E-Paper

বিশ্বজোড়া যুদ্ধে বিপন্ন শৈশব

ইউনিসেফ-এর রিপোর্ট বলছে, আনুমানিক ৪৭.৩ কোটি শিশু এখন এমন সব দেশে বাস করছে, যেখানে যুদ্ধ বা অন্য কোনও সংঘাত অবিরত চলছে। নিরাপত্তার সন্ধানে তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে।

অরবিন্দ সামন্ত

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫ ০৬:১৮

রণদামামা বাজছে বিশ্ব জুড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ত্রিশ বছরে এত সহিংস সংঘাত মানুষ দেখেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইরান-ইজ়রায়েল, ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের পাশাপাশি আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা আর ইউরোপ জুড়ে চলছে অন্তত ১১০টি সশস্ত্র সংঘাত। এই ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। ইউনিসেফ-এর রিপোর্ট বলছে, আনুমানিক ৪৭.৩ কোটি শিশু এখন এমন সব দেশে বাস করছে, যেখানে যুদ্ধ বা অন্য কোনও সংঘাত অবিরত চলছে। নিরাপত্তার সন্ধানে তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। দীর্ঘ সময় তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে থাকে, কখনও বা বাড়িই ফেরা হয় না। অনেকে থাকে বাবা-মায়ের থেকে বরাবরের জন্য বিচ্ছিন্ন, বেড়ে ওঠে ‘সঙ্গীহীন শিশু’ শরণার্থী হিসাবে। যুদ্ধ-আবহে আরও কঠিন হয়ে ওঠে শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশুর জীবন। শত্রু সেনা দ্বারা ধর্ষিতও হয় শিশুরা। যুদ্ধ এক দিন শেষ হয়, কিন্তু এরা আজীবন বয়ে চলে তার ক্ষত।

যুদ্ধের প্রকোপে নিঃশেষ হচ্ছে শৈশবও। যুদ্ধ চলছে শহরে, বন্দরে, জনাকীর্ণ অসামরিক এলাকায়; ড্রোন হামলা হচ্ছে স্কুল, হাসপাতাল, শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রেও। বিশেষজ্ঞদের মত, এর ফলে আনুপাতিক ভাবে শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধ তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে স্থায়ী পরিবর্তন ও প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, ২০২৩ সালে ২৬টি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ২২,৫৫৭ জন শিশুর বিরুদ্ধে রেকর্ড ৩২,৯৯০টি গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ইজ়রায়েল, প্যালেস্টাইনের অধিকৃত অঞ্চল, কঙ্গো, নাইজিরিয়া ও সুদানে ঘটেছে সবচেয়ে বেশি অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাবমতে, ২০২৪ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর অধিকার লঙ্ঘন’-এর সংখ্যা বেড়েছে ২৫ শতাংশ, এক বছর আগেই এই বৃদ্ধির হার ছিল ২১ শতাংশ। শিশুদের অপহরণ, হত্যা, পঙ্গু করে দেওয়া, তাদের উপর যৌন হিংসা, স্কুল-হাসপাতালে হামলা— সব রকমেরই নৃশংসতা হয়েছে যুদ্ধের নামে।

যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব নিঃসন্দেহে শারীরিক, কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে বসবাসকারী অনেক শিশুও সংঘাতে নিযুক্ত হয়। আক্রমণকারীদের যৌন নির্যাতনের শিকার হয় কেউ। সশস্ত্র সংঘর্ষের এলাকায় শিশুরা তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। ইউক্রেনের যুদ্ধ-উপদ্রুত অঞ্চলের শহরগুলির শিশুরা রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে চার থেকে সাত মাস মাটির নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ইউনিসেফ-এর হিসাব বলছে, গত দু’বছরে ইউক্রেনের শিশুরা অন্তত দু’শো দিন বাঙ্কারে কাটিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু তহবিলের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, যুদ্ধ যত দীর্ঘতর হচ্ছে, ভয়, শোক ও প্রিয়জন-বিচ্ছিন্নতার টানাপড়েন শিশুদের মনে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলছে। ৪০ শতাংশ শিশু স্কুলে যাচ্ছে না, এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। শরণার্থী পরিস্থিতিতে আরও বঞ্চনা ও হিংসার সংস্পর্শে এই প্রভাবগুলি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, ভবিষ্যতে লক্ষ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যা বাড়তে পারে অস্বাভাবিক ভাবে।

যুদ্ধের ফলে এখনই দেখা যাচ্ছে শিশুদের বিকাশের অস্বাভাবিকতা। ইউক্রেনে সমাজকর্মীরা উদ্বিগ্ন, যুদ্ধের কারণে শিশুদের শরীর-মনের বিকাশে মারাত্মক দেরি হচ্ছে। আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্নায়ুবিজ্ঞানী-অধ্যাপক বলছেন, শৈশবের কিছু চাপ যৌবনের বিকাশে, ‘নিউরাল সার্কিট ফাংশন’-এ কিছু অস্বাভাবিকতা তৈরি করতে পারে। এগুলি আসলে ‘স্ট্রেস’-এর প্রতিক্রিয়া। শৈশবের ট্রমা মস্তিষ্কের অ্যামিগডালায় স্ট্রেস ও ভয়ের প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটায়, মস্তিষ্ককে যৌবনে সম্ভাব্য স্ট্রেসের জন্য আরও বেশি সংবেদনশীল হতে ‘প্রস্তুত’ করে। স্ট্রেস হরমোনের প্রকাশ বোঝা যায় আরও ঘন ঘন। যে শিশু এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়, পরবর্তী জীবনে তার উদ্বেগ, হতাশা, ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বা অ্যালঝাইমার’স-এর মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শৈশবে পরিবার-বিচ্ছিন্নতা, স্বাভাবিক সামাজিক ও মানসিক উদ্দীপনার অভাবজনিত দুঃখ বা যুদ্ধের শেলিং-এর উদ্বেগ থেকে যে অতিরিক্ত উদ্দীপনা তৈরি হয়, তা যৌবনে মস্তিষ্ককে নতুন করে ‘সজ্জিত’ করতে পারে। কিন্তু আমরা যতই প্রাপ্তবয়স্ক বা বিবেচক হয়ে উঠি না কেন, শৈশবের ট্রমা-র প্রভাব উল্টে দেওয়ার কার্যকর উপায় আমাদের হাতে নেই।

যুদ্ধের ভয়াবহতায় শিশুদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো দৃঢ়তা হারায়। তারা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে, ব্যক্তিজীবনে সন্তুষ্টির সংজ্ঞাই পাল্টে যায় তাদের। দেখা গেছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা আবেগ সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগে বেশি। অন্য দিকে, ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি মাত্রায় ‘হাইপারঅ্যাক্টিভ’ হয়ে ওঠে। যুদ্ধে সরবরাহ-শৃঙ্খল ব্যাহত হয়, কৃষি উৎপাদন স্থগিত থাকে: অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠী তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির ঝুঁকিতে পড়ে। রোগ প্রতিরোধে টিকাদান ব্যাহত হয়। ফলত শিশুদের রোগ বৃদ্ধি পায়, রোগ প্রতিরোধ-ক্ষমতা কমে যায়। এক সময় বিশ্ব থেকে নির্মূল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা পোলিয়ো গাজ়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। স্যানিটেশন ও জল পরিশোধন ব্যবস্থা যুদ্ধে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় কলেরার প্রাদুর্ভাবের পরিস্থিতি তৈরি হয়। যুদ্ধসৃষ্ট দূষণের সঙ্গে জন্মগত ত্রুটির যোগ রয়েছে; এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান ‘ওয়র-ভেটেরান’দের শিশুদের মধ্যে গর্ভাবস্থাজনিত জটিলতা ও জন্মগত ত্রুটির ঘটনা বেশি।

শিশুরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বা বোমাবর্ষণের কারণে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। যুদ্ধে ধ্বংস হয় তাদের স্কুলও, লক্ষ লক্ষ শিশু বনিয়াদি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। যুদ্ধের চাপ প্রভাব ফেলে অভিভাবকত্বেও, তার ফলে শিশুদের দুর্ব্যবহার ও অবহেলা করার ঝুঁকি বাড়ে। যুদ্ধ-শেষে পরিবারগুলি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে গেলেও দেখা যায়, বাবা-মায়ের মাদকাসক্তি বা মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি শিশুদের দুর্বল করে তুলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান সামরিক কর্মীদের সন্তানের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বেড়েছে।

যুদ্ধ এক দিন থেমে যায়, কিন্তু শিশুদের শরীর-মনের আঘাত, আতঙ্ক ও দুঃস্বপ্নের ছায়া মোছে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

War Children

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy