গণিতবিদ অ্যালান ট্যুরিং-এর ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’ (১৯৫০) গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা এআই-এর সম্ভাবনার বীজ বোনা হয় বলে মনে করা হয় বিজ্ঞানবিশ্বে। ওই গবেষণাপত্রের শুরুতে একটি প্রশ্ন ছিল, ‘ক্যান মেশিন থিঙ্ক?’ আজ যে সুপার-ইন্টেলিজেন্ট মেশিনের ‘এআই যুগ’-এ পৌঁছনো, তার শুরু সেখান থেকেই। ফাইনান্স ও ব্যাঙ্কিং, ই-কমার্স, হেলথকেয়ার, টেলি-যোগাযোগ, পরিবহণ, ভ্রমণ থেকে সমাজমাধ্যম, বিনোদন, শিল্পকলা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান গবেষণা— বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই-এর বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে, এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে তা সংযুক্ত হয়নি। মেশিন লার্নিং ও এআই-এর জন্য মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত চার বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২৭০ শতাংশ! বিজ্ঞান গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-আশ্রিত কাজের জন্য ২০২৪-এ পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে এসেছে নোবেল পুরস্কারও।
মূলত হিউম্যান লার্নিং ও ইন্টেলিজেন্স, এই দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে কাজ করে এআই। ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’, ‘প্রবলেম-সলভিং’ ও ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট-থট’সহ ‘হিউম্যান লার্নিং’ ও ‘ইন্টেলিজেন্স’ সংক্রান্ত বিষয়ের মূল নীতিগুলিকে যথাযথ ভাবে কোডিফাই করা, এবং মেশিন দ্বারা অজস্র তথ্য তথা ডেটার প্রতিলিপি তৈরির মধ্য দিয়ে এআই ব্যবস্থা কাজ করে।
‘কৃত্রিম’ তথা আরোপিত বুদ্ধির ভিত্তিতে এআই অভাবনীয় রকম বুদ্ধিমত্তার কাজে সক্ষম হলেও, তা কি মানুষের বদলে সব ধরনের কাজ করে দিতে পারবে? কর্মক্ষেত্রে কি মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন আজ অনেকেরই কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। অনেকে বলছেন, এআই-এর দুর্দান্ত দক্ষতা থাকলেও, মানুষের নিউরাল নেটওয়ার্কের অকল্পনীয় ক্ষমতা তার দ্বারা কখনওই সম্ভব হবে না। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি চিন্তা করতে পারে? এক কথায় এর উত্তর ‘না’, অন্তত মানুষ যে ভাবে চিন্তা করে সে ভাবে কখনওই নয়।
যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের স্বাভাবিক ভাবে অর্জিত ‘কমন সেন্স’ শেখানো কি আদৌ সম্ভব? ডিপ লার্নিং-এর প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে, তবু সাধারণ বোধহীন এআই-এর অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। মানুষের ক্ষেত্রে অপরিহার্য রকম জরুরি ‘কমন সেন্স’ সাধারণ ও স্বভাবসিদ্ধ এক ক্ষমতা হলেও, আধুনিক এআই-এর ক্ষেত্রে ‘কমন সেন্স’জাতীয় স্বজ্ঞাভিত্তিক যুক্তিবোধ বা বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষমতা আরোপ বা অর্জন অসম্ভব। বস্তুত, যাকে আমরা ‘কমন সেন্স’ বলি, তা সচেতন কোনও যুক্তি ছাড়াই কোনও বিষয়ে গভীর জ্ঞান বা উপলব্ধির উদয়— প্রতি দিন প্রতি পরিস্থিতিতে স্বজ্ঞালব্ধ যুক্তি সাজানোর এই ‘কমন সেন্স’ কাজ করে চলেছে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পরিচালনা ও চার পাশের পৃথিবীকে বুঝে ওঠার ক্ষেত্রে যা জরুরি। স্বজ্ঞালব্ধ যুক্তি, বিচার, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চেতন ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বুদ্ধি সহযোগে বিকশিত হয়ে ওঠে এই কমন সেন্স।
কোনও প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে, অনেক ক্ষেত্রে তা অনুমান করতে পারে মানুষ। নিবিষ্টমনে বই পড়তে পারে, নির্দেশ শুনে বুঝতে পারে, চিন্তা ও বিচার করতে পারে। এ ছাড়াও, কাজে ব্যর্থ হওয়া বা অন্যের করা ভুল বুঝতে পারে। প্রায় প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তে লক্ষ্যবস্তু, কার্যকলাপ, ব্যক্তি, দৃশ্য বা কোনও ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার সময় অবচেতন অবস্থাতেও পদক্ষেপ করতে পারে মানুষ। কোনও একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনটা প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়, কমন সেন্স প্রয়োগ করে বুঝে যায় সে। মানুষের স্বজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক এই যে ক্ষমতা, তা থেকে এআই এখনও যোজন দূরে।
দাবা খেলা বা শরীরের টিউমার চিহ্নিত করা ইত্যাদি নানা কাজে মানুষের চিন্তাশক্তিকে এআই ছাপিয়ে গেলেও, বৃহত্তর বিশ্বে আগে সম্মুখীন না-হওয়া অগণিত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে এআই মুখ থুবড়ে পড়ে। গণ্ডির বাইরের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে মানুষ কমন সেন্স কাজে লাগিয়ে সহজে তার সমাধান করতে পারে। অথচ এই সব ক্ষেত্রে আগে শিখে রাখা এআই-এর নির্ধারিত নিয়মাবলি বা তথ্যভান্ডার প্রায়ই অসফল হয়।
এআই-এর না-থাকার তালিকায় এখনও অনেক কিছুই: নান্দনিক বোধ; প্রেরণা, দরদ জানানোর মতো পরিস্থিতি বুঝতে পারা এবং সেই মতো খাঁটি প্রতিক্রিয়া জানানো ইত্যাদি। দু’বছরের একটি শিশুও কার্য-কারণ সম্পর্ক নিয়ে যে ভাবে ভাবতে ও প্রতিক্রিয়া দিতে পারে, এআই তা পারে না।
প্রেম-ভালবাসা, অপরাধ, বিশ্বাসঘাতকতা এই সব বিষয় আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের জীবনে এগুলি প্রভাব ফেলে। আবেগ উপলব্ধি বা পরিচালিত করার কোনও সূত্র যদি আমাদের না থাকে, আমরা কখনওই পুরোপুরি বুঝতে বা অনুভব করতে পারব না, কিসের তাড়নায় এই সব বোধের জন্ম হয়।
কম্পিউটার-বিজ্ঞানী ও লেখক এরিক লারসন দ্য মিথ অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স: হোয়াই কম্পিউটারস কান’ট থিঙ্ক দ্য ওয়ে উই ডু (হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২১) বইয়ে এআই সম্পর্কে বলেছেন, অজানাকে উন্মোচনের পথ ধরেই আসে উদ্ভাবন-সংস্কৃতির সফলতা, কখনওই তা উপস্থিত পদ্ধতিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের প্রচারের মাধ্যমে হয় না। এআই-এর সাফল্য বিকশিত হয়ে ওঠার সঙ্গে একমাত্র সম্পর্ক হল মানুষের প্রকৃত মেধার, তা অস্বীকারের জায়গা নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)