Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
শাসক দল ও মন্ত্রিসভার রদবদলে আছে রাজ্য রাজনীতির বার্তাও
Narendra Modi

যা রটল, তার কতটা ঘটল

পার্থ-কাণ্ডের পরে মন্ত্রিসভায় একটি বড়সড় রদবদল করার প্রয়োজনীয়তা মমতা বুঝেছিলেন। তাঁর বিবেচনায় ছিল সাধারণ মানুষের ‘পারসেপশন’।

মুখোমুখি: মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠক, দিল্লি, ৫ অগস্ট।

মুখোমুখি: মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠক, দিল্লি, ৫ অগস্ট। ছবি পিটিআই।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২২ ০৪:৫৪
Share: Save:

অমর্ত্য সেন কিছু দিন আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “রাজনীতি অনেকটাই নির্ভর করে তাকে কী ভাবে দেখা হচ্ছে, তার উপর।” সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, “এ দেশে রাজনীতিতে নীতির স্থান যতটা, তার চেয়ে ঢের বেশি ভূমিকা হল কৌশলের।”

আমরা দেখি, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সোজা কথা সোজা ভাবে বলতেই অভ্যস্ত। তাতে অবশ্য কারও কারও গায়ে ছ্যাঁকাও লাগে! ফলে প্রায়শই কোনও না কোনও দল অথবা ব্যক্তি তাঁর সম্পর্কে উষ্মা জাহির করেন, কটাক্ষও করেন।

সমাজ অমর্ত্যের বক্তব্য এবং তাঁর সমালোচনা, দু’টি নিয়েই আলোড়িত ও বিভাজিত হয়। কিন্তু অমর্ত্য সেনের ‘মান্যতা’ তাতে তিলমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় বলে মনে করি না। বরং এমন সমালোচনা কার্যত প্রমাণ করে, তাঁর ছোড়া তির ‘লক্ষ্যভ্রষ্ট’ হওয়ার নয়!

অমর্ত্যের সে দিনের ওই সব কথার প্রেক্ষিত ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও বিরোধী রাজনীতির অবস্থান। তার মধ্যে যাব না। তবে সামগ্রিক ভাবে তাঁর বক্তব্যটি খতিয়ে দেখলে সাম্প্রতিক রাজনীতির একটি অবয়ব ফুটে ওঠে। যা আজ আলোচনার বাইরে নয়।

রাজনীতিতে ‘পারসেপশন’ অর্থাৎ সাধারণ ধারণার গুরুত্ব একটি বহুচর্চিত প্রসঙ্গ। নেতা-নেত্রীরা এটা জানেন, মানেন এবং নেহাত ‘আত্মঘাতী’ হতে না-চাইলে চেষ্টা করেন খেয়াল রাখতে। পচা শামুকে পা কাটলে তাই দ্রুত ক্ষত সারাতেও তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

অন্য দিকে, বিশেষ বিশেষ নেতা-নেত্রী সম্পর্কে সাধারণের মনেও এক ধরনের পারসেপশন তৈরি হয়ে যায়। অনেকটা সময় জুড়ে তাঁদের নিয়ে ভিতরে ভিতরে সেই ছবিটি গড়ে উঠতে থাকে। তা সে ভাল বা মন্দ যেটাই হোক। খুব অনিবার্য কার্যকারণ ছাড়া সেটা বদলানো সহজ নয়। আবার পরিস্থিতি এলে সেইমতো তার বদল ঘটতেও বেশি সময় লাগে না। রাজনীতিতে এমন দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।

ভেবে দেখুন, বিপুল জনসমর্থনে আসা রাজীব গান্ধীকে পাঁচ বছরের মধ্যে ‘চোর হ্যায়’ শুনে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো পাঁচ দিনের মধ্যে লোকচক্ষে কলঙ্কিত হয়ে গেলেন! পাশাপাশি রাজ্যের সরকার ও শাসক দলকেও এক বেনজির পাকে জড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। যদিও এতে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার দিক আছে। তবু সাধারণ লোকের পারসেপশন এখানে সুদূরপ্রসারী। এমনটাই হয়।

আপাতত অন্য বিষয়ে ফিরি। পার্থ-কাণ্ডের পরে গত সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে রাজ্য রাজনীতিকে কেন্দ্র করে কিছু ঘটনা ঘটেছে। যা নিয়ে বহু রকম ধারণা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যার সঠিক, বেঠিক, আংশিক সত্য বা পুরোটাই মিথ্যে— কিছুই আমাদের মতো সাধারণের কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। ফলত, অমর্ত্য যেমন বলেছেন, এ ক্ষেত্রেও বিষয়গুলি বহুলাংশে নির্ভর করছে ঘটনাবলি কী ভাবে ‘দেখা হচ্ছে’ তার উপর।

প্রথমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি সফর। মমতা দিল্লি যাবেন এবং পর পর দু’দিন স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পালন সংক্রান্ত কর্মসূচিতে ও নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দেবেন, এটা অনেক আগেই স্থির হয়ে গিয়েছিল। দু’টিতেই যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উপস্থিত থাকবেন, তা নিয়েও কোনও ধোঁয়াশা ছিল না। ‘মোদী-দিদি সেটিং’-এর চর্চা পাকিয়ে উঠল তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন, সেটা জানার সঙ্গে সঙ্গে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তির নিরিখে তাতে আপাতদৃষ্টিতে অভিনবত্বও কিছু নেই। কারণ, উভয়ের মধ্যে সহস্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও সরকারি কাজের স্বার্থে এটা করতে হয়। কখনও আর্থিক দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য, কখনও অন্য নানা প্রশাসনিক কারণে মুখ্যমন্ত্রীরা তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে থাকেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জ্যোতি বসুর চরম রাজনৈতিক সংঘাতের সময়ও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠক করতে দিল্লি গিয়েছেন একাধিক বার। আর এই রকম স্তরের দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেশ কিছুক্ষণ একান্তে বৈঠক করলে সেখানে শুধুই ‘সরকারি’ কথা হবে, তেমনটি মনে করারও কোনও কারণ নেই। বরং, উল্টোটাই হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ষোলো আনা।

যেমন, এক বার ইন্দিরার সঙ্গে জ্যোতিবাবুর বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে একটি বড় ‘রাজনৈতিক’ খবর প্রকাশিত হয়েছিল। জ্যোতিবাবু খবরের সরাসরি প্রতিবাদ করেননি। শুধু একটু কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “রিপোর্টার কি তখন টেবিলের তলায় বসেছিলেন!” ফলে ধরে নেওয়া গিয়েছিল, যা রটে, তার কিছু বটে।

মোদীর সঙ্গে মমতার এ বারের বৈঠক নিয়েও সরকারি আলোচ্যসূচিকে ছাপিয়ে উঠেছে রাজনীতি। বৈঠকের সময়কাল এবং পারিপার্শ্বিক আবহ তার সবচেয়ে বড় উপাদান। অতএব তাঁদের বৈঠককে ওই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘দেখা’র পরিসর যথেষ্ট।

আর্থিক দাবিদাওয়ার বাইরে রাজ্যের সামনে এখন রাজনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের ‘সক্রিয়তা’। এতে কোনও ভুল নেই যে, আদালতের নির্দেশে একের পর এক অভিযোগের তদন্তে নেমে সিবিআই এবং ইডি যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘জাল’ ছড়াচ্ছে, তাতে সরকার ও শাসক দলের পক্ষে স্বস্তিতে থাকার কথা নয়। তবে তদন্তকারী সংস্থাগুলির উপর কেন্দ্রের শাসকদের প্রভাবও প্রশ্নাতীত নয়।

তা হলে ‘সেটিং’-এর যুক্তি ধরলে প্রথমেই ভাবতে হবে, মমতা হয়তো একান্ত বৈঠকে মোদীকে বলেছেন, ‘বাংলায় কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তে রাশ টানুন!’ বস্তুত এ বার মোদী-মমতা সাক্ষাৎকার ঘিরে এটিই ছিল বিভিন্ন মহলে প্রধান চর্চা।

তবে ‘সেটিং’ তো এক হাতে তালি বাজানো নয়। দেওয়া-নেওয়ার অঙ্কে চলে। তাই তেমন কিছু হয়ে থাকলে বিনিময়ে মোদী কী চাইতে পারেন মমতার কাছে, সেটাও পাশাপাশি ভেবে দেখার!

যদিও ওই বৈঠকের পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোথাও ‘ইতিবাচক’ কোনও ছাপ চোখে পড়ছে না। ইডি-সিবিআই তো লেগে আছেই। উপরন্তু দেখা যাচ্ছে, সব রাজ্যের জন্য একশো দিনের কাজের টাকা বরাদ্দ করা হলেও বাংলার ভাগে শূন্য!

তবে হ্যাঁ, এ বারের দিল্লি সফরে ‘দিদি খুশ হ্যায়’ কি না, তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সেটা জানার আগ্রহ মোদী দেখিয়েছেন! কেউ এর মধ্যে ‘অর্থ’ খুঁজতে চাইলে খুঁজতেই পারেন। শুধু লক্ষণীয় হল, মমতার দাবিমতো রাজ্য বকেয়া অর্থ পাবে কি না, সেই প্রশ্নে মোদী নীরবই থেকে যাচ্ছেন!

রাজনীতিতে ‘কৌশল’-এর ভূমিকা মাথায় রেখে অনেকেই অবশ্য মনে করেন, বৈঠকে যা-ই হয়ে থাকুক, মোদী আপাতত মমতার উপর নানা ভাবে ‘চাপ’ রেখে চলতে চাইবেন। আগামী এক বছরে বিরোধী জোট কী ভাবে দানা বাঁধে, সেখানে মমতার অবস্থান শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়, ছলে-বলে-কৌশলে কোন কোন বিরোধী সরকারকেই বা বিজেপি কব্জা করতে পারে, কিছুই এ ক্ষেত্রে তাদের ‘হিসেব’-এর বাইরে নয়। অতএব যতটা রটল, তার কতটা ঘটল সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

রাজ্যে সরকার এবং শাসক দলে এখন যা ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তা বোঝা বরং তুলনায় সহজ। আর সেই রাজনীতিও কম আকর্ষণীয় নয়। মমতার হাতে গড়া তৃণমূল এবং তাঁর তৈরি সরকারের উপর আগামী দিনে যা প্রভাব ফেলবে।

পার্থ-কাণ্ডের পরে মন্ত্রিসভায় একটি বড়সড় রদবদল করার প্রয়োজনীয়তা মমতা বুঝেছিলেন। তাঁর বিবেচনায় ছিল সাধারণ মানুষের ‘পারসেপশন’। একই ভাবে ছিল তৃণমূলে সাংগঠনিক কিছু পরিবর্তনের ভাবনাও।

দেখা যাচ্ছে, এগুলি দ্রুত কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলীয় পদে এবং মন্ত্রিসভায় অনেক নতুন মুখই তাঁর ‘পছন্দ’-এর। মমতাকে সামনে রেখে এটা অবশ্যই একটি অর্থবহ বার্তা। তৃণমূলে তো বটেই, রাজ্যেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE