বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার (১৯২৯) অভিঘাতে ইউরোপে যখন ফ্যাসিবাদ ছড়াচ্ছে, সেই সময়ে এক প্রতিবাদী সংস্কৃতি দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৩৫ সালে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রী সঙ্ঘের জমায়েত হয় প্যারিসে। সেই বছরেই ইংল্যান্ড-প্রবাসী দুই ভারতীয় তরুণ লেখক, সাজ্জাদ জাহির এবং মুলক্রাজ আনন্দ, উদ্যোগ নিয়ে লন্ডনে স্থাপন করেন প্রগতিবাদী লেখক সঙ্ঘ। অনুরাধা রায়ের বইয়ে পাচ্ছি হীরেন মুখোপাধ্যায়, ভবানী ভট্টাচার্য, ইকবাল সিংহ, রাজা রাও প্রমুখ এই সঙ্ঘের সদস্য হন। লন্ডনের লেফট রিভিউ পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁদের ইস্তাহার। মুন্সী প্রেমচন্দের উৎসাহে তার হিন্দি অনুবাদ ছাপা হয় হংস পত্রিকায়। মাত্র এক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠান বেশ বড় আকারে আত্মপ্রকাশ করল লখনউতে। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্মেলনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হল সর্বভারতীয় প্রগতিবাদী লেখক সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলন, মুন্সী প্রেমচন্দের পৌরোহিত্যে। রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র আশীর্ব্বাণী পাঠালেন। রশিদা জাহান, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, সুমিত্রানন্দন পন্থ, আব্বুরি রামকৃষ্ণ রাউ, সরোজিনী নায়ডু, যশপাল-সহ বহু লেখক-লেখিকা সম্মেলনে যোগ দিলেন।
ভারতে গড়ে উঠল একটি নতুন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। যার প্রবক্তারা দেশের সমস্ত লেখক-শিল্পীকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন রক্ষণশীলতার নিগড় ভাঙতে। দারিদ্র, ক্ষুধা, শোষণ-যন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে শিল্পের মাধ্যমে চিনিয়ে দিতে। এই সঙ্ঘ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা চালিত কি না, তা নিয়ে ব্রিটিশ শাসক চিন্তিত হয়ে পড়েন। তৎকালীন হোম সেক্রেটারি এম জি হ্যালেট তাঁর সার্কুলারে সতর্ক করেন যে প্রগতিবাদীরা শ্রেণি সচেতনতা, শ্রেণি বিদ্বেষ প্রচার করছেন। এঁদের থেকে ভারতের সাধারণ বিদ্বজ্জনদের দূরে রাখার কৌশল করতে হবে। বাংলায় প্রগতিবাদীদের প্রথম সম্মেলন হয় ১৯৩৬-এর অগস্টে, সদ্যপ্রয়াত ম্যাক্সিম গোর্কির স্মরণসভার মাধ্যমে। অ্যালবার্ট হলের সেই সভার অন্যতম আহ্বায়ক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ বার্তা পাঠান। অচিরে ঢাকাতে একটি শাখা খোলা হয়, অসম আর ওড়িশাতেও কাজ শুরু হয়।
১৯৩৯-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের বামপন্থীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়, কী হবে ভারতীয়দের অবস্থান? ১৯৪১-এ হিটলার সোভিয়েট ইউনিয়ন আক্রমণের পর ভারতীয় কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ আখ্যা দেন, এবং জার্মানির বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এই বিতর্কের প্রভাব প্রগতিবাদী লেখক-শিল্পী সঙ্ঘের কাজেও পড়েছিল। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর এবং স্বাধীনতা লাভের পরেও কমিউনিস্ট পার্টির লাইন নিয়ে বিতর্ক থামেনি পরবর্তী এক দশক। তবে এই টালমাটাল সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন চতুষ্কোণ, চিহ্ন, শহরবাসের ইতিকথার মতো উপন্যাস। স্বরলিপি উপন্যাসে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সাবিত্রী রায় পার্টি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, তবু পাকা ধানের গান-এর মতো মহতী উপন্যাসে ধরে রেখেছেন সাম্যবাদ। সোমনাথ হোর উত্তরবঙ্গের চা-বাগান শ্রমিকের আন্দোলন থেকে তেভাগার লড়াই রেখায় রেখায় ধরে রেখেছেন।
এর মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের খাদ্য-সংগ্রহের নিষ্ঠুর নীতির ফলে ১৯৪২-এ ভয়ঙ্কর মন্বন্তর শুরু হল। অন্তত ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারালেন। ফ্যাসি-বিরোধী প্রগতিবাদীরা রিলিফের কাজ শুরু করলেন। কমিউনিস্ট মহিলারা গড়ে তোলেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত নন, এমন বহু মেয়ে তাতে যোগ দেন। লীলা মজুমদারের আত্মজৈবনিক লেখায় তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিবরণ পাই। সুনীল জানার ফোটোগ্রাফে, জয়নুল আবেদিন আর চিত্তপ্রসাদের কালির আঁচড়ে, পি সি জোশীর রিপোর্টে ধরা আছে দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক ছবি। বিজন ভট্টাচার্যের লেখা, শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় নবান্ন নাটক মূর্ত করল মন্বন্তরের ইতিহাস। এ হয়তো বামপন্থী সংস্কৃতির সাবালক হয়ে ওঠার সময়। নবান্নের দুই মুখ্য অভিনেত্রী, শোভা সেন এবং তৃপ্তি মিত্র, নিজের নিজের আত্মকথায় লিখে রেখেছেন এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের কথা— এক দিকে মন্বন্তর, অন্য দিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তা মিলে যাচ্ছে নারীমুক্তির আদর্শের সঙ্গে।
এই সময়েই তৈরি হল আর একটি সংগঠন। ১৯৪১-এ বেঙ্গালুরুতে, ১৯৪২-এ মুম্বইয়ে প্রগতিবাদী লেখক-শিল্পী সঙ্ঘের আঞ্চলিক শাখা গঠনের পর, ১৯৪৩-এর মে মাসে মুম্বইয়ে সম্মেলন হল। গঠিত হল ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন— আইপিটিএ। আইপিটিএ-র লক্ষ্য ছিল মৃতপ্রায় দেশজ শিল্প-মাধ্যমগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে, পাশ্চাত্য থেকে পাওয়া শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে সেগুলি মিলিয়ে, এক নতুন সংস্কৃতির আবাহন। শ্রমজীবী মানুষের জীবন থেকে আহরিত শিল্প-উপাদানকে সাম্যবাদী চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে নাটক, গান, সিনেমা তৈরি করা। তার পর খেত-খামারে, কারখানায়, বস্তিতে, গঞ্জ শহরের চৌরাস্তায় তাঁদেরকেই ফিরিয়ে দেওয়া— এই ছিল তাঁদের কার্যসূচি। তৈরি হল ধরতি কে লাল সিনেমা। আনিয়া লুম্বার বই জানাচ্ছে, নবান্ন যখন পঞ্জাবের কৃষকদের সামনে অভিনীত হয়েছে, ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও দর্শক চোখের জল ফেলেছেন। তেলঙ্গানার কর্মী কোনডাপল্লি কোটেশ্বরাম্মা বাংলার দুর্ভিক্ষ-পীড়িত একটি মেয়ের দুঃখের কাহিনি অন্ধ্রপ্রদেশের জমায়েতে গেয়েছেন। উদয়শঙ্করের আলমোড়া কেন্দ্রে শিক্ষিত শান্তি বর্ধনের নির্মিত ‘ভুখা হ্যায় বঙ্গাল’ নাচ উষা দত্ত-সহ তিন জন আইপিটিএ-র নৃত্যশিল্পী বিজয়ওয়াড়াতে সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলনে প্রদর্শন করেছেন। দর্শকরা তাই দেখে ত্রাণের জন্য দান করেছেন।
১৯৫০-৫১’য় উৎপল দত্ত যখন আইপিটিএ-তে যোগ দিয়েছেন, তখন তিনি অনুভব করেছেন জনতার মুখরিত সখ্য। দেখেছেন পানু পাল, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এক সঙ্গে কাজ করছেন নৃত্য, নাটক, সঙ্গীত এবং ছায়াচিত্র নিয়ে। সেই সব কাজের খবর বেরোত পিপলস ওয়র, জনযুদ্ধ-এর পাতায়। সলিল চৌধুরী এক দিকে তৈরি করছেন ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং ভারতীয় সুরের সম্মেলনে রেল শ্রমিক আন্দোলনের গান— ঢেউ উঠছে কারা টুটছে। অন্য দিকে গান বাঁধছেন ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা’ নিয়ে। ঝড়ের ঠিকানা লেখা সেই সব কথা আর সুর কালজয়ী।
এই স্বর্ণযুগে ছেদ পড়ে স্বাধীনতার কিছু পরেই। সিপিআই-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর পার্টির নীতির টানাপড়েনে বামপন্থী সংস্কৃতি অনেকটা দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর উদ্যোগ করা হয়েছিল সাংস্কৃতিক শাখাকে শক্তিশালী করে তোলার। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি দলিত কবি আন্নাভাউ সাঠের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্দোলনে কিছুটা গতি আসে। তবে চল্লিশের সেই কর্মময় জনপ্রিয়তা আইপিটিএ তেমন করে আর পায়নি। বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ চলেছে বামপন্থী সংস্কৃতিকে নারী-আন্দোলনে, দলিত-আদিবাসী বা ভূমি আন্দোলনে বিস্তৃত করার। এখনও দেশের কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আইপিটিএ-র ইউনিট দেখা যায়।
বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলন ভারতের জনসংস্কৃতিকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে। দো বিঘা জমিন বা নয়া দৌড়-এর মতো ছবি সম্ভব হয়েছিল এই সংস্কৃতির জন্যেই। আবার এই সংস্কৃতির স্মৃতি বস্তির তরুণ রাগী শ্রমিককে আসমুদ্র-হিমাচলের পছন্দের নায়ক করে তুলেছিল সত্তরের দশকে। গত শতকের ষাট, সত্তর, আশির দশকে এই সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছিলেন উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নাট্য-আন্দোলনের নেতারা।
এর অন্যতম ধারক ছিলেন গণনাট্য কর্মী সফদর হাশমি। ১৯৮৯-এ দিল্লির উপকণ্ঠে সফদরের হত্যা স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৪২-এ ঢাকার রাস্তায় খুন হয়ে-যাওয়া একুশ বছরের সোমেন চন্দের কথা। সোমেন ছিলেন প্রগতি সঙ্ঘের সদস্য, কমিউনিস্ট কর্মী। সফদরের তৈরি করা জন-নাট্য-মঞ্চ মাল্যশ্রী হাশমির নেতৃত্বে আজও নাটক করে কারখানার গেটের সামনে, ঘিঞ্জি বস্তিতে। পথনাটিকায় তুলে আনে অসংগঠিত শ্রমিক জীবনের আখ্যান।
বিগত পাঁচ-সাত বছরে বাংলার মঞ্চে উৎপলের রাজনৈতিক নাটকগুলির নতুন নতুন প্রযোজনাও মনে করিয়ে দেয় যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর পরে বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারা আজও বহমান।
মানবীবিদ্যা চর্চা বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)