E-Paper

রিল-দুনিয়ার আঁধার সাম্রাজ্য

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে ভেসে বেড়ানো ছোট ভিডিয়োগুলিই হল রিল। তবে টিকটক ব্যবহার ভারতে নিষিদ্ধ। এই রিল বানানোই এখন এক পেশা। যত দর্শক, তত আয়।

মধুমিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৭

সমাজমাধ্যমে রিল-এর ঢেউ! ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে হাতের মোবাইলে স্ক্রল করে করে রিল দেখে। চরম আসক্তি! ভিডিয়ো গেমসের আসক্তি নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল, এখন সেই আশঙ্কা বহু গুণ বেড়েছে রিল নিয়ে। চিনের এক বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, টানা রিল দেখে চললে অ্যালকোহল বা জুয়ার মতো প্রভাব পড়ে মননে, এতে মস্তিষ্কের ক্ষতিরও সম্ভাবনা। বিঘ্ন ঘটতে পারে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়। বিতর্ক ছড়াচ্ছে রিল-এর মান। সব রিল সকলের দেখার যোগ্য?

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে ভেসে বেড়ানো ছোট ভিডিয়োগুলিই হল রিল। তবে টিকটক ব্যবহার ভারতে নিষিদ্ধ। এই রিল বানানোই এখন এক পেশা। যত দর্শক, তত আয়। সেই লক্ষ্যেই সমাজমাধ্যমে ফুঁসে উঠছে রিল-তরঙ্গ। রিল-এ কী নেই! বিনোদন, শিক্ষা, তথ্য— সবই মেলে। তবে গুরুতর প্রশ্ন হল— সব রিল কি ‘রুচিসম্মত’? কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা বিষয়স্রষ্টারা যে ‘কনটেন্ট’ তৈরি করে চলেছেন, তার কতগুলি সুস্থ, স্বাভাবিক বা সত্যিই ভাল— সেই সব বিতর্ককে তুড়ি মেরে আন্তর্জালে নিরবচ্ছিন্ন যোগ হয়েই চলেছে এই খুদে খুদে ভিডিয়ো। যেন যেমন-তেমন, যা খুশির এক অদ্ভুত নাগরদোলা। ঘুরেই চলছে! মাথা ঘুরছে, শরীর গুলিয়ে উঠছে কারও কারও, তবু বশীভূতের মতো বলছেন— জোরে, আরও জোরে।

স্রষ্টাদের মধ্যে বড়সড় সংখ্যা মহিলা। অবসর সময়ের, ঘরের কাজেরও বানিয়ে ফেলছেন রিল। এমন কনটেন্ট ক্রিয়েটর রয়েছেন, যাঁরা মোটামুটি সমাজমাধ্যমেই দিন রাত কাবার করে দিচ্ছেন— ‘গুড মর্নিং গাইজ়’ থেকে ‘গুড নাইট ফ্রেন্ডস’ বলে। এতেই নাকি ফলোয়ার বাড়ে। উদ্দেশ্য, ফলোয়ার বাড়িয়ে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক থেকে কিছু অর্থ উপার্জন। তবে এঁদের অনেকেই নিরীহ ধরনের। আর এক গোত্রে যাঁরা পড়েন, তাঁরা রীতিমতো ‘সাহসী’ এবং মরিয়া। তাতে গ্রাম, শহর, শিক্ষা, অশিক্ষার ভেদ নেই। কেউ ধানখেতে জনপ্রিয় গানের সঙ্গে উদ্দাম নেচে চলছেন তালজ্ঞান ছাড়াই। কেউ শহরের ব্যস্ত রাস্তায় অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে লাফাচ্ছেন। কাউকে দেখা যাচ্ছে রাতপোশাকে। শুধু লজ্জাবস্ত্রেই ক্যামেরায় আসছেন— উদাহরণ অগণন। সেই সব রিল-এর হাজার, লাখো ভিউ। ‘ফলোয়ার’-ওলক্ষ লক্ষ।

বাংলার কিছু বিষয় স্রষ্টার বিরুদ্ধে থানায় অশ্লীলতার অভিযোগ জমা পড়তে শুরু করেছে। অভিযুক্তদের অন্যতম এক জন লাইভে এসে জানিয়েছেন, পারিবারিক সব রকম রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি একটু খোলামেলা রিল বানিয়ে রোজগারের পথ বেছে নিয়েছেন। কারণ? এতে একটি ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া কোনও পুঁজিই লাগে না। ঠিকই। বিদ্যা, মেধার দরকার তো নেই-ই, ভিডিয়ো করতে শ্রমও লাগে না বিশেষ। দেশে কর্মসঙ্কট, না কি পরিশ্রমের বদলে সাফল্যের শর্টকাট-এ ঝোঁক— কী বলা যায় একে?

সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এ উপকৃতও বহু। কিন্তু রিল-সংস্কৃতি চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছে। সমাজমাধ্যমে বড় সংখ্যায় রয়েছে নাবালকরা। এই সব রিল তারাও দেখছে। এত হিংসা, যৌনতার প্রদর্শনী তাদের আচরণকে যদি প্রভাবিত করে? সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ বছরের কমবয়সিদের সমাজমাধ্যমে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে অনেকেই বলছেন, এতে বজ্র আঁটুনিতে ফস্কা গেরোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাই সমাজমাধ্যমগুলির পক্ষ থেকেই বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রণ কাম্য। যা তারা চাইলেই পারে।

ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুকের নিয়ন্তা মেটা-র ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ নামক মানদণ্ডে যে কনটেন্টগুলি আপত্তিজনক, সেই সব কিন্তু সরিয়ে দেওয়া হয়। সমাজমাধ্যমে সড়গড় অনেকেই মনে করেন, ‘আপত্তিকর’ রিল নিয়ে অভিযোগ সত্ত্বেও ঝাপসা করে দেওয়া বা সতর্কবার্তা জুড়ে দেওয়ার মৌলিক নীতিটুকু পর্যন্ত কিছুতে প্রয়োগ করছে না মেটা। বিকল্প সমাজ তৈরি করতে গিয়ে প্রশ্রয় দিচ্ছে সামাজিক অপরাধকে। অপশব্দ, নারীকে পণ্য করা, শরীর প্রদর্শন, ছোটদের সামনে নিষিদ্ধ বস্তু সুলভ রাখা— এ সব কাণ্ডকারখানা আগেও অশ্লীলতা বিরোধী আইনে মুশকিলে পড়েছে, আবার বাক্‌স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বহু বার আইনের কবল থেকে ছিটকে বেরিয়েওছে।

স্থান, কাল বদলের সঙ্গে রুচি, সংস্কৃতিও পাল্টায়। তাই মেটা যে ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ স্থির করেছে, তার সঙ্গে পৃথিবীর সব দেশের রুচি, সংস্কৃতির মিল না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ক্ষেত্রে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগে আরও জোর দিয়ে, মেটার নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা প্রয়োজন বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারা ‘ভিউ’ ‘উপভোগ’ করলেন, তাঁদের পরিচিতি প্রকাশ্যে এলেও এই চোরাগোপ্তা অন্ধকারে ঢুকে পড়া ও পরিণামে, অ্যালগরিদম-এর কল্যাণে রিল-সংস্কৃতি ফুলেফেঁপে উঠে সমাজের বৃহত্তম, মুখ্য সংস্কৃতি হয়ে বাকি সব আলো ঢেকে দেওয়ার ভয়াবহতা কমবে। কিন্তু মেটা কি তাদের লাভের রাস্তার সঙ্গে কোনও সমঝোতা করবে?

না করলে, রিল-সংস্কৃতির নামে ‘অপরিস্রুত’ কনটেন্ট দুনিয়া জুড়ে ছড়াতেই থাকবে। এই সুনামিতে কোথাও একটা ছাঁকনির বা জোর ঝাঁকুনির প্রয়োজন। প্রশাসন, আইনবিভাগ এবং সমাজ— সকলেরই জেগে ওঠার সময় এসেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

reel video Culture freedom of speech Law

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy