শহুরে-শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মুখের বাংলা বাক্যে আজকাল প্রতি আধ ছটাক অন্তর ইংরেজি শব্দ। এবং, তাতে গুরুজনদের নানা আপত্তি ও বিরক্তি। বিষয়টা অবশ্য আপত্তি ও বিরক্তি অবধি এসেই থমকে যায়। নিরাময়ের উপায় কী, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা কিন্তু আমরা করছি না। সে আলোচনায় ঢুকতে গেলে প্রথমেই মেনে নিতে হবে, বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের প্রবেশ অনিবার্য, কারণ রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘ইংরেজি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার একটা কারবার’ চলছে। সেই কারবারে ‘সবচেয়ে বিঘ্ন ভাষায় শব্দের অভাব’। সেই অভাব এ কালে আরও বেশি। কারণ এ কালের সঙ্গে সে কালের পার্থক্য এ-ই যে, সেই অভাবের কথা রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু শব্দের সেই দারিদ্রকে মেনে নিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো বসে থাকেননি। ফলে রবীন্দ্রনাথ ও সমকালীন চিন্তকদের চেষ্টায় বাংলা ভাষার মূলধন বেড়ে উঠেছিল, বাংলা ভাষার গ্রাম্য হাটেই বিশ্ব সম্পদের কারবার খোলা সম্ভব হয়েছিল। আমরা সেই চেষ্টা মুলতুবি রেখেছি, তাই ভাষার যে মূলধন ছিল তাতে আবার টান পড়ছে। বিশ্বে চিন্তাভাবনার জগৎ তো প্রতিনিয়তই সম্প্রসারিত হচ্ছে— তার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য প্রতি মুহূর্তে বাংলা ভাষায় নতুন নতুন কথা গড়ে নেওয়া চাই। সে কাজে এ কালের চিন্তকেরা তেমন মন দিচ্ছেন না বলেই বাংলা ভাষার গ্রাম্য হাটে বিশ্ব সম্পদের কারবারে এ ভাষা ব্যবহারযোগ্যতা হারাচ্ছে। আর যুবক-যুবতীরা প্রতি আধ ছটাক অন্তর ইংরেজি শব্দের ঝুমঝুমি বাজিয়ে নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার, কৃত্রিম আত্মপ্রত্যয়ের প্রমাণ দিচ্ছেন।
রবীন্দ্রনাথ ও স্বদেশি ভাবুকেরা কেবল বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষালাভের যে স্বপ্ন একদা স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন যে পুরোপুরি পূরণ সম্ভব নয়, এ সত্য এখন আমাদের মেনে নিতেই হবে। বহুভাষীর দেশ ভারতবর্ষ— এখানকার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নিরিখে এবং এখনকার বৈশ্বিকতার আবহে কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষার নদী অনেকটাই হয়তো অতিক্রম করা যায়, কিন্তু বনেদ পোক্ত হয় না, দৃষ্টিও খোলে না। শুধু-বাংলার শুচিবায়ুগ্রস্ততায় আটকে থাকলে উচ্চতর উচ্চশিক্ষার জানলা-দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই উচ্চশিক্ষায় নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষার, বিশেষ করে ইংরেজির প্রয়োগ অনিবার্য। তবে এর অর্থ এ-ই নয়, বাংলা ভাষাকে ফুটো-পয়সার মতো ফেলে দিতে হবে। বরং, তাকে ঘষে-মেজে চালু রাখা চাই। সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চশিক্ষার উঠোনের বাইরে যে খোলা ময়দান তাতে বহু মানুষ নিজের ভাষায় বিশ্বজ্ঞানের কথা শোনার জন্য অধীর হয়ে আছেন। তাঁদের কাছে বড় জ্ঞানের ও ভিন্ন ভাবের কথা নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষাকে নানা শব্দের মূলধনে ভরে তোলা উচিত। এই নতুন শব্দের মূলধন তৈরিকেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘নতুন কথা গড়া’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
এই নতুন কথা গড়ার কাজকে বলা চলে প্রতিশব্দ ও পরিভাষা নির্মাণের কাজ। এমনিতে গুগল-করা প্রজন্মের কাছে কাজটা যান্ত্রিক, এক ভাষার শব্দ গুগলে ফেললেই আর এক ভাষার প্রতিশব্দ ভেসে ওঠে। তাতে শব্দটা পাওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু শব্দের সংস্কৃতি স্পষ্ট হয় না। রবীন্দ্রনাথ কখনও প্রতিশব্দ ও পরিভাষা নির্মাণের কাজটিকে যান্ত্রিক বলে মনে করতেন না। তাঁর কাছে কাজটি খুবই সৃষ্টিশীল। শুধু তা-ই নয়, এ কাজে তর্কের অনুশীলন ও মস্তিষ্কসঞ্চালনের সুযোগ ষোলো আনার উপর আঠারো আনা। রবীন্দ্রনাথ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতোই এ কাজে নেমে তিনটি উপায় অনুসরণ করেছিলেন। ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজি শব্দটি বাংলায় গ্রহণ করেছিলেন। কখনও সংস্কৃত শব্দভান্ডারের কোনও শব্দকে নতুন অর্থে প্রয়োগ করেছিলেন। কখনও আবার হাত পেতেছিলেন দেশজ শব্দের কাছে।