ভারতের প্রযুক্তি-ধর্মী উন্নয়নে বর্তমানে এক বৈপরীত্য চোখে পড়বেই। এক দিকে পৃথিবীর অন্যতম দ্রুততম হারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত প্রযুক্তি গ্রহণ— আদালতের মামলার জট কমানো থেকে শুরু করে চাষবাস, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে নানা রকম সিদ্ধান্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে; কিন্তু অন্য দিকে এই প্রযুক্তি দেশে তৈরি হচ্ছে না, শুধু আমদানি করে প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রয়োগ আর উদ্ভাবনের মধ্যে এই বৈপরীত্য, এবং তার ফলস্বরূপ হওয়া অর্থনৈতিক বৃদ্ধি আর বিকাশ ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেন এ বারের অর্থনীতির নোবেলজয়ী তিন গবেষক: জোয়েল মকির, ফিলিপ আগিয়ঁ এবং পিটার হওয়িট। এঁরা কেউই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিজ্ঞানী নন, কিন্তু এঁদের কাজ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কী ভাবে উদ্ভাবন গড়ে ওঠে, আর কেন কিছু দেশ প্রযুক্তির অগ্রদূত হয়, আর কেউ হয় অনুসারী।
ফিলিপ আগিয়ঁ ও পিটার হওয়িটের কাজ দেখায় যে, উদ্ভাবন শুধু পুঁজি থাকলেই হয় না, প্রয়োজন সৃষ্টিশীল ধ্বংসেরও। অর্থাৎ নতুন প্রযুক্তি বা উদ্যোগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গতানুগতিক বাণিজ্যিক সংস্থা অবলুপ্ত হবে— এর ফলে সামগ্রিক ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। যে সব বড় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পুরনো পদ্ধতিতে লাভ করছে, তারা অবশ্যই চাইবে না যে, প্রতিযোগিতা বাড়ুক। তাই সরকারের দায়িত্ব প্রতিযোগিতা আর উদ্ভাবনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু প্রতিযোগিতা যদি আবার অতিরিক্ত হয়, তা হলে কেউই উদ্ভাবনের রসদ পাবে না— বাজারে টিকে থাকাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াবে। আগিয়ঁ দেখিয়েছেন, যে সব খাতে মাঝারি মাত্রার প্রতিযোগিতা আছে, সেখানেই উদ্ভাবন সবচেয়ে বেশি হয়।
এই তত্ত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ ঘরের কাছেই। কোভিড অতিমারির সময় এডটেক বা শিক্ষাপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির মধ্যে যখন অতি মাত্রায় প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন অন্যের চেয়ে বেশি ছাড় দেওয়ার দৌড়ে তারা শিক্ষণ-পদ্ধতি উন্নত করা বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ব্যক্তিগত পাঠ তৈরি করার দিকে মন দিতে পারেনি। ফলে আজ ভারতীয় শিক্ষাপ্রযুক্তি ক্ষেত্র ধুঁকছে। কিন্তু ঔষধ নির্মাণ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা একটি সুস্থ উদ্ভাবন সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। সিপলা, ডক্টর রেড্ডিজ় বা বায়োকন-এর মতো সংস্থাগুলি একে অপরের সঙ্গে লড়াই করেও নতুন জেনেরিক ওষুধ এবং গবেষণানির্ভর প্রযুক্তি তৈরি করে চলেছে। অল্প কয়েকটি দক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও বাজারে জায়গা আছে নতুনদের জন্য। ফলাফল, বিশ্বের বাজারে ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প এখন অগ্রগণ্য। ভারতীয় সফটওয়্যার সার্ভিস এবং ‘ডিপ-টেক’ সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেও একই ছবি দেখা যায়— বড় সংস্থা একচেটিয়া নয়, আবার অগুনতি সংস্থা বাজার ভরিয়ে দেয়নি। ফলে, এ সব শিল্পে সংস্থাগুলি দাম কমানোর পথে না হেঁটে পণ্যের গুণমান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে জোর দিচ্ছে।
এ বছর নোবেল পুরস্কারে ভূষিত এই গবেষণা ভারতীয় অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ যে প্রযুক্তি-ভিত্তিক বৃদ্ধিনির্ভর হবে, সেই পরিকল্পনা সুস্পষ্ট। দেশের স্টার্ট আপ বাস্তুতন্ত্র উৎসাহব্যঞ্জক, ফিনটেক বা অর্থনৈতিক প্রযুক্তি পরিকাঠামো আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশংসিত এবং বিশ্বের বৃহত্তম বায়োমেট্রিক পরিচয় ব্যবস্থা এখন বিশ্বের বাজারে অপ্রতিম। কিন্তু মৌলিক গবেষণা, পেটেন্ট, নিজস্ব এআই-মডেল তৈরিতে, ঝুঁকিপূর্ণ গবেষণা-উন্নয়নে, আর প্রান্তিক প্রযুক্তি-পণ্য রফতানিতে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে ভারতীয় শিল্পমহল। আগিয়ঁ ও হওয়িটের তত্ত্ব বলছে যে, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য শুধু প্রয়োগ-ভিত্তিক প্রযুক্তি যথেষ্ট নয়— মৌলিক উদ্ভাবনের অনুকূল পরিবেশ দরকার।
এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান গবেষণায় বিনিয়োগ, আর বিশ্বমানের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর সঙ্গে দরকার দেশীয় সংস্থাগুলিকে ঝুঁকি নেওয়ার জন্য যথাযথ উৎসাহ দেওয়া। আগিয়ঁ-র গবেষণায় ফ্রান্সের গবেষণা কর-ছাড় প্রকল্প নিয়ে বিশ্লেষণ দেখা যায়। তিনি দেখান যে, বড় সংস্থাগুলি এই ভর্তুকি ব্যবহার করে গতানুগতিক কাজ চালিয়ে যায়, অথচ ছোট ও নতুন সংস্থাগুলি এটিকে ব্যবহার করে নতুন উদ্ভাবনের রসদ হিসাবে। এই পর্যবেক্ষণের বার্তা স্পষ্ট— যদি নীতিনির্ধারণ সক্রিয় ভাবে নতুন প্রবেশকারীদের পক্ষে ভারসাম্য না গড়ে দেয়, তা হলে মুষ্টিমেয় কিছু পুরনো, প্রতিষ্ঠিত সংস্থার হাত ধরে উদ্ভাবন বা উন্নয়ন কোনওটাই সম্ভব না-ও হতে পারে। ভারতের বর্তমান গবেষণা অনুদান ও স্টার্ট আপ ভর্তুকিগুলি আরও লক্ষ্যভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং ঝুঁকিসহনশীল হওয়া দরকার— বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক স্পিন-অফ, এবং টিয়ার-২ ও টিয়ার-৩ শহরের প্রারম্ভিক উদ্ভাবকদের জন্য। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ডিপ-টেকের ভবিষ্যৎ মুষ্টিমেয় বাণিজ্যিক পরিবারের হাতে থাকলে উদ্ভাবনও সীমিত থাকবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অর্থনৈতিক প্রভাব একই সঙ্গে আশা ও আশঙ্কা জাগিয়ে তোলে। এক দিকে, এটি জ্ঞানকে সর্বজনীন করতে পারে, শাসনপ্রণালীকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারে, এবং নাগরিক পরিষেবাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলার ক্ষমতা রাখে। অন্য দিকে, এটিই আবার কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা জোরদার করতে পারে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার পরিসরকে ক্রমে সঙ্কীর্ণতর করতে পারে, বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, এমনকি মানুষের কর্মসংস্থানকেই বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ বারের নোবেল-পুরস্কারের অর্ধাংশ-জয়ী জোয়েল মকিরের গবেষণা দেখায় যে, উদ্ভাবন নিছক প্রযুক্তিগত নয়, সেটি রাজনৈতিকও।
মকিরের গবেষণার ক্ষেত্র অর্থনীতির ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকে চিনের ধনসম্পদ ও কারিগরি দক্ষতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমকক্ষ ছিল। তবু শিল্পবিপ্লবের শুরু ইংল্যান্ডে। কেন? কারণ তৎকালীন ইংল্যান্ডে নতুন চিন্তাকে উৎসাহ দেওয়া হত, প্রশ্ন করার স্পর্ধাকে প্রশ্রয় দেওয়া হত, এবং গবেষকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল। চিনে তখন সমাজব্যবস্থা ছিল শ্রেণিবদ্ধ ও চিন্তাভাবনা ছিল রক্ষণশীল। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আসে সমাজে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা ও ঝুঁকি নেওয়ার পরিবেশ থাকলে। কাজেই উদ্ভাবন শুধুই প্রকৌশলবিদ্যার ফল নয়— এটি এক গভীর সাংস্কৃতিক অর্জন।
এই জায়গাটাই এ বারের নোবেলের সবচেয়ে বড় প্রাসঙ্গিকতা। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষাই শেষ কথা— বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনাকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট তৈরি হয়নি। অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, গবেষণাধর্মী লেখাও রাজনৈতিক দাঁড়িপাল্লায় মাপা হয়, বা গবেষকরা বিতর্ক এড়াতে আত্ম-নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হন। মকিরের গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয় যে, প্রতিবাদ করার জায়গা না থাকলে উদ্ভাবন সম্ভব নয়। কেউ প্রশ্ন করলে যে সমাজ ভয় দেখায়, সে সমাজ ভবিষ্যতের সমাধান সহজে পায় না।
২০২৫ সালের অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার কোনও নির্দিষ্ট প্রযুক্তিকে সম্মান জানায়নি— জানিয়েছে একটি প্রক্রিয়াকে। এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে সমাজ এমন পরিকাঠামো তৈরি করে, যেখানে ভুল থেকে সহজেই শিক্ষা নিয়ে উঠে আসতে পারে পথিকৃৎ উদ্ভাবন। ভারতের ডিজিটাল পরিকাঠামো— আধার, ইউপিআই, ডিজিলকার— আজ আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত। এর ফলে জনপরিষেবার পরিধি ও গতি দুই-ই বেড়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এই সমস্ত ব্যবস্থাপনা মূলত পরিষেবা প্রদানের মাধ্যম, উদ্ভাবনের নয়। ভারতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ কেবল ‘স্কেল’ বা আয়তনের দাপটে গড়ে উঠবে না। আসন্ন প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হতে মৌলিক নকশা ও ধারণার স্তরেও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করা প্রয়োজন। সেই পথে অগ্রসর হতে দেশের প্রশাসকদের অর্থনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও বৌদ্ধিক স্বাধীনতার প্রতি আরও গভীর অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে। উদ্ভাবনের ভিত যে প্রযুক্তিতে নয়, স্বাধীন চিন্তায়— সেটা আরও দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিংগেন
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)