একশো ছত্রিশ বছর আগে, ১৮৮৯ সালে, দশমবর্ষীয়া মৃতা বালিকাবধূ ফুলমণি দাসীর যোনিদেশে ‘লম্বালম্বি পৌনে দু’ইঞ্চি’ আঘাতচিহ্ন পেয়েছিলেন ডাক্তার। ২০১৭ সালে ছত্তীসগঢ়ের পনেরো বছরের মেয়েটির পায়ুদেশের আঘাতও ছিল মারাত্মক। ফুলমণি আর তার উত্তরসূরির মিল হল, উভয়েরই নির্যাতক তাদের ‘স্বামী’।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে ‘সম্রাজ্ঞী বনাম হরিমোহন মাইতি’ মামলাটি এত শোরগোল ফেলেছিল যে, তাকে ‘ধর্ষণ ও খুন’ চিহ্নিত করতেই হয়েছিল ব্রিটিশদের। ১৮৯১ সালে ‘যৌনতার সম্মতি’ বিষয়ক নতুন আইনে মেয়েদের ‘সম্মতির বয়স’ বেড়ে হয়েছিল বারো। হরিমোহন মাইতির অবশ্য মাত্র এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড জুটেছিল, কারণ পূর্ববর্তী আইনানুসারে দশমবর্ষীয়া ফুলমণিও ছিল ‘বিবাহযোগ্যা’। ‘সম্মতির বয়স’ নানা পরিবর্তনের পর এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আঠারো। কিন্তু বিবাহিতা নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি গোলমেলে।
১৮৬০ সালের ‘ভারতীয় দণ্ডবিধি’ অনুযায়ী, স্ত্রীর সঙ্গে ‘বলপূর্বক সঙ্গম’ ধর্ষণ ছিল না, কারণ ইংল্যান্ডের চিফ জাস্টিস স্যর ম্যাথু হেল বলেছিলেন, ‘স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারেন না। বৈবাহিক চুক্তি অনুযায়ী, স্ত্রী নিজেকে বস্তু হিসাবে স্বামীকে দান করেছেন।’ স্বাধীনতার পরেও ভারতীয় দণ্ডবিধি ঔপনিবেশিক প্রভুদেরই অনুসরণ করেছিল।
২০১৩ সালের বর্মা কমিটির রিপোর্ট ধর্ষণের সংজ্ঞা সম্প্রসারণ ও নানা সংস্কারের প্রস্তাব ছাড়াও বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব আনে। ইউপিএ সরকার সে প্রস্তাব খারিজ করে বলে, ‘এতে পরিবারপ্রথা সমস্যায় পড়বে।’ সুতরাং, আইপিসি-র ধারা ৩৭৫-এ (ধর্ষণের ধারা, যা এখন ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৩ নম্বর ধারা) যুক্ত হল ‘দ্বিতীয় ব্যতিক্রম’টি: বিবাহিত স্ত্রী অভিযোগকারিণী হলে, তাকে ধর্ষণ ধরা হবে না। এই ব্যতিক্রমের কারণে, আরও অনেকের মতো, সম্প্রতি ছাড়া পেল ছত্তীসগঢ়ের ব্যক্তি।
বাল্যবিবাহ যে-হেতু এখনও ঘটে, তাই বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে ‘সম্মতির বয়স’ ধরা হয়েছিল পনেরো বছর। এ দিকে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৭ সালে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট থট বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় রায় দিয়েছিল, বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রেও ‘সম্মতির বয়স’ আঠারোই হওয়া উচিত। না হলে তা অন্যান্য আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সে কথা কি ছত্তীসগঢ় হাই কোর্ট ভুলল? আবার, ২০১৭ সালের রায়কেই যদি মান্য ধরি, তা হলেও আঠারোর উপরে বিবাহিতা মেয়েদের কোনও সুরক্ষা-কবচ নেই, থাকতে পারে না।
বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে বিজেপি সরকারেরও একই সুর। হরিভাই পার্থিভাই চৌধরি বা মেনকা গান্ধী, সবাই বলে থাকেন যে, ‘বৈবাহিক ধর্ষণ ভারতে বেমানান।’ অথচ, ২০২২ সালে কর্নাটক হাই কোর্ট এক উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছিল: কোনও কোনও ঘটনায় নির্মমতা এত প্রবল যে, বিবাহের মধ্যেও ‘ধর্ষণ’ শব্দটি বাদ দেওয়া অন্যায়!
ফুলমণি বা ছত্তীসগঢ় ব্যতিক্রম নয়। হয়তো সকলে মারা যান না। কিন্তু চার পাশে তাঁরা আছেন। তবে, তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলনের ঘটনাগুলিকে তাঁরা ‘আপত্তি অগ্রাহ্য’ করা হিসেবেই চিহ্নিত করেন, ধর্ষণ নয়। কারণ ভারতে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ কথাটি প্রযোজ্য না’। যেন বিয়ে এক চিরস্থায়ী যৌন চুক্তি। অথবা যৌনতায় সামাজিক স্বীকৃতির সিলমোহর লাগানোর অনুষ্ঠানই বিয়ে। বৈবাহিক সম্পর্কে ‘বলপূর্বক সঙ্গমও ধর্ষণ নয়’ বলার সময় হয়তো কেউ লক্ষ করেন না যে, ‘বলপূর্বক সঙ্গম’ কথাটিই স্ববিরোধী। ধর্ষণ/বলপ্রয়োগ এবং সঙ্গম একে অন্যের বিপ্রতীপ।
পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশার ১৮-৪৯ বছর বয়সি আশি হাজার মেয়ের উপরে হওয়া জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তৃতীয় দফা পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের ৯% পরিবারে ধর্ষণের শিকার; তার মধ্যে ৯৩% ক্ষেত্রে ধর্ষক তাঁদেরই ‘স্বামী’। ওই পরিসংখ্যান এবং এনসিআরবি-র পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ২০১৪ সালে আশিস গুপ্তর গবেষণাপত্র জানায়, বৈবাহিক ধর্ষণের ক্ষেত্রে এক শতাংশেরও কম মহিলা রিপোর্ট করেন।
আইনের দ্বিচারিতার নানা পরত। হিন্দু বিবাহ আইনে স্ত্রী ‘নিষ্ঠুরতা’র কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। ৪৯৮/ক ধারাতেও ‘ক্রুয়েলটি ইন ম্যারেজ’ ছিল উল্লিখিত। কিন্তু স্পষ্ট করে ‘যৌন নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা’র উল্লেখ নেই। এ দিকে গৃহহিংসা প্রতিরোধক ‘প্রোটেকশন অব উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট, ২০০৫’ দেওয়ানি আইনে ‘যৌন নির্যাতন’-এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে। দেওয়ানি আইন ভুক্তভোগীকে উপশম দেয়, ফৌজদারি আইন অপরাধীকে শাস্তি দেয়। অর্থাৎ, ‘স্বামী’ যৌন নির্যাতন করলে, নালিশ করলেও, তা করতে হবে অপরাধীর শাস্তির আশা বাদ দিয়ে!
১৯৯৩ সালের মধ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশে, ২০০৫ সালে তুরস্কে, ২০০৬ সালে নেপালে, ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ায়, ২০১৩-তে বলিভিয়ায় বৈবাহিক ধর্ষণ আইনত দণ্ডনীয় হয়। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানায়, ১০৪টি দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য— কোথাও আলাদা ধারায়, কোথাও সাধারণ ধর্ষণ ধারায়। কিন্তু ভারত, চিন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, সৌদি আরবের মতো ৫৩টি দেশে যথাযথ আইনের অভাবে এখনও তা বেলাগাম। যখন বলা হয়, বৈবাহিক ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য হলে ‘পরিবার ও বিবাহপ্রথা বিলুপ্ত হবে’, তখন বোধ হয় প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয় যে, নারীনির্যাতনের বিনিময়েই প্রথাদ্বয় টিকে আছে।
তবে, বিবর্তনের যুক্তি প্রয়োগ করে কেউ এমনটাও ভাবতে পারেন যে, অভিযোজনহীনতা যে-হেতু বিলোপের প্রাকৃতিক কারণ, তাই পরিবার ও বিবাহপ্রথা নামক প্রতিষ্ঠান দু’টি যদি নারীর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ধারণা অনুযায়ী নিজেকে অভিযোজিত করতে না পারে, তা হলেই বরং তাদের বিলোপ অনিবার্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)