E-Paper

স্বদেশজননীর রূপ ও রূপক

বাংলায় জাতিকল্পনায় ছিল দু’টি জাতি, ভারতীয় ও বাঙালি। ‘হিন্দু’ ও ‘আর্য’ ধারণা দু’টি ছিল সর্বভারতীয় জাতিত্বের ভিত্তি এবং প্রধানত ‘অতীতগৌরববাহিনী’। ভারতমাতা জ্ঞান ও কর্মের ঐতিহ্যে ও প্রাকৃতিক সম্পদে গরিমাময় এক নারী, কিন্তু বর্তমান দুর্গতিতে বিলাপরতা।

অনুরাধা রায়

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:২১
শক্তিসুদীপ্তা: ‘ভারতমাতা’

শক্তিসুদীপ্তা: ‘ভারতমাতা’ ছবি: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যাকে বলে মানুষের যৌথ অবচেতনা বা ‘কালেক্টিভ আনকন্‌শাস’— স্মরণাতীত কাল থেকে তা প্রবহমান। সেখানে লালিত যত ‘আর্কিটাইপ’ অর্থাৎ রূপকল্প ভাবকল্প, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য মাতৃ-কল্প বা ‘মাদার আর্কিটাইপ’। মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল ইয়ুং-এর এই তত্ত্ব নিয়ে একদা সংশয় থাকলেও আজকের বিজ্ঞান তা অনেকটাই প্রতিপন্ন করেছে। জন্মদাত্রী, পালয়িত্রী, রক্ষাকর্ত্রী— এই সব ধারণার সংশ্লেষে তৈরি ‘মাদার আর্কিটাইপ’-এর প্রধান অভিব্যক্তি জননী ও জন্মভূমি। পৃথিবী গ্রহটাই জন্মভূমি; তাই অধিকাংশ ধর্মেই পৃথিবী মাতৃদেবতা। তারই খণ্ডিত রূপ— একটি ছোট গ্রাম থেকে শুরু করে জাতিরাষ্ট্র, সবই মাতৃভূমি হতে পারে। প্রসঙ্গত, রামায়ণের ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ জন্মভূমি হল অযোধ্যা।

বাংলা তথা ভারতে উনিশ শতকের মাঝামাঝি ‘নেশন’ তথা জাতির কল্পনা সূচিত হলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই জাতির দেশ হল মা। একদম গোড়ার দিকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় ‘জননী ভারতভূমি’ থেকে ১৮৭৩-এ মঞ্চস্থ ‘ভারতমাতা’ নাটক ইত্যাদি তার অনেক দৃষ্টান্ত। তবে দেশের মাতৃমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ১৮৭৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ গানে। গানটি বহুবিতর্কিত এবং বিতর্ক সম্প্রতি পুনরুজ্জীবিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে তার ইতিহাসটা বুঝে নেওয়া জরুরি। বিবিধগামী ও পরিবর্তমান জাতিকল্পনার সে এক জটিল ইতিহাস।

বাংলায় জাতিকল্পনায় ছিল দু’টি জাতি, ভারতীয় ও বাঙালি। ‘হিন্দু’ ও ‘আর্য’ ধারণা দু’টি ছিল সর্বভারতীয় জাতিত্বের ভিত্তি এবং প্রধানত ‘অতীতগৌরববাহিনী’। ভারতমাতা জ্ঞান ও কর্মের ঐতিহ্যে ও প্রাকৃতিক সম্পদে গরিমাময় এক নারী, কিন্তু বর্তমান দুর্গতিতে বিলাপরতা। অতীতমুখী হওয়ায় এই জাতি ভারত থেকে বেশ বিচ্ছিন্ন। ফলে তা সম্ভ্রম জাগাত বটে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা তেমন নয়।

বাঙালি জাতি কিন্তু নিছক অতীত থেকে আহৃত নয়। প্রতি দিনের সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা দিয়ে তা রচিত হচ্ছিল। বাঙালিত্ব ছিল সকলে মিলে ভাগ করে নেওয়া অন্তরতর হৃদয়ের ভাবনা। কাব্যে স্বদেশপ্রকৃতির সবচেয়ে আবেগাপ্লুত বর্ণনাও বঙ্গপ্রকৃতির, বাংলাই কবিদের পরম ভালবাসার জায়গা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মানবায়নের মাধ্যমেই রচনা হত বঙ্গমাতার ‘মধুর মুরতি’। এই মা ঘরোয়া ঘনিষ্ঠ, যেন নিজেরই মা, যার রূপ নিরীক্ষণে ও বাণী শ্রবণে পরম তৃপ্তি। ‘বন্দে মাতরম্’, অন্তত তার প্রথম দু’টি স্তবক, এ ব্যাপারে পথপ্রদর্শক।

তবে কখনও কখনও ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যে শক্তির উৎস হিসেবে কল্পিত দুর্গা বা কালীর সঙ্গেও দেশমাতা সমীকৃত হতেন। জাতীয়তাবাদীরা হয়তো ভেবেছিলেন, হাতের কাছে যখন মাতৃদেবীরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে স্বদেশকে মিলিয়ে নিতে অসুবিধা কোথায়? তা ছাড়া পরাধীন দেশের তো শক্তি বড়ই প্রয়োজন। তাই ‘বন্দে মাতরম্’-এর তৃতীয় স্তবক থেকে দেশমাতা তথা বঙ্গমাতার ধর্মীয় চরিত্র (সে অবশ্য আনন্দমঠ-এর কাহিনির প্রয়োজনে কয়েক বছর পরে সংযোজিতও বটে)। তবে উনিশ ও বিশ শতকেও দীর্ঘ দিন পর্যন্ত দেশমাতার মানবিক চরিত্রই প্রবল ছিল। তাই অপৌত্তলিক ব্রাহ্ম ও মুসলমান কবিদেরও ‘মা বলিতে প্রাণ করে আনচান’।

গোড়ার দিকের জাতীয়তাবাদী গান-কবিতার সমীক্ষা আরও দেখায়, সচরাচর বাঙালি ও ভারতীয় জাতি সমান্তরাল ভাবেই থাকত, দুইয়ের মধ্যে বিরোধ না থাকলেও সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা ছিল। এদের তুলনামূলক শক্তি এক-এক জনের মনে ছিল এক-এক রকম। তবে মোটের উপর, যত ক্ষণ জাতীয়তাবাদীরা জাতির প্রাচীন গৌরব স্মরণ করে বিলাপ করছিলেন, হিন্দু জাতি তাঁদের পক্ষে ভালই ছিল। কিন্তু যখনই তাঁরা আত্মঘোষণায় উন্মুখ, বর্তমানে সক্রিয় ও ভবিষ্যৎমুখী এক জাতির কল্পনা করলেন, যে প্রক্রিয়াটা শুরু হয় ১৮৮০-৯০’এর দশক থেকে এবং ক্রমে স্বাধীনতাস্পৃহার দিকে যায়, তখনই সচরাচর মানসপটে ভেসে উঠত বাঙালি জাতি। এ ক্ষেত্রেও বঙ্কিম পথিকৃৎ। ১৮৭৫-এই তিনি অস্পষ্ট হলেও একটা রাজনৈতিক পরিণতির কথা ভেবেই জাতির জন্য বাহুবলের আবাহন করেছিলেন। আর ‘সপ্তকোটিকণ্ঠকলকলনিনাদকরালে/ দ্বিসপ্তকোটিভুজৈর্ধৃতখরকরবালে’ যে জাতির ছবি এঁকেছিলেন, সে বাধ্যতই বাঙালি।

বঙ্কিমচন্দ্রের বাঙালিত্বের বোধ তাঁর ভারতীয়ত্বের থেকে স্পষ্টতই বলশালী ছিল। ‘বন্দে মাতরম্’ পড়ে বন্ধু নবীনচন্দ্র সেন বঙ্কিমকে বলেছিলেন, এটি এক দিন সমগ্র ভারতবর্ষের ‘মার্সেলেস গীতি’ হবে, কিন্তু বাংলা লাইনগুলি বসিয়ে তিনি গানটিকে মাটি করেছেন। তাঁর উচিত, ওই লাইনগুলি বদলে পুরো গানটাই সরল সংস্কৃত করে দেওয়া এবং ‘সপ্তকোটি’র জায়গায় ‘ত্রিংশ কোটি’ বসানো। কথাটা বঙ্কিমের মোটেও পছন্দ হয়নি। নবীনচন্দ্র নিজে কিন্তু পলাশীর যুদ্ধ-র দ্বিতীয় সংস্করণে বহু স্থানে ‘বঙ্গ’ কেটে ‘ভারত’ করেছিলেন।

বিশ শতকের গোড়ায় স্বদেশি যুগে জাতীয়তাবাদী সক্রিয়তা তুঙ্গে, ‘বন্দে মাতরম্’ গান ও স্লোগান বিরাট উদ্দীপনার উৎস। সেটা বাঙালি জাতীয়তাবাদেরও স্বর্ণযুগ। মুসলমান কবিরাও তখন বঙ্গমাতায় মুগ্ধ। ভারতমাতাকে সম্ভ্রমসূচক ‘তুমি’ সম্বোধন করা হলেও বঙ্গমাতাকে প্রায়শই ঘনিষ্ঠতাসূচক ‘তুই’। যদিও ভারতীয়তাকেও মর্যাদা দিতে ১৯০৫-এর বেনারস কংগ্রেস অধিবেশনে সরলা দেবী ‘বন্দে মাতরম্’ গাইলেন ‘সপ্তকোটি’র জায়গায় ‘ত্রিংশ কোটি’ বসিয়ে।

কিন্তু গোলমালটা বাধল স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকেই, ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতার ফলে। গানটি— বিশেষত তৃতীয় স্তবক থেকে— অনেক মুসলমানের পৌত্তলিকতা-দুষ্ট মনে হল। ‘সপ্তকোটি’র মধ্যে তো মুসলমানরাও পড়ে এই যুক্তির প্রতিযুক্তি তাঁরা দিলেন— তা হলে দেশমাতাকে দুর্গা কল্পনা করা হল কি মুসলমানদের হিন্দুদের অধীন ও হীন করে রাখার জন্য? (আল ইসলাম, ১৯১৬) দেশমাতার ধারণাটাই অনেকের পৌত্তলিকতা মনে হল। অবশ্য রেজাউল করীম মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, আরবি ভাষাতেও দেশকে মা-ই বলে (বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ, ১৯৩৭)। দেশের মাতৃকল্পনা স্বতঃস্ফূর্ত হলেও, দেশবাসীর একাংশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁর বন্দনা বাধ্যতামূলক করা উচিত নয়— এই যুক্তিতে ১৯৩৭-এ কংগ্রেস অধিবেশনে জাতীয় মঞ্চে গানটির শুধুমাত্র প্রথম অংশই গাওয়া হয়।

বিমূর্ততা মানুষের বেশি সয় না, প্রতীক রূপক দিয়ে বিমূর্তকে মূর্তি বানিয়ে সে স্বস্তি পায়। দৃষ্টান্ত পশ্চিমি সংস্কৃতির লিবার্টি বা জাস্টিস। মূর্তিমতী স্বদেশভূমির দৃষ্টান্ত ব্রিটানিয়া, যা ভারতমাতার প্রতিমা নির্মাণেও প্রভাব ফেলেছিল। ধর্মহীন সোভিয়েট ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ের উদ্‌যাপনে ভলগোগ্রাডে প্রতিষ্ঠা করেছিল ‘মা রাশিয়া’র মূর্তি। ভারতেও দেশ স্বাভাবিক ভাবেই মা— দেবী হয়েও মানবী। প্রথম দিকে তাঁর হিন্দু চরিত্র অপ্রধান ছিল। ঔপনিবেশিক যুগে হিন্দু আইকনোগ্রাফি-র বাইরে ভিখারিণী বা দলিত সন্তানদের জন্য ক্রন্দনরতা মা হিসেবেও ভারতমাতাকে আঁকা হয়েছে (যথাক্রমে অমৃতা শের-গিলের ছবি ও কুসুমা ধর্মন্নার বইয়ের মলাট)। কিন্তু একটা ক্রমবিবর্তন লক্ষণীয়। নিছক ভাষাভিত্তিক দেশমাতার ভাবনা থেকে স্নেহ, সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি দিয়ে তাঁর প্রতিমা নির্মাণ; ক্রমে কিন্তু হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁর চিত্রায়ণের প্রাধান্য বিস্তার। ফলে ‘বন্দে মাতরম্‌’ নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক গোলমালটি আজও মিটল না। আমাদের কল্পনা তার জন্য দায়ী নয়। দায়ী অসংবেদনা, অসহিষ্ণুতা, আগ্রাসনের প্রবৃত্তি। বরং স্বদেশের মাতৃকল্পনার মধ্যেই ছিল হিন্দু-আর্য মিথ-ভিত্তিক সঙ্কীর্ণ জাতীয়তা থেকে উদার মুক্তির সম্ভাবনা। দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করলে, একই মাটির বুকে যাদের জন্ম ও বড় হওয়া, সেই হিন্দু আর অ-হিন্দুদের পৃথক ভাবা যায় না।

আজ ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির মূল তাৎপর্য পুনরুদ্ধারের নামে বলা হচ্ছে, মুসলমানদের ভাবাবেগকে মর্যাদা দিয়ে গানটিকে খর্বিত করে কংগ্রেস খুব গর্হিত কাজ করেছে। তারও আগে ‘সপ্তকোটি’র জায়গায় ‘ত্রিংশ কোটি’ বসানো অনুমোদন করে তা হলে কংগ্রেস কম অন্যায় করেনি। গানটিকে শুধুমাত্র হিন্দুদের গান করে তুলতে চাইলে শুধুমাত্র বাঙালিদের গান হিসেবেও মেনে নিতে হবে কিন্তু। তাতে সুবিধা হবে কি?

আসল প্রশ্ন হল, আমরা কী ভাবে বাঁচতে চাই? আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রিক অস্তিত্বকে সঙ্কুচিত করে, না প্রসারিত করে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Abanindranath Tagore Bankim Chandra Chattopadhyay

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy