে। রাশিয়া থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল কেনে ভারত, এটাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গোসার কারণ। সাউথ ব্লক এই শুল্ককে অন্যায্য বলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে— পাল্টা আঙুল তুলেছে ইউরোপ-আমেরিকার নিজেদের রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কেনার দিকে।
রাশিয়া থেকে তেল কেনার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ন্যায্য ও যৌক্তিক। কোনও বিদেশি শক্তির চোখরাঙানিতেই দেশের স্বার্থের অনুকূল অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসা যায় না। আমেরিকার সঙ্গে সংঘাত এর আগেও হয়েছে— ১৯৭১-এর যুদ্ধ, বা পরমাণু পরীক্ষার সময়। পোখরানের পর আমেরিকান প্রশাসন সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল— প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, প্রযুক্তি, এমনকি আন্তর্জাতিক ঋণ, সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভারতের জন্য। তৎকালীন সরকার তখন শান্ত, দীর্ঘমেয়াদি কূটনীতির পথ বেছে নিয়েছিল । বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিংহ আর আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট স্ট্রোব ট্যালবটের মধ্যে টানা দু’বছরে মোট ১৪ দফা বৈঠক হয়েছিল— অধিকাংশই পর্দার আড়ালে। পরমাণু সিদ্ধান্তে অটল থেকেও ভারত আলোচনার দরজা খোলা রেখেছিল। এখন নয়াদিল্লির সুর অনেক বেশি আক্রমণাত্মক— প্রকাশ্যে আমেরিকার অবস্থানকে ভণ্ডামি আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন: এই সংঘাতপূর্ণ অবস্থান কি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক কৌশলের অংশ; না কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক শক্তিমান শৈলীর বহিঃপ্রকাশ বিদেশনীতিকে কোণঠাসা করে ফেলছে?
স্বাধীনতার পর থেকে ভারত বিদেশনীতিতে এক ধরনের কৌশলগত সংযম বজায় রেখে এসেছে। জওহরলাল নেহরুর জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭১-এর কূটনৈতিক ভারসাম্য, মনমোহন সিংহের আমলের অসামরিক পরমাণু চুক্তি— সব ক্ষেত্রেই লক্ষ্য ছিল বিরোধ সামলেও বৃহত্তর সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা। নির্বাচনী গণতন্ত্রের ঊর্ধ্বে, আমলাতন্ত্রের চিন্তাশীল রূপরেখায় নির্ধারিত হত বাণিজ্যিক চুক্তি। আজকের ভারতীয় অবস্থানের সঙ্গে এখানেই সবচেয়ে বড় পার্থক্য— বিদেশনীতি নির্ধারণে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তি-নির্ভর কূটনীতি প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকাকে ক্রমাগত অবমাননা করেছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি বিদেশের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সখ্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই ব্যক্তিগত সম্পর্ক-ভিত্তিক কূটনীতির সীমাবদ্ধতা আজ প্রকট হয়ে উঠেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আর কাঠামোগত ঐক্য যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়ে প্রতিস্থাপন করে যায় না, সে কথাটি প্রধানমন্ত্রী জানেন না বলে মনে হয় না। ২০১৮ সালে হিউস্টনে ‘হাউডি মোদী’র বন্ধুতা-প্রদর্শন ও প্রথা ভেঙে ট্রাম্পের হয়ে নির্বাচনী স্লোগান দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ট্রাম্প-প্রশাসন ভারতীয় রফতানিতে অতিরিক্ত শুল্ক চাপায়। এ বারও তার-ই পুনরাবৃত্তি— ফেব্রুয়ারির ঘনিষ্ঠতার কয়েক মাসের মধ্যেই এখন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, ভারতের আমেরিকার প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো প্রয়োজন। কিন্তু সেই পথ মসৃণ নয়। রাশিয়া-চিন-ভারতের যে নতুন অক্ষ তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, তার থেকে ভারতীয় অর্থনীতির আমেরিকা-নির্ভরতা কমার সম্ভাবনা থাকলেও তার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি। বর্তমানে ভারতের রফতানির প্রায় ১৮ শতাংশ যায় আমেরিকায়, যা ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশেরও বেশি— অর্থাৎ ছত্তীসগঢ় বা ঝাড়খণ্ডের বার্ষিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সমান। এই পরিমাণ রফতানির বিকল্প ব্যবস্থা করা মুশকিল। এই মুহূর্তে ট্রাম্প-প্রশাসনের আরোপিত নতুন শুল্ক ভারতের বস্ত্র-শিল্প, মূল্যবান ধাতু বা গয়নার রফতানিতে বড় রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ সব পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়ার উপরে আমেরিকান শুল্ক অনেক কম হওয়ার দরুন ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রভূত লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা। এর ফলে ভারতীয় মুদ্রার পতন, আমদানি-জনিত মূল্যস্ফীতি ও গত কয়েক বছর ধরে শেয়ার বাজার চাঙ্গা রাখা বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারেরও সম্ভাবনা প্রবল। প্রযুক্তি হস্তান্তর বা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহও জটিল হয়ে পড়বে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার এক শতাংশ কমার আশঙ্কা।
ভারতের কূটনৈতিক ইতিহাসে এমন সন্ধিক্ষণ একাধিক বার এসেছে। কিন্তু আজকের সমস্যা হল, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতি আগের কৌশলগত নমনীয়তার বিপরীত। এ বারের শুল্ক-সংঘাত তাই নিছক বাণিজ্যিক বিরোধ নয়, বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের এক সংঘর্ষও বটে। এক দিকে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি— যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কও রূপ নেয় নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চে; অন্য দিকে মোদীর ‘শক্তিশালী ভারত’-এর জাতীয়তাবাদ— যেখানে কূটনৈতিক সাফল্য মাপা হয় জনতার সামনে ব্যক্তিগত দৃঢ়তার প্রদর্শনে। এই জাতীয় দ্বন্দ্বে সমঝোতার জায়গা কমে আসে। সেখানে ছাড় দেওয়া মানেই সেটা ব্যক্তিগত পরাজয় মনে হয়। কাজেই আমেরিকার সঙ্গে শুল্ক নিয়ে চাপানউতোরের প্রভাব শুধু বাণিজ্যিক স্তরে সীমিত না-ও থাকতে পারে। গত দুই দশকে ওয়াশিংটন ধারাবাহিক ভাবে ভারতের পাশে থেকেছে, বিশেষত চিনের সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষায়। ইউরোপ, জাপান বা আরও অনেক দেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কও অনেকাংশে এই আমেরিকা-ঘনিষ্ঠতার প্রতিফলন। তাই সম্পর্কের তিক্ততা বাড়লে তার প্রভাব অন্যান্য মিত্রতায়ও পড়তে বাধ্য। পরিস্থিতি জটিল করছে পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান আমেরিকান প্রশাসনের উষ্ণতাও।
অনেক দেশই শুল্ক-সঙ্কট সামলাতে প্রাতিষ্ঠানিক কূটনীতির উপরে ভরসা রেখেছে। অস্ট্রেলিয়া দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও সমঝোতার দ্বারা বাড়তি ট্রাম্প-শুল্ক এড়িয়েছে; মেক্সিকো, কলম্বিয়া এবং কানাডাও সেই পথে হেঁটে নিজেদের রফতানি সুরক্ষিত করেছে। ইংল্যান্ড সরাসরি নতুন বাণিজ্য চুক্তি করে ধাতু ও গাড়িতে সর্বোচ্চ শুল্ক এড়িয়ে যেতে পেরেছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে না গিয়ে ছাড়-বিনিময় ও কৌশলী জোটবদ্ধতা যে বৈশ্বিক বাণিজ্যে সুরক্ষার নির্ভরযোগ্য পথ, সেটা তারা দেখিয়ে চলেছে। ভারতের কাছেও সে রকম একাধিক রাস্তা খোলা আছে। নির্দিষ্ট খাতে লক্ষ্যভিত্তিক ছাড় দিয়ে অন্য খাতে রফতানি সুরক্ষিত করা যেতে পারে। এতে দু’পক্ষই ‘পারস্পরিক সমন্বয়’ বলে মুখরক্ষা করতে পারবে। আমেরিকা-ভারত ট্রেড পলিসি ফোরামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আলোচনাকে প্রাতিষ্ঠানিক পথে নিয়ে যাওয়া দরকার, যাতে নেপথ্যে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যায়। পাশাপাশি, প্রতিরক্ষা, ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা বা সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহে সহযোগিতা বাড়িয়ে শুল্কে ছাড় আদায় করা সম্ভব।
এই শুল্ক-যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি না হলে তার প্রভাব নির্বাচনী সমীকরণেও পড়া অবশ্যম্ভাবী। ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে প্রধানমন্ত্রী নিজের যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর, তা বহুলাংশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের বর্ধিত প্রভাবের উপরে। এর ফলে জনগণের এক শ্রেণির কাছে তিনি জাতীয়তাবাদী গৌরবের প্রতীক হয়ে উঠতে পেরেছেন। ট্রাম্প-প্রশাসনের শুল্ক-আক্রমণ বিরোধীদের হাতে সেই দাবিকে সরাসরি আঘাত করার অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর এই পরিস্থিতি আবার কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে একই প্রশ্ন তুলে ধরছে— প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিচালনায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে কি?
প্রশ্ন দেশবাসীর সামনেও— ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতারা কি কখনও মজবুত প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হতে পারেন? ট্রাম্প-শুল্ক তাই বাণিজ্যিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও ভারতের রাজনৈতিক চেতনারও কঠিন পরীক্ষা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)