E-Paper

নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল

সৌম্য দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২৫ ০৫:৪৪
পাল্টা: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাপ বাড়াচ্ছেন, আর ফুঁসে উঠছে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি— কর্তৃপক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রী।

পাল্টা: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাপ বাড়াচ্ছেন, আর ফুঁসে উঠছে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি— কর্তৃপক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রী। কেমব্রিজ ম্যাসাচুসেটস, ১২ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স।

গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলি উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হয়ে আছে— সমগ্র দুনিয়া জুড়ে। ভারত ও অন্যান্য দেশের মেধাবী বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, সমাজবিদ্যাবিদ ও মানবিকবিদ্যার পণ্ডিত থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) গবেষক ও শিক্ষার্থীরা গবেষণার সু্যোগ এবং বৌদ্ধিক স্বাধীনতার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভিড় জমিয়ে আসছেন বহু দিন ধরে। তাঁদের মধ্যে অনেকে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলির কর্ণধার হয়েছেন। সত্য নাদেলা, সুন্দর পিচাই বা অরবিন্দ কৃষ্ণ, যাঁরা যথাক্রমে মাইক্রোসফট, গুগল, আর আইবিএম-এর সিইও, তাঁদের সবাই এক সময়ে ছাত্র হয়ে এসেছিলেন, এবং পরবর্তী কালে এইচ-ওয়ানবি ভিসায় চাকরি করে ক্রমে উন্নতি করে এই জায়গায় পৌঁছেছেন। এমনকি সে দেশের বহু সরকারি প্রশাসনিক দফতরে ছাঁটাই করেছেন যে ইলন মাস্ক, সেই টেসলা গাড়ি ও স্পেসেক্স রকেট নির্মাতাও এক দিন এইচ-ওয়ানবি চাকরির ভিসা নিয়েই আমেরিকায় এসেছিলেন। ফরচুন পত্রিকার সেরা পাঁচশো কোম্পানির তালিকার শতকরা ৪৪ ভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিদেশ থেকে আসা ছাত্র বা চাকরিজীবী।

কিন্তু আজ আমেরিকায় বিদ্যাচর্চার সেই আকর্ষণ হুমকির মুখে। আমেরিকার সাধারণ জনগণকে খুশি রাখার জন্য বিদেশি শিক্ষার্থী ও চাকরিসন্ধানীদের জন্য আমেরিকান ভিসা দেওয়ায় বিধিনিষেধের নতুন একটি ঢেউ উঠেছে। নতুন করে ভিসাপ্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করা হবে। যাঁরা ভিসা নিয়ে এ দেশে এসেছেন, তাঁদেরও কারও কারও ভিসা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এই নীতিগুলি উদ্ভাবন ক্ষমতা, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং মননে উদ্ভাবনে আমেরিকার আন্তর্জাতিক উৎকর্ষে সুদূরপ্রসারী প্রভাব আনতে পারে। সাম্প্রতিক আমেরিকান অভিবাসন নীতিগুলি এ দেশের সাম্প্রতিক অতি-দক্ষিণ রাজনৈতিক মতবাদ ও অনুদার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে। নতুন ছাত্রদের ভিসা ইন্টারভিউ স্থগিত করা হয়েছে। সমাজমাধ্যমে তাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ যাচাই করে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করা হচ্ছে, প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘তুমি কোন দলে?’ এমনকি বৈধ ভিসারও আকস্মিক প্রত্যাহার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ছোটখাটো লঙ্ঘন বা ব্যাখ্যাহীন অস্পষ্ট কারণে শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান এবং নির্বাসনের সম্মুখীন হচ্ছেন। এটা কোনও কাল্পনিক আশঙ্কা নয়— হাজার হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা ইতিমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে। ডিগ্রি পাওয়ার পর ঐচ্ছিক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ (ওপিটি), যা বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রকৌশল ও অঙ্কের (স্টেম) স্নাতকদের তিন বছর পর্যন্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার সুযোগ দেয়, তাও তদন্তের আওতায় রয়েছে। অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য এই প্রশিক্ষণ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা দেয়। হার্ভার্ডে বিদেশি ছাত্রদের ভিসা না দেওয়া, তাদের সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া, ওপিটি-এর উপর প্রস্তাবিত বিধিনিষেধ, চাকরির জন্য এইচ-ওয়ানবি ভিসার শর্তাবলি, বিদেশি প্রতিভার জন্য শিক্ষা-পরবর্তী অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ সঙ্কুচিত করা— এ সবই একটি পরিকল্পিত অপরায়ণের কার্যক্রম।

আমেরিকার শিক্ষা ও কর্মজগতে স্থানীয় প্রতিভার অপ্রতুলতার জন্যই বিদেশ থেকে ছাত্র ও প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীদের নিয়ে আসার চলটা তৈরি হয়েছিল। এমন নয় যে বিদেশিরা আসছে বলে স্থানীয় ছাত্র বা আমেরিকার নাগরিকরা উপযুক্ত হয়েও সুযোগ পাচ্ছেন না। দেশটা তৈরিই হয়েছে অভিবাসনের উপর নির্ভর করে। ভারতীয় শিক্ষার্থীরা আমেরিকার অভিবাসীদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। শুধুমাত্র ২০২৪-এ ৩৩০,০০০-এরও বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নথিভুক্ত হয়েছেন। এই শিক্ষার্থীরা কেবল প্রকৌশলবিদ্যা, তথ্যবিজ্ঞান, সিদ্ধান্তবিজ্ঞান, এবং স্বাস্থ্যসেবাতে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার শূন্যস্থান পূরণ করেন না, বরং বিপুল অঙ্কের টিউশন ফি দিয়ে, আবাসন এবং অন্যান্য খরচের মাধ্যমে আমেরিকার অর্থনীতিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অবদান রাখেন।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তাঁরা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য, বিশেষ করে স্নাতক স্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক সম্পদ হিসেবে কাজ করেন। স্টেম বিষয়গুলিতে আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলির স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রদের প্রায় অর্ধেক বিদেশি। এই দলে বিশেষ করে কম্পিউটার বিজ্ঞান, ব্যবসায়িক বিশ্লেষণ, বৈদ্যুতিক প্রকৌশল এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকদের একটি প্রভাবশালী অংশ রয়েছে। শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি গবেষণা কার্যক্রমকে অকার্যকর করে তুলবে। ক্লাসরুমের বাইরেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা আমেরিকার গবেষণা এবং উদ্ভাবনের ইঞ্জিন। বিদেশি স্নাতক শিক্ষার্থীরা প্রায়শই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জৈবপ্রযুক্তি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর উপর কাজ করেন। এই ল্যাবগুলিতে গবেষক তাঁরা, নানা প্রকল্পের নেতা। এঁরাই আমেরিকান শিক্ষা ও সমাজের ভবিষ্যৎ। এঁরাই আমেরিকার জাতীয় উৎকর্ষ নির্ধারণ করেন।

আমেরিকান পেটেন্ট এবং বৈজ্ঞানিক সাফল্যে অভিবাসী-গবেষকদের বিরাট অবদান, যাঁদের অনেকেই ছাত্র ভিসায় এসেছিলেন। ভিসা সীমাবদ্ধ করা কেবল একটি দরজা বন্ধ করে দেয় না, এটি পরবর্তী প্রজন্মের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির জন্য একটি জোগান-ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। যে ভারতীয় ছাত্রটি এমআইটি ল্যাবে একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন, সেই একই ছাত্র পরবর্তী কালে চিকিৎসা-প্রযুক্তি কোম্পানি বা এআই-এর নতুন দিশা খুঁজে পেতে পারেন, যা সারা পৃথিবীর জীবনযাত্রা বদলে দেবে। এক দিক থেকে দেখতে গেলে এই প্রতিভাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আখেরে উদ্ভাবনকে ঠেলে দিচ্ছে অন্যান্য দেশে— তা সে বেঙ্গালুরু, বেজিং, বার্লিন বা টরন্টো, যেখানেই হোক। সে সব দেশের লাভ, আমেরিকার ক্ষতি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আর্থিক এবং পরিচালনাগত সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সাধারণত পুরো টিউশন ফি ডলার দিয়ে পড়তে আসেন, কারণ তাঁরা আমেরিকার কেন্দ্রীয় অনুদান পাবেন না (অতি অল্পসংখ্যক ছাত্রই বৃত্তি নিয়ে আসেন)। সেই ডলারে আমেরিকান ছাত্ররা বৃত্তি পেয়ে থাকেন। নানা গবেষণায় সেই অর্থ কাজে লাগে। তাঁদের হারানোর ফলে বাজেট কাটছাঁট হবে, নানা প্রকল্প বন্ধ হবে, এবং আমেরিকান শিক্ষার্থীদের জন্যও সুবিধে কমবে। ক্যাম্পাসের চার দেওয়ালের বাইরেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক অবদান বিশাল। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজর্স (নাফসা)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ক্যাম্পাস থেকে পাশ করে বেরিয়ে প্রতি তিন জন বিদেশি ছাত্র আমেরিকানদের জন্য একটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেন। প্রায় চার লক্ষ আমেরিকার চাকরি নির্ভর করে এই অর্থের উপর। এ দেশের অর্থনীতিতে বছরে চল্লিশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি উপার্জন এনে দেয়। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যে সব শহরে অবস্থিত, সেখানকার স্থানীয় ব্যবসা, বাড়িওয়ালা এবং জনসেবাকেন্দ্র— সবাই উপকৃত হয়। বিদেশি ছাত্রসংখ্যা কমে গেলে এই শহরগুলিরও ক্ষতি।

আমেরিকার উচ্চশিক্ষা দীর্ঘ দিন ধরে এই দেশের নরম শক্তির ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড এবং এমআইটির মতো অভিজাত প্রতিষ্ঠানগুলি কেবল অ্যাকাডেমিক ব্র্যান্ড নয়; তারা বিশ্বব্যাপী চিন্তার শীর্ষে রয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির উদ্ভাবক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করা অনেক বর্তমান ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান, সিইও, এবং বিজ্ঞানীরা এক সময়ে আমেরিকার উদার মূল্যবোধ এবং অংশীদারির প্রতি অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তাঁদের দেশগুলিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজেদের দেশে ফিরে গিয়েছেন।

এ রকম একচেটিয়া পলিসির ফলে এই বিশ্বব্যাপী সুনাম আর ধরে রাখতে পারবে কি আমেরিকা? নানা দেশ থেকে আসা শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের আদানপ্রদান, বন্ধুত্ব এবং বৌদ্ধিক বিনিময়ের মাধ্যমে চিন্তা ও গবেষণার ধারা তৈরি হয়। যদি ভারতীয় এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আমেরিকা দূরে সরিয়ে দেয়, তা হলে তার শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত ভাবেই আর বহুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ থাকবে না, সে সব ছাত্র অন্যান্য দেশে সুযোগ খুঁজবেন। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় আমেরিকা সম্ভবত তার জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনটি হারাবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

america Donald Trump

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy