কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার গঠনের জন্য জনমতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন অপরিহার্য প্রক্রিয়া। শুধু বৈধ ভোটাররাই যাতে এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত সংশোধনের মাধ্যমে ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পশ্চিমবঙ্গে সর্বশেষ ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) হয় ২০০২-এ। জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে তখনও তৎকালীন শাসক দলের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল, তবে এ বারের এসআইআর ঘিরে যে রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে তা নজিরবিহীন। নেপথ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে দ্রুত বদলে যাওয়া জনবিন্যাস। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাংলাদেশি হিন্দুরা তো বটেই, রাজনৈতিক টানাপড়েনে ও জীবিকার টানে বহু অ-হিন্দুও সে দেশ থেকে এসে ভারতে, সিংহভাগই এ রাজ্যে বসবাস শুরু করেছেন। এঁদের অনেকেই রেশন কার্ড, আধার কার্ড করানোর সঙ্গে সঙ্গে ভোটার তালিকায় নামও তুলে ফেলেছেন বলে অভিযোগ। একই সঙ্গে ভোটার তালিকায় মৃত, স্থায়ী ভাবে অন্যত্র বসবাসকারী এবং একাধিক নির্বাচনক্ষেত্রের ভোটার-তালিকাভুক্ত ব্যক্তির নাম থেকে যাওয়া এক পুরনো ব্যাধি, বরাবর যার সুবিধা পেয়ে এসেছে ক্ষমতাসীন শাসক দল।
এ বছর অগস্টে প্রকাশিত ‘ডেমোগ্রাফিক রিকনস্ট্রাকশন অব লেজিটিমেট ভোটার কাউন্ট: স্টাডি ফ্রম ইলেক্টোরাল ইনফ্লেশন ইন দি ইন্ডিয়ান স্টেট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ গবেষণাপত্রের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ১৩.৬৯ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১.০৪ কোটি বাড়তি ভোটার রয়েছে। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে ভোটার-তালিকা থেকে অবৈধ নামগুলি বাদ পড়া উচিত। অথচ ২০২৫-এ এসআইআর-এর দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে একাধিক রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতায় নেমে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি সরব রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস: এ রাজ্যে এসআইআর কিছুতেই কার্যকর হতে দেবে না বলে ঘোষণা, হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, কিছুই বাকি নেই।
তাদের সব দাবিই অযৌক্তিক নয়। ২০২৬-এ অসম, কেরল, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন, কিন্তু বিজেপি-শাসিত অসমকে এসআইআর-এর বাইরে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, যে-হেতু অসমে সিএএ কার্যকর করা হয়েছে এবং তারই ভিত্তিতে নতুন ভোটার-তালিকা তৈরি হয়েছে, তাই সেখানে এই মুহূর্তে এসআইআর-এর প্রয়োজন নেই। অসমের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভুটানের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে; এই সীমান্তগুলি যে-হেতু সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র নয়, তাই সিএএ কার্যকর হওয়ার পরে যে সে রাজ্যে কোনও অনুপ্রবেশ ঘটেনি এবং তাদের নাম ভোটার-তালিকায় ওঠেনি, হলফ করে বলা যায় না। তার উপরে যে-হেতু সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজটি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন, তাই ওই রাজ্যে এসআইআর কার্যকর করা অনেক সহজসাধ্য ছিল।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা ও কমিশনের কার্যপদ্ধতি নিয়ে এ রাজ্যে শাসক দল যে প্রশ্ন তুলেছে, সেগুলোও অসার নয়। কেন ২০০২-এর ভোটার-তালিকার ভিত্তিতে এই এসআইআর হচ্ছে, ২০২৪-এ যে ভোটার-তালিকার ভিত্তিতে লোকসভা নির্বাচন হল তা সংস্কারের জন্য কেন বিধানসভা নির্বাচনের আগের সময়টাই বেছে নেওয়া হল, তার সদুত্তর নেই। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আপাত-জনবিরোধী মনে হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা জনমত সংগঠিত করা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচিকে বাধাদান, তার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বিবৃতি, অসত্য তথ্য দিয়ে জনমানসে ত্রাসের সঞ্চার, মানুষকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্ররোচনা গঠনমূলক প্রতিবাদ নয়।
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের এ দেশ থেকে বিতাড়নের যে হুমকি দিয়ে চলেছে, তাতে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নয়, ২০০২-এ কর্মসূত্রে অন্যত্র বসবাস হেতু বা অন্য কারণে ভোটার-তালিকাভুক্ত হননি এমন বহু বৈধ নাগরিকও আতঙ্কিত। যাঁদের কাছে ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য কমিশন-নির্ধারিত নথি নেই, তাঁরা আরও ত্রস্ত। শাসক ও বিরোধী দলগুলোর প্রচারে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ভোটার-তালিকাভুক্ত হওয়া নাগরিকত্বের সমার্থক। ফলে অনেকেরই আশঙ্কা, নাম বাদ পড়লে এ দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হবে, বা ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তরফে নাগরিকদের সংশয় দূর করার তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এ রাজ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আত্মহত্যার ঘটনাগুলির সঙ্গে সত্যিই এসআইআর-আতঙ্কের যোগ প্রমাণিত হলে শাসক দল ও প্রধান বিরোধী দলের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন কমিশনও দায় এড়াতে পারে কি?
রাজনৈতিক দলগুলোর আস্ফালনের প্রেক্ষিতে কমিশনের ক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়ে জনমানসে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, এসআইআর রূপায়ণে তার প্রভাব পড়ছে। কর্মীদের বিরুদ্ধে আদর্শ বিধি ভঙ্গের অভিযোগ উঠছে: যেমন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণনাপত্র বিলির নির্দেশ সত্ত্বেও রাজনৈতিক চাপে বিএলও-রা ক্লাব, রাস্তা, স্কুল, এমনকি শাসক দলের পার্টি অফিস থেকেও তা বিলি করছেন। বিরোধী দলের বুথ লেভেল এজেন্টকে মারধর, ফর্ম বিলির সময় বিএলও-র সঙ্গে থাকতে বাধা, জুতোর মালা পরানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন কমিশনের তরফে এ সবের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সমূহ বিপদ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)