E-Paper

অবাক বিষপানের কূটনীতি

নয়াদিল্লির সঙ্গে কাবুলের প্রেম খুনসুটি চলছে ঠিকই, কিন্তু পরিণয় হচ্ছে না। অর্থাৎ তাদের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার থেকে এক ধাপ পিছিয়েই থাকছে সাউথ ব্লক।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৪১
অগত্যা: আফগান বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির পাশে এস জয়শঙ্কর।

অগত্যা: আফগান বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির পাশে এস জয়শঙ্কর। ছবি: পিটিআই।

বিষ, তা যদি আপনি জেনেশুনেও পান করেন, তা হলেও তার নানাবিধ পার্শ্ব, তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য, অন্তত শারীরবিজ্ঞান তাই বলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অথবা বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও তা একই ভাবে লাগসই। তালিবান প্রশ্নে নয়াদিল্লির এই অবাক বিষপান দেখে কথাটা মনে এল!

ছাব্বিশ বছর আগে কন্দহরের অভিশপ্ত বিমান বন্দরে যে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে শেষ বিপন্ন বার্তালাপ নয়াদিল্লির, যার জন্য মাসুদ আজহারকে ছেড়ে দিয়ে কালিমালিপ্ত হয় বাজপেয়ী সরকার— সেই জইশ জঙ্গিই প্রধান মস্তিষ্ক হিসাবে অভিযুক্ত হয় মুম্বইয়ের ২৬/১১ কাণ্ডে। আজ দীপাবলির রোশনাইয়ের মুখে দাঁড়ানো নয়াদিল্লি সেই গোষ্ঠীর অন্যতম নেতার জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে দিল! এ যে বুক পেতে অনলবাণ বুকে নেওয়ার কাছাকাছি, তা সাউথ ব্লকের পোড়খাওয়া কূটনীতিকরা জানেন না, এমন নয়। কিন্তু যদি বলি এই পাশা খেলার ঝুঁকিটা তাঁরা নিতে বাধ্য হলেন কিছুটা কোণঠাসা রণনৈতিক কারণে, আর কিছুটা দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত সুবিধা আদায় করে নিতে, তা হলে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হয় না।

আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির গত তিন দশকের অভিযোগ, ওয়াশিংটন ‘ভাল তালিবান এবং মন্দ তালিবান’-এর খোপ কাটে নিজের সুবিধার্থে। ভারতের সনাতন অবস্থান, আসলে তালিবানের ভাল মন্দ নেই। তালিবান মানেই সন্ত্রাসী, সভ্যতাবিরোধী, নারীবিদ্বেষী, শিশুদের হাতে কালি কলমের বদলে তুলে দেয় কালাশনিকভ। কিন্তু আজ মোদী সরকারের কাছে তালিবানের ‘সকলই শোভন, সকলই নবীন সকলই বিমল!’ রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে দিয়ে গতিবিধির নিষেধাজ্ঞা তুলিয়ে বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে নিয়ে আসা হল দিল্লি, তার পর পাঠানো হল দেওবন্দে। যে রাজ্যে বুলডোজ়ার মুখ্যমন্ত্রীর ভয়ে আধমরা হয়ে থাকে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ, যেখানকার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘তালিবানকে সমর্থন করার অর্থ, মানবতা বিরোধী শক্তিকে সমর্থন করা’, আজ সেই যোগী-রাজ্যেরই সহারনপুরে ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দে পুষ্পবৃষ্টি করে স্বাগত জানানো হল আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে, যোগী সরকারেরই দেওয়া নিরাপত্তার বেষ্টনীতে! অভ্যর্থনায় উচ্ছ্বসিত মুত্তাকি দেওবন্দে দাঁড়িয়ে ঘোষণাও করলেন, ভবিষ্যতে এমন সফর ঘন ঘন দেখা যেতে পারে।

কতটা পথ হাঁটলে তবে এমন অবাক করা কূটনৈতিক চিত্রনাট্য তৈরি হওয়া সম্ভব। দু’দশকেরও বেশি সময় কূটনৈতিক কভারেজ-এর অভিজ্ঞতায় এমনটা আর ঘটেছে বলে তো মনে পড়ে না। তবে এই অবাক বিষপান করার পক্ষে কোনও যুক্তিই যে সাউথ ব্লকের নেই, সবই যে আপন মনের হরষে করা হয়েছে, বিষয়টা এতটাও সরল নয়। কার্যত বন্ধুহীন প্রতিবেশী বলয়ে, ঘাড়ের কাছে ইসলামাবাদ এবং চিনের বিষাক্ত নিঃশ্বাস হজম করে কৌশলগত সুবিধার্থে এই তালিবান তাস খেলছে ভারত। সমস্ত ঝুঁকি-সুবিধা পর্যালোচনা করেই।

তলিবান সখ্যের পিছনে মূলত খানচারেক যুক্তি রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের। প্রথমত, আইসি ৮১৪ কাণ্ড বাদ দিলে (যার পিছনে মূলত আইএসআই-এর হাত ছিল), এবং বিশেষ করে একুশের অগস্টে দ্বিতীয় বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তালিবান ভারতের প্রতি মোটের উপর ইতিবাচক থেকেছে। পহেলগাম কাণ্ডকে ধিক্কার জানানোই শুধু নয়, কাশ্মীর যে ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়, সে বিষয়েও সরব হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র রাশিয়াই তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। সাউথ ব্লকের আমলাদের কাছে খবর, কিছু শক্তিশালী রাষ্ট্রও লাইনে রয়েছে। তালিবানের উপর পশ্চিমের চাপও কমেছে। চিন থাবা বাড়িয়ে বসে রয়েছে তালিবানকে নিজের শর্তে চালিত করার জন্য। ভারত যদি স্বীকৃতির কাছাকাছিও পৌঁছে যায়, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার রূপকার হিসাবে নিজেকে দেখাতে পারে, কৌশলগত সুবিধায় থাকবে। তৃতীয়ত, তালিবান শাসকের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার অর্থ গোটা অঞ্চলকে ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য চিন-পাকিস্তানের নিরন্তর দাবা খেলাকে ভেস্তে দিতে পারা। চিনের সঙ্গে কাবুলের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি কূটনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করতে পারা। চতুর্থত, এটা স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং কূটনৈতিক বৈধতা পাওয়ার জন্য তালিবান ২.০ জমানা মরিয়া হয়ে রয়েছে। এটাও মনে করা হচ্ছে, ১৯৯৬-এর তালিবান এবং ২০২১-এর তালিবান জমানার মধ্যে চুলচেরা হলেও প্রভেদ রয়েছে। ভারত সেটাকেই কাজে লাগিয়ে সে দেশে রাজনৈতিক আস্থা তৈরি করে পশ্চিম এশিয়ার দিকে নিজেদের বাণিজ্যকে নিয়ে যেতে পারে, পাকিস্তানকে এড়িয়ে। ইরানের চাবাহার বন্দর যার একটা উদাহরণ মাত্র।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তালিবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিদেশমন্ত্রীর বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হল, তাতে পহেলগাম, জম্মু ও কাশ্মীরের উল্লেখ এবং আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের নিন্দা রয়েছে। মুত্তাকি ভরতের মাটিতে পা দেওয়ার পর থেকেই আফ-পাক সীমান্তের আকাশ অশান্ত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান হামলা করেছে আফগানিস্তানে হয়তো কিছুটা সবক শেখানোর জন্যই। কিন্তু তাতে কৌশলগত লাভ ভারতেরই। নয়াদিল্লির মাটিতে আফগান দূতাবাসে বসে তালিবান বিদেশমন্ত্রী হুঙ্কার ছেড়েছেন ইসলামাবাদকে। প্রকৃতপক্ষে ভারত নিজ স্বার্থেই সেই মঞ্চ তালিবানের জন্য নয়াদিল্লিতে তৈরি করে দিয়েছে। মুত্তাকি উর্দুতে কথা বলেছেন যাতে বার্তা এই উপমহাদেশে স্পষ্ট ভাবে যায়। তালিবান এবং তাদের প্রাক্তন অভিভাবক পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত চলছে। যা ভারতকে পাক-বিরোধী প্রচারে আপাতত সুবিধা করে দিচ্ছে। ভারতীয় গোয়েন্দারা তালিবানকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন বা করবেন, সেটাই এখন লক্ষ্য। মুত্তাকির সফরে বেশ কিছু সহায়ক প্রকল্পের ঘোষণায়, এটাও প্রমাণিত যে ভারতীয় বিনিয়োগ এবং অনুদানের দরজা খুলে দিয়েছে তালিবান।

কিন্তু এই কৌশলগত এবং বাণিজ্যপথের সুযোগ নিতে গিয়ে ভারতও যে কিছু কম মরিয়া নয়, সেই ছবিও কিন্তু একই সঙ্গে ফুটে উঠছে। ভারত জানে যে তালিবানকে নিয়ে খেলা বিপজ্জনক, কারণ যে কোনও সময়ে তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে। কূটনীতি চুলোর দ্বার দিয়ে তারা ফিরে যেতে পারে তাদের গোঁড়া সন্ত্রাসী শিকড়ে। আর এটা জানে বলেই নয়াদিল্লির সঙ্গে কাবুলের প্রেম খুনসুটি চলছে ঠিকই, কিন্তু পরিণয় হচ্ছে না। অর্থাৎ তাদের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার থেকে এক ধাপ পিছিয়েই থাকছে সাউথ ব্লক।

মুত্তাকির সঙ্গে আলোচনায় অথবা যৌথ বিবৃতিতে কোথাও বলা নেই যে, ভারত তালিবানকে অনুরোধ করেছে সে দেশের নারীদের সম্মানের জীবন ফিরিয়ে দিতে, পড়াশোনার স্রোতে ফিরিয়ে আনতে। দিল্লির প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে যখন মহিলাদের ডাকা হয়নি, দ্রুত বিদেশ মন্ত্রক বিবৃতি দিয়েছে, এর দায় তাদের নয়, তালিবানই গোটা ব্যবস্থাপনা করেছে।

আসলে পাকিস্তান ভারতের গলগ্রহ হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র জঙ্গি অনুপ্রবেশ, এবং সীমান্ত সমরের কারণেই তো নয়, কূটনৈতিক কারণেও। অপারেশন সিঁদুরের পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনও হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বসে টেংরি কাবাব খাচ্ছেন পহেলগাম কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত মস্তিষ্ক পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনির, কখনও গাজ়া শান্তি সম্মেলনে ঝুঁকতে ঝুঁকতে ট্রাম্পের নোবেলের দাবিতে তাঁর ইটালিয়ান চামড়ার জুতোর কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। যে সৌদির যুবরাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, সেই মহম্মদ বিন সলমনের সঙ্গে দেখা করে গত মাসেই পারস্পরিক কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছে পাকিস্তান। চিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ক্রমশ বাড়ানোর চেষ্টাও করছে পাকিস্তান। একই ভাবে ভারতের একদা সোনালি অধ্যায়ের বন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গেও পাকিস্তানের দহরম-মহরম এখন শীর্ষে।

ভারত কি সর্বাত্মক ভাবে বন্ধুহীন, পাকিস্তানের এই কৌশলগত বাড়বাড়ন্ত ঠেকানোর প্রশ্নে নির্জন? এর উত্তর একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও চূড়ান্ত হওয়ার পথে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার সদ্য ভারত সফর করে সামগ্রিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যচুক্তিকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়ে গেলেন। কানাডার সঙ্গে দীর্ঘ তিক্ততার পর নয়াদিল্লির সম্পর্ক শুধরানোর পথে। চিনকে অনেকটাই প্রশমিত করা গিয়েছে গত কয়েক বছরের তুলনায়। গ্লোবাল সাউথ-এর রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্কে আস্থা বেড়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে সমস্ত ঝড়জলের মধ্যেও একটি ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পুতিন এবং মোদী।

কিন্তু এই দেশগুলির কারও মাথাব্যথা নেই ভারতের নাতিদূরের প্রতিবেশী বলয়ের চাপ নিয়ে। পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে কাশ্মীর সংক্রান্ত রক্তক্ষরণ নিয়ে পশ্চিমের কিচ্ছু যায় আসে না, যতক্ষণ না তাদের নিজেদের নিহিত স্বার্থ থাকে। এই অঞ্চলের ভিতরেই বেপরোয়া একটি কাঁটা দরকার ছিল নয়াদিল্লির, যার নিজেরও মাথাব্যথা তৈরি হয়েছে ইসলামাবাদকে নিয়ে, এবং যারা একই রকম রুক্ষ ও জঙ্গি। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা বা শত্রুর শত্রুর বন্ধুত্ব— যে ভাবেই দেখা হোক।

আর তাই জেনেশুনে এই অবাক বিষপানের কূটনীতি নিয়েছে ভারত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Diplomacy taliban

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy