অরণ্যপ্রিয় মানুষ যাঁরা, তাঁরা জানেন ভোরের আলোমাখা জঙ্গল এক অসামান্য অনুভূতি। অন্ধকারের চাদর সরিয়ে জঙ্গল যখন আড়মোড়া ভাঙে, তখন কত যে অদ্ভুত শব্দ আনাগোনা করে। সেগুন পাতার খসে পড়া, শুকনো ঘাস মাড়িয়ে হরিণের চলা, ময়ূরের ডাক, বার্কিং ডিয়ারের অ্যালার্ম কল, হাতির ডাল ভাঙার মড়মড়— গাড়ির আওয়াজ স্তব্ধ হলে, মানুষের কথা ফুরিয়ে গেলে প্রত্যেক শব্দকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। মনে হয়, এ এক অন্য পৃথিবী। এখানে মানুষের প্রবেশাধিকার নেই।
ভুল বললাম। প্রবেশাধিকার আছে তো বটেই। কংক্রিটের শহরের মাঝে চারশো একরের এক খণ্ড সবুজ-স্বস্তির মাটিতে যখন বুলডোজ়ার নামে আইটি পার্ক তৈরির লক্ষ্যে, ভিডিয়োতে ছড়িয়ে পড়ে পাখিদের আর্তনাদ, হরিণের আকুতি-মাখা চোখ— তখন বাস্তবের মাটিতে পা পড়ে। জঙ্গলের ভোর ক্ষণিকের সুখ। বাস্তব— উন্নয়নের। যে উন্নয়ন যজ্ঞে কয়েক রাতের মধ্যেই অজস্র মূল্যবান গাছ উপড়ে ফেলা যায়, জঙ্গলবাসী পশু-পাখি-কীটপতঙ্গের আবাসস্থলটি হরণের চেষ্টা করা হয়, ভারত বেশ কিছু বছর ধরে সেই উন্নয়ন পথেই তীব্র বেগে চলেছে।
কাঞ্ছা গাচিবোলি। হায়দরাবাদ ইউনিভার্সিটি লাগোয়া এই ৪০০ একরের জমিখণ্ডটি নিয়ে গত মার্চ-এপ্রিল জুড়ে চলেছে লড়াই। তেলঙ্গানার কংগ্রেস সরকার বনাম আদালত এবং পরিবেশসচেতন মানুষের, যার মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই জমিখণ্ডটিকেই আইটি পার্ক গড়ে তোলার জন্য নিলামে তুলতে চেয়েছিল তেলঙ্গানা সরকার। যুক্তি ছিল, এর মাধ্যমে অন্তত পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ টানা যাবে, কর্মসংস্থান হবে পাঁচ লক্ষ। কিন্তু মানুষ মাথা নোয়াননি। ফলে, প্রবল বিক্ষোভ এবং শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে বুলডোজ়ার থেমেছে। স্পষ্ট ভাষায় সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, যে একশো একর অরণ্য ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণীরা বিপন্ন হয়েছে, তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করুক তেলঙ্গানা সরকার। বলেছে— হরিণের পাশে ‘হাইরাইজ়’ হতে দেওয়া যায় না।
উষ্ণায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এখন হামেশাই ‘কার্বন সিঙ্ক’-এর প্রসঙ্গটি উঠে আসে। কার্বন সিঙ্ক হল সেই বিশেষ অঞ্চল, যেখান থেকে পরিবেশে যে পরিমাণ কার্বন যুক্ত হয়, শোষিত হয় তার চেয়ে ঢের বেশি। জঙ্গল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘কার্বন সিঙ্ক’। ঠিক এই কারণেই অরণ্য সংরক্ষণ জরুরি, বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে, পৃথিবীকে আরও কিছু দিন বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। প্রতি দু’বছর অন্তর ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রকাশ করে ‘ইন্ডিয়া স্টেট অব ফরেস্ট রিপোর্ট’ (আইএসএফআর)। সেখানে প্রায় প্রতি বারই দেখানো হয়, ভারতের অরণ্য-আচ্ছাদন সামান্য হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রতি বারই এই রিপোর্ট বিশেষজ্ঞদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে, কারণ— সেখানে প্রাকৃতিক ঘন অরণ্যকে প্লান্টেশন বা পরিকল্পিত ভাবে সৃষ্টি করা অরণ্যের সঙ্গে পৃথক করে দেখানো হয় না। ফলত, পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা বনভূমির বৃদ্ধি দিয়ে সহজেই প্রাকৃতিক ঘন অরণ্যকে উজাড় করে উন্নয়ন প্রচেষ্টার মহাভ্রান্তিটি ঢাকা দেওয়া যায়।
স্বাভাবিক ভাবেই বিশেষজ্ঞদের একাংশ এই পদ্ধতিটিকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে সরব হয়েছেন, কারণ তাতে গোঁজামিল বিস্তর। বাস্তব এটাই যে, কৃষিজমির বিস্তার, নদী উপত্যকার বিভিন্ন প্রকল্প, শিল্প, নগরায়ণ, পরিবহণ প্রভৃতির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট অরণ্য ভয়ঙ্কর ভাবে কমেছে, যা দেশের সবুজ-স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মোটেই সুখবর নয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ভাবে সৃষ্ট বনভূমিতে জীববৈচিত্র তেমন থাকে না। সত্যিই ভারতে অরণ্যসম্পদ রক্ষা করতে হলে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট বনভূমি সংরক্ষণের উপর জোর দিতে হবে, পরিসংখ্যানের লুকোচুরি ছেড়ে।
তবে কার্বন সিঙ্ক হিসেবে পরিকল্পিত বনভূমিরও ভূমিকা আছে। সে ভূমিকা অবশ্যই প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট বনভূমির মতো জোরদার না হলেও তাকে উপেক্ষা করার প্রশ্নও ওঠে না। বিশেষত শহরাঞ্চলে যেখানে কংক্রিটের জঙ্গলের কল্যাণে ক্রমশ সবুজ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, সেখানে যে কোনও সবুজকে প্রাণপণে বাঁচাতে হবে। এইখানেই কাঞ্ছা গাচিবোলিকে ঘিরে প্রতিবাদের গুরুত্ব। এটি পরিকল্পিত অরণ্য নয়। এই জঙ্গলটি আদৌ আইনি চোখে ‘জঙ্গল’ কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মালিকানা ব্যতিরেকে যে কোনও জমিখণ্ড যা কোনও সরকারি কাগজে অরণ্য হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে অথবা চরিত্রগত দিক থেকে জঙ্গলের সমতুল— সে সবই ‘জঙ্গল’-এর আওতায় পড়ে। সে দিক থেকে এই সবুজ খণ্ডটিকে ‘অনথিভুক্ত অরণ্য’-এর পর্যায়ে ফেলা যায়। তদুপরি, এই জঙ্গল বহু পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং সরীসৃপের ঠিকানা। কংক্রিটের জঙ্গলের ভিতর এই সবুজ আচ্ছাদনটিই হায়দরাবাদের টিমটিম করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা শহুরে জঙ্গলগুলির মধ্যে অন্যতম। ভরা গ্রীষ্মে এই শহরের অন্যত্র যখন জ্বলেপুড়ে খাক হয়, তখন এই জঙ্গলের চার পাশে তাপমাত্রা তুলনায় সহনীয় থাকে বলে বাসিন্দারাই জানিয়েছেন। তা ছাড়া এখানকার পিকক লেক, বাফেলো লেক, ছোটখাটো অজস্র জলাশয় হায়দরাবাদের ভূগর্ভস্থ জলের ভান্ডারটিকে সমৃদ্ধ করে। প্রতি গ্রীষ্মে এই শহরের প্রবল জলকষ্টের কথাটি অজানা নয়। এই কথাটি তেলঙ্গানা সরকার এত দ্রুত বিস্মৃত হল কী ভাবে, সেটাও প্রশ্ন।
দায়িত্বশীল প্রশাসনের কাজ— এক সুস্থ নাগরিক জীবনের লক্ষ্যে উন্নয়ন এবং পরিবেশ, উভয়ের মধ্যে এক যথাযথ ভারসাম্য বজায় রাখা। নির্বাচিত সরকার সে কথা ভুলে গেলে জনগণই তাকে মনে করিয়ে দেবে— এটাই তো গণতন্ত্র। উত্তরাখণ্ডের পাহাড় চিপকো আন্দোলনের সাক্ষী। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার সেই আন্দোলনের মূল্য মনে রাখেনি। বেহিসাবি উন্নয়ন এই অঞ্চলকে পরের পর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিরিখে মৃত্যুফাঁদ করে তুলেছে। গত কয়েক বছরে হায়দরাবাদও অনেক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছে। গ্রীষ্মের প্রবল জলকষ্ট, ভয়ঙ্কর বন্যা তার অন্যতম। তাই এই প্রতিরোধ যাতে শুধুই দিনকয়েকের উচ্ছ্বাস হয়ে থেকে না যায়, সেই দায়িত্ব ছাত্রসমাজকেই নিতে হবে।
সন্দেহ নেই যে, এই বিক্ষোভ, প্রতিবাদের ভাষাটি অনন্য। গোটা দেশে তা তোলপাড় ফেলেনি ঠিকই, কিন্তু পরিবেশ নিয়ে সীমাহীন হতাশার মধ্যে এক মুঠো আলো ছড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নন, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আগত। এই আন্দোলন থেকে তাঁদের সরাসরি কিছু পাওয়ারও নেই। তবুও তাঁরা ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব করেননি, জঙ্গল বাঁচানোর আন্তরিক টানে পথে নেমেছেন। এই দিক থেকে হয়তো এই প্রতিবাদ সত্তরের দশকের ‘চিপকো’ আন্দোলনের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। উত্তরাখণ্ডে সরকারি আগ্রহে জঙ্গল উচ্ছেদ রুখেছিলেন দরিদ্র গ্রামবাসীরা। কারণ, জঙ্গলই ছিল তাঁদের রুজিরুটির জোগানদার, তাঁদের আশ্রয়। তাকে নিঃশেষ হতে দেওয়া মানে তাঁদের জীবন-সঙ্কট। কিন্তু হায়দরাবাদের তরুণ সমাজ সেই ‘জীবন সঙ্কট’কে স্থাপন করেছেন আরও বৃহত্তর অর্থে। উষ্ণায়নের বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জঙ্গল বাঁচাতে পথে নামা— তরুণ প্রজন্মই নাহয় শেখাক অবশিষ্ট ভারতকে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)