একটা ক্লাসঘর। সেখানে বেঞ্চে বসা ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গে মুখস্থ করে চলেছে সেই বাক্য, যা সাইবার-অপরাধীদের ফাঁদ পাতার ফোনে শোনা যায়। “আপনার ক্রেডিট কার্ড লক হয়ে গিয়েছে, তা খোলার জন্য ক্রেডিট কার্ডের নম্বর বলুন।” সাইবার-অপরাধের তালিম দেওয়ার এমন শ্রেণিকক্ষের ছবি দেখা গিয়েছিল এক ওয়েব সিরিজ়ে। আজকের ভারতে এ শুধু কল্পনা নয়, ঘোর বাস্তব। পরিসংখ্যানে দাবি, ২০২৪-এ ভারতীয়রা সাইবার-অপরাধীদের কাছে খুইয়েছেন ২২ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা।
অঙ্কটা ২০২৩-এর থেকে দু’শো শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। আর যে উপায়ে সাইবার-অপরাধীরা মানুষের কষ্টের সঞ্চয় থেকে এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে, তা হল তথ্য। নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য নাগালে চলে এলেই কাজ সহজ হয়ে যাচ্ছে অপরাধীদের। এ রাজ্যে ভোটার-তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের আবহে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার প্রশ্নটাও তাই গুরুত্বপূর্ণ।
এসআইআর-এর মতো একটা কেজো প্রক্রিয়াকে সংবাদ শিরোনামে আনা ও সাড়া ফেলে দেওয়ার মতো একটা ঘটনায় রূপান্তরিত করার কৃতিত্বটা অবশ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই। এক দিকে কে কত কোটি নাম বাদ দেবেন সেই ঘোষণার প্রতিযোগিতা, অন্য দিকে নাম বাদ না দিতে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। এই দড়ি-টানাটানিতে নিরীহ নাগরিকেরা দিশেহারা। পথে-ঘাটে, অফিস-কাছারিতে সর্বত্র এসআইআর নিয়ে আলোচনা: ফর্ম এল কি না, নাম আছে কি না, কোথায় কার নাম লিখতে হবে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নিয়ে চর্চা। এসআইআর-এর সর্বব্যাপী প্রভাবেই লুকিয়ে ভবিষ্যৎ বিপদের বীজ।
অবশ্য ভবিষ্যৎ কেন! বিপদের খবর তো এখনই মিলছে। কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসআইআর নিয়ে মানুষের উদ্বেগ কাজে লাগিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও বিএলও পরিচয় দিয়ে ওটিপি জেনে নিয়ে টাকা হাতিয়েছে প্রতারকেরা, কোথাও নথি তৈরির নামে ভুয়ো লিঙ্ক পাঠিয়ে নাগরিকের সঞ্চয় হাতিয়ে নিয়েছে। সম্প্রতি এমন নানা খবর এসেছে পুলিশের কাছে।
এসআইআর-এর আবহে কার্যত অপরাধীদের পোয়াবারো। তারা তো নানা অছিলায় চেষ্টাই করে গ্রাহকের তথ্য হাতিয়ে আর্থিক প্রতারণা করতে, এই পরিস্থিতিতে নাগরিকেরাই নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য উজাড় করে দেওয়ার জন্য আকুল। এসআইআর-এর মতো একটা রুটিন-বাঁধা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক তরজার জেরে জুড়ে গিয়েছে নাগরিকত্ব থাকা না-থাকার প্রশ্ন। সাধারণ মানুষ তাই উৎকণ্ঠায়, যে যেমন পারেন নথি জোগাড় করে তৈরি হচ্ছেন। ঘুণাক্ষরেও ভাবছেন না, তাঁদের চিন্তা ও উদ্বেগকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতছে অনেকে।
সমাজমাধ্যম-নির্ভর যুগে তৈরি হওয়া আরও একটি অভ্যাস এই বিপদে অনুঘটকের কাজ করেছে— নিজের কথা সবাইকে জানাতে ব্যগ্র হয়ে পড়া। যে ভাবে লোকে এখন দুপুরের খাবার থেকে নতুন মোবাইল কেনা— অনেক কিছুই সমাজমাধ্যমে ঘোষণা করেন, সে ভাবেই নিজের পূরণ করা এনুমারেশন ফর্ম বা গণনাপত্রের ছবিও সমাজমাধ্যমে দিচ্ছেন। জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর, আধার নম্বর উন্মুক্ত হচ্ছে সকলের কাছে। প্রতারকদের হাতে এসে যাচ্ছে সুযোগ।
তবে স্বেচ্ছায় নিজের তথ্য না জানালেও বিপদ যে নেই তা নয়। অসংখ্য মানুষ ফোটোকপি করছেন নিজেদের নানা রকম পরিচয়পত্র; হাতে পাওয়া গণনাপত্রও একাধিক ফোটোকপি করে রাখছেন অনেকে, পূরণ করা অভ্যাস করবেন বলে। শয়ে শয়ে বাড়তি ফর্ম বা নথির ফোটোকপি কোনও ভাবে হাতের নাগালের বাইরে গেলেও নিজের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
নাগরিকদের বিপুল অংশ প্রবীণ, সারা জীবনের সঞ্চয়ই যাঁদের আর্থিক সম্বল। বেশির ভাগই কম্পিউটারে সড়গড় নন। পুরনো ভোটার-তালিকা বার করা থেকে শুরু করে নানা কাজে তাঁদের নির্ভর করতে হচ্ছে অন্যের উপরে। সেখানেও সাহায্যকারীর ভেক ধরে কেউ চেষ্টা করতে পারে কষ্টার্জিত সঞ্চয় লুটে নেওয়ার। আর শিক্ষার সুযোগ যাঁরা পাননি, তাঁদের তো অন্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। তথ্য বেহাত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তাঁরা অনন্যোপায়।
নির্বাচন কমিশনের কিন্তু এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, এই তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। জাতীয় বা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার দেখাশোনা করে ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার (এনআইসি)। কমিশন জানিয়েছে, তাদের তথ্যভান্ডার একাধিক বলয় দ্বারা সুরক্ষিত। কিন্তু তথ্য কমিশনের কাছে পৌঁছনোর আগে যে প্রক্রিয়া চলছে, সেখান থেকে কি তা বেহাত হতে পারে না? নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতে কী কী সাবধানতা নেওয়া উচিত, তা অনেক আগে থেকে, আরও বিশদে, জোরগলায় বলা প্রয়োজন ছিল। তেমনটা চোখে পড়েনি। প্রতারণার খবর সামনে আসার পর গত সোমবার কমিশন সতর্কবার্তা দিয়ে জানিয়েছে, এই কাজে মোবাইলে কোনও ওটিপি (এককালীন পাসওয়ার্ড) লাগে না। তবে এই বার্তা আরও আগে, আরও ব্যাপক ভাবে দেওয়া উচিত ছিল, সন্দেহ নেই।
সতর্ক করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলিরও। তারা শুধু এই প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক বয়ান নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমজনতা কোন সাবধানতা অর্জন করবে সেটাও তাদের বার বার বলা উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, রাজনৈতিক তরজা যতটা হয়েছে, নাগরিকের তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন করার কাজ সে তুলনায় দেখা যায়নি। ভবিতব্য আপাতত ভাগ্যের হাতে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)