১৯৫৪ সালে দি ইকনমিক উইকলি-তে ছাপা হয়েছিল একটা ছোট্ট নিবন্ধ, দুর্গাপুজোর অর্থনীতি বিষয়ে। তাতে বলা হয়, পূজাবার্ষিকী নাকি পুজোর সময়ের ব্যবসায়ের ব্যারোমিটার। পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারীরা নাকি রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিচার করেন পুজোসংখ্যার বিক্রিবাটা দেখেই। সেটা সদ্য স্বাধীন দেশের প্রেক্ষিতে, সদ্য বিভক্ত বাঙালি সত্তার পশ্চিম খণ্ডের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ, নিশ্চয়ই।
এক শতকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পূজাবার্ষিকীর প্রকাশে যে সংস্কৃতির নির্মাণ হয়েছে, তা উৎসবের সঙ্গে ঘটিয়েছে সাহিত্যের মেলবন্ধন। পরিণত হয়েছে বাঙালির এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে, দুনিয়ায় যার জুড়ি মেলা ভার। বলা হচ্ছে, ‘প্রিন্ট মিডিয়া’র সুখের রাজত্ব আর নেই, ডিজিটাল মিডিয়া তাতে ভাগ বসিয়েছে অনেকটাই। পূজাবার্ষিকী তবু টিকে গিয়েছে— হয়তো তার প্রকাশভঙ্গি বদলে— পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সন্ধি করে। ফলে বেড়েছে তার বিস্তার। সহজে পৌঁছচ্ছে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে।
এক সময় পুজোয় নিয়ম করে বেরোত গানের রেকর্ড। ক্যাসেট বা সিডির পালা ফুরানোর সঙ্গে পুজোর গানের সেই বাজারও উধাও। স্মার্টফোন কিন্তু শারদ-সাহিত্যের বাজারে প্রভাব ফেললেও তাকে শেষ করতে পারেনি। খানিকটা ডিজিটাল জমানার সঙ্গে সাহিত্যের সফল অভিযোজনের ফলে, অনেকখানি আবার কাগজের বইয়ের প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণের কারণে।
দুর্গাপুজোর সঙ্গে শারদ-সাহিত্যের যে মিলমিশ ঘটেছে, তার অঙ্কুর খুঁজে পাওয়া যাবে দেড়শো বছরেরও বেশি আগে। ১৮৭৩-এ কেশবচন্দ্র সেনের ইন্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন তাদের সাপ্তাহিক প্রকাশনা সুলভ সমাচার-এর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ছুটির সুলভ নাম দিয়ে। তার আগে এ ধরনের প্রচেষ্টা হয়েছে কি না, হদিস পাইনি। তবে, পূজাবার্ষিকীর যথার্থ পূর্বসূরি বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত, ১৮৯২ সালের সাধনা পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যাটিকে, যাতে ছিল সম্পাদকের একত্রিশ বছর বয়সি কাকার লেখা গল্প, ‘স্বর্ণমৃগ’। তাতে কবি বর্ণনা দিয়েছেন তৎকালীন শারদ-আবহের, “আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে... মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্লব নব শীতবায়ুতে শিরশির করিয়া উঠিতেছে।”
১৩২৫ বঙ্গাব্দে পার্বণী পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ একটি গান লেখেন সেখানে, ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’। বাঙালির পূজাবার্ষিকীর ঢল কিন্তু নামে তার পরে পরেই। মোটামুটি এক শতাব্দী আগে, ১৯২০-র দশকে। ঢাকের শব্দ, শিউলি, কাশফুলের মতোই পূজাবার্ষিকী হয়ে ওঠে দুর্গাপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভারতবর্ষ, বঙ্গবাণী, বসুমতী, ভারতী, আনন্দবাজার পত্রিকা-র পুজোর সাহিত্য-অর্ঘ্যে ঋদ্ধ হতে থাকে বাঙালির মাতৃবন্দনা। ক্রমশ তা হয়ে ওঠে বঙ্গজীবনের অঙ্গ। ১৯২৬-এ প্রকাশ পায় প্রথম শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা।
প্রথম থেকেই ডাকসাইটে লেখকেরা লিখেছেন পুজো সংখ্যায়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, শিবরাম, সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, বনফুল, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার— কে নয়! বাংলার রবির শেষ প্রহরেও তাঁর দু’টি গল্প ‘রবিবার’ ও ‘ল্যাবরেটরি’ আনন্দবাজার পত্রিকা-র পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ ও ১৯৪০-এ। আবার প্রফেসর শঙ্কু বা গোগোলের নানা কীর্তির বেশির ভাগটাই পুজোসংখ্যার মাধ্যমেই জানতে পারেন মানুষ। ফেলুদার অধিকাংশ গল্পও প্রথম প্রকাশিত পুজোসংখ্যা সন্দেশ বা শারদীয় দেশ পত্রিকায়। পুজোসংখ্যার চল যে বাঙালিকে তার শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে অনন্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল জুগিয়েছে তা-ই নয়, লেখক প্রকাশক পাঠক প্রত্যেকের কাছেই হয়ে উঠেছে উদ্দীপনার বিষয়। শারদীয়া পত্রিকার ‘আইডিয়া’ ও তার রূপায়ণ বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই ত্রয়ীর মধ্যে তৈরি করে অমোঘ যোগসূত্র। আসলে পুজোসংখ্যা বার করার ধারণাটাই ছিল এক অসাধারণ বাণিজ্য-প্রতিভার স্বাক্ষর, যা প্রমাণিত হয়েছে সময়ের কষ্টিপাথরে।
অনেক খুঁজেপেতেও পুজোসংখ্যার মতো উৎসব-দিনের এমন কোনও নিয়মিত, ব্যাপ্ত ও বহুপ্রতীক্ষিত সাহিত্যসম্ভারের হদিস পাইনি পৃথিবীর অন্য কোথাও, অন্য কোনও উৎসবে— খানিকটা ব্রিটিশ ‘ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’ ছাড়া। সে অবশ্য দু’শো বছরের পুরনো ট্র্যাডিশন, যা চলছে এখনও— যদিও তার মাত্রা আমাদের পূজাবার্ষিকীর তুলনায় অনেকটাই পরিমিত। এ হল মূলত বাচ্চাদের কমিকস বা গল্পের বই, যা প্রকাশিত হয় বড়দিন উপলক্ষে। পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-র প্রথম প্রকাশ ১৯৭১-এ, ‘ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’-এর তুলনায় একেবারে হালে। ‘ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’-এ থাকে গল্প, কবিতা, শিল্প ও গান, যাতে প্রতিফলিত হয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দুই দিকই। এমনই এক বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানুয়াল-এ ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয় আর্থার কোনান ডয়েলের আ স্টাডি ইন স্কারলেট— সেখানেই পাঠকের প্রথম পরিচয় শার্লক হোমসের সঙ্গে (যেমন, কাকাবাবু সিরিজ়ের প্রথম উপন্যাস ভয়ংকর সুন্দর ছাপা হয় ১৯৭৯-এ, পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-য়।) গত শতকের সত্তর বা আশির দশকে ‘অ্যানুয়াল’-এর জনপ্রিয়তা ছিল প্রভূত। সেই আকর্ষণে অবশ্য টান ধরেছে এখন। আবার এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আগে তেমন চল না থাকলেও বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকা ও প্রকাশনী বার করে ইদ সংখ্যা।
পূজাবার্ষিকীর অর্থনীতিটা ঠিক কেমন? ২০১৯-এ আইআইটি খড়্গপুর ও লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষক যৌথ ভাবে দুর্গাপুজো ঘিরে সৃষ্টিশীল অর্থনীতির তত্ত্বতালাশ করেছেন ব্রিটিশ কাউন্সিল-এর এক রিপোর্টে। সেখানে পুজোর লেখার অর্থনীতির পরিমাণকে হিসাব করা হয়েছে ২৬০-২৭০ কোটি টাকায়। তাঁদের হিসাবে এটা দুর্গাপুজোর মোট সৃজনশীল অর্থনীতির ১ শতাংশেরও কম। তবু আজকের পরিস্থিতিতে বড় প্রকাশকদের কাছে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ লাভের ক্ষেত্র, স্বস্তিরও বটে। ব্রিটিশ কাউন্সিল-এর রিপোর্ট অবশ্য বলছে, পুজোসংখ্যার প্রকাশকদের মোট লাভের পরিমাণ ১৫ কোটি টাকা, এবং গোটা পাঁচেক বড় প্রকাশনা সংস্থার ৭-৮টি পূজাবার্ষিকীই নাকি এই অর্থনীতির ৮০-৮৫ শতাংশ দখলে রেখেছে। তার পর অবশ্য এসেছে ভয়ঙ্কর অতিমারি। আর সব কিছুর মতো সংবাদপত্র, ম্যাগাজ়িন, বই, পূজাবার্ষিকীর উপরেও তার প্রভাব পড়েছে।
ই-কমার্স ও ডিজিটাল মাধ্যমে পূজাবার্ষিকীর বাজার এখন পৌঁছেছে দুনিয়ার কোনায় কোনায়। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বিশ্ব জুড়ে নানা রূপে বাংলায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকার সংখ্যাও কয়েক হাজার হওয়া সম্ভব। তাদের বাণিজ্যের ঠিকঠাক হিসাব পাওয়াও কঠিন। তবে, আন্তর্জালের যুগে ডিজিটাল মাধ্যমেও নতুন নতুন পূজাবার্ষিকী যে লেখক ও পাঠকের বহু-আকাঙ্ক্ষিত বন্ধন পোক্ত করছে, তা নিশ্চিত।
পূজাবার্ষিকী প্রবহমান কালের ও সমাজের দর্পণ হিসেবেও কাজ করে। দু’-তিনটে উদাহরণ নেওয়া যাক শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা-র পাতা থেকে। ১৯৪৩-এর ভয়াবহ মন্বন্তরের পটভূমিতে, শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকীয়তে লেখা হল, “যিনি অন্নপূর্ণা, কুবের যাঁহার ভাণ্ডারী, তিনি কাঙ্গালিনীর বেশে ভিক্ষাপাত্র করে লইয়া তোমার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।” ১৯৪৫-এ একই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে আবার বলা হল, “বাঙ্গালী মাকে চিনিয়াছে, মায়ের বেদনা জাতিকে বুঝাইয়াছে; কিন্তু বাঙ্গালীর সে পূজা এখনও সার্থক হয় নাই; মাকে এখনও আমরা পাই নাই।” শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ পেরিয়ে কোভিড অতিমারির প্রেক্ষিতে ২০২১-এর সম্পাদকীয় লিখল, “সহমর্মিতা এবং সহযোগই যে-কোনও উৎসবে চক্ষুদান করে।... ভাল থাকুন, ভাল রাখুন। সঙ্কটে আমাদের অন্তরের ত্রিনয়ন জাগরিত হোক। দেবী হোন বা কন্যা, তাঁর আসন সেখানেই। অন্তরতম যিনি, অন্তরেই তাঁর প্রকৃত উৎসব।”
বাঙালির দুর্গোৎসব— এবং পূজাবার্ষিকী— তাই সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনেরও উদ্যাপন। সেই সঙ্গে এ যেন এক সর্বজনীন উৎসবের সঙ্গে ব্যক্তিগত পাঠাভ্যাসের এক বিনি সুতোর নিবিড় বন্ধনের বাস্তব রূপায়ণ। সমাজমাধ্যমের এই রমরমার যুগে ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকা বই পড়ার অভ্যাসের বিরুদ্ধেও এ এক চ্যালেঞ্জ। এর রূপ, প্রকাশভঙ্গি, বাণিজ্যের আঙ্গিক অবশ্য বদলায় নানা ভাবে। যেমন, অনেক পুজোসংখ্যাই এখন হাজির হয় আগমনীর আগমনের অনেক আগেই। মোটের উপর কিন্তু দি ইকনমিক উইকলি-র সেই নিবন্ধের সাত দশক পেরিয়ে এসেও, পুজোসংখ্যা যেন আজও থেকে যায় বাঙালির পুজোর অর্থনীতির— এবং উদ্দীপনার— ব্যারোমিটার হয়ে। আরও বিকশিত হতে থাকে, বাঙালির দুর্গাপুজো-ম্যাজিকের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)