E-Paper

হারিয়ে যাচ্ছে যে প্রাচীনেরা

অপহৃত সেই পেটিকা খোলা হতেই বিস্ময়ে হতবাক ভূস্বামী। আগ্রহ উৎসাহ দিল অনুসন্ধানে। অতঃপর পুঁথিগাত্রের অক্ষরগুলি দু’কূল ছাপানো নদীর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল বীর হাম্বিরকে।

আকাশ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৫ ০৮:০১
বাংলা বিভাগ, শ্রীগোপাল ব্যানার্জি কলেজ।

বাংলা বিভাগ, শ্রীগোপাল ব্যানার্জি কলেজ।

বিষ্ণুপুর উৎসব চলাকালীন সদর শহরে ঢুকে, নাকাবন্দিতে আটকে পড়া এক দল ভ্রমণার্থীকে বীর হাম্বিরের গল্প শোনাচ্ছিলেন এক প্রৌঢ়। আপাতত নিষ্ক্রমণের সম্ভাবনাহীন সেই মানুষগুলি জিরিয়ে নিতে বসে পড়েছিলেন তাঁর বাড়ির রোয়াকে। বদকপালে দলটি বলতে গেলে ভাগ্যবান, ইউনেস্কো স্বীকৃত জোড়বাংলা, পঞ্চরত্ন, শ্যামরাই, লালজি মন্দির, রাসমঞ্চ ছাড়াও যে এত মন্দির ছড়িয়ে আছে বিষ্ণুপুরে— পুকুরপাড়ে, বাড়ির আঙিনায়, পাঁচিলের ধারে; উপেক্ষায়, অবহেলায়, সংস্কারের দায়হীন এজমালি সম্পত্তি হিসাবে— চোখে পড়ত কি বিপাকে না পড়লে?

কাঁসার পাত্রে আপ্যায়নের মুড়ি সহযোগে গল্প শুরু হয় অতিথিদের সঙ্গে গৃহস্বামীর। বীর হাম্বির দিনে ভূপ, রাতে লুটেরা। তাঁর গুপ্তচরদের চোখে পড়ল, তিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী আর দশ সশস্ত্র প্রহরী ঝারিখণ্ডের অরণ্য পেরিয়ে চলেছে এক বৃহৎ শকটে। পিছু নিল তস্কর বাহিনী, জায়গামতো সম্পন্ন হল লুণ্ঠন। ধনরত্ন-ভরা পেটিকা ভেবে যা উপস্থাপিত হল রাজার সম্মুখে, তা অবশ্য অমূল্য রতন। হরিভক্তি বিলাস, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি গ্রন্থের মূল পুঁথি, যাদের একটিরও নকল নেই কোথাও। নকল করে প্রচারিত হবে, এই পরিকল্পনাতেই আনা হচ্ছিল নীলাচল থেকে নবদ্বীপে।

অপহৃত সেই পেটিকা খোলা হতেই বিস্ময়ে হতবাক ভূস্বামী। আগ্রহ উৎসাহ দিল অনুসন্ধানে। অতঃপর পুঁথিগাত্রের অক্ষরগুলি দু’কূল ছাপানো নদীর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল বীর হাম্বিরকে। হৃত পুঁথি সন্ধানে বিষ্ণুপুরে থেকে যাওয়া শ্রীনিবাসের সঙ্গে দেখা হল তাঁর, কৃতকর্ম কবুল করলেন সাধকের কাছে। কয়েক দিনের মধ্যেই রাজা, রানি ও আরও কয়েক জন দীক্ষিত হলেন শ্রীনিবাসের কাছে। শাক্ত রাজা হলেন বৈষ্ণব সাধক, মাতৃসাধক বদলে গেলেন গৌড়ীয় মতের বিষ্ণু-উপাসকে। অগণ্য বৈষ্ণবজনের সঙ্কীর্তনে মুখরিত হল বিষ্ণুপুর। পাকাপাকি থেকেও গেল বহু বৈষ্ণব পরিবার। অনেকেরই গৃহপ্রাঙ্গণে ক্রমে নির্মিত হল কুলদেবতার মন্দির।

বীর হাম্বির থেকে ধাড়ি হাম্বির। তার পর রঘুনাথ সিংহ থেকে চৈতন্য সিংহ। এর মধ্যে গোপাল সিংহের আমলে ঘটে চমকপ্রদ ঘটনা। ১৭৪০ সালে আলিবর্দি সিংহাসনে বসতে না বসতেই শুরু বর্গি আক্রমণ। ভাস্কর পণ্ডিতের দাবি, দিতে হবে চৌথ অর্থাৎ রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ। মরাঠা দস্যুর আক্রমণে প্রথমে পালাতে হল আলিবর্দিকে। অরাজক সোনার বাংলা ছারখার হল বর্গি আক্রমণে। ঘুমপাড়ানি ছড়ায় চিরস্থায়ী হয়ে থাকল বর্গি সন্ত্রাসের আতঙ্ক: “খোকা ঘুমলো, পাড়া জুড়লো,/ বর্গি এল দেশে...”

আলিবর্দির অনুমতি নিয়ে ইংরেজরা পরিখা খনন করে শুরু করল কলকাতা রক্ষার কাজ। ‘মারহাট্টা ডিচ’। অন্য দিকে, আলিবর্দি স্বয়ং প্রস্তুত হলেন প্রতি-আক্রমণে। দিশেহারা ভাস্কর চম্পট দিলেন প্রাণ বাঁচাতে, তাড়া করল আলিবর্দি-বাহিনী। বিষ্ণুপুরের জঙ্গলে আশ্রয় নিল মরাঠারা। রাজা গোপাল সিংহ স্মরণ নিলেন পূজ্য মদনমোহনের। বিষ্ণুপুরের ভাগ্যাকাশে হঠাৎ ঘনাল দুর্যোগের ঘনঘটা। রাতেই এগিয়ে এল ভাস্করের দল। দেখা গেল এক অলৌকিক দৃশ্য: কালো ঘোড়ার পিঠে এক দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণ পুরুষ, ক্ষিপ্রবেগে যুদ্ধ করলেন দস্যুদের সঙ্গে। গর্জে উঠল দলমাদল কামান। কে এই যোদ্ধা-সেনাপতি, যাঁর প্রতাপে নিমেষে ছত্রভঙ্গ লুটেরার দল! পুরোহিত সকালে মন্দির খুলে দেখলেন, মদনমোহন-বিগ্রহের সর্বাঙ্গে বারুদের কালি। বুঝতে বাকি থাকল না কে সেই যোদ্ধা, যাঁর পরাক্রমে গোলাগুলি ফেলে পালিয়েছে ভাস্কর পণ্ডিতের দলবল।

এই সব কাহিনি নিত্যদিন শোনা যায় স্থানীয় গাইডদের মুখে। আমরা শুনছিলাম ভগ্নপ্রায় এক মন্দিরের পাশে কমবেশি একই দশার এক বাড়ির গৃহস্বামীর কাছে। বীর হাম্বিরের সময়ে এই বৈষ্ণব পরিবারটি বাসা বাঁধে বিষ্ণুপুরে। শাখায় শাখায় বড় হয়। এখন উপেক্ষায় পড়ে আছে প্রাচীন বসতবাটী, গৃহদেবতার মন্দির। নিত্যসেবার প্রয়োজনে দেবমূর্তি এখন গৃহাভ্যন্তরে। প্রবেশের অনুপযুক্ত মন্দিরের গায়ে যে যৎসামান্য টেরাকোটা টিকে আছে, তা-ই বলে দেয় কী অনন্য রূপ ছিল তার একদা!

ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মন্দিরের যুক্তিতে জোটে না সরকারি সাহায্য। যে শরিকরা সম্পন্ন, সকলেই প্রায় প্রবাসী। পড়ে আছেন যাঁরা; ইচ্ছে থাকলেও শরিকি সম্পত্তিতে টাকা ঢালার সচ্ছলতা থেকে তাঁরা দূরে। নিত্য তাই দেশব্যাপী অসংখ্য মন্দির, সৌধ, স্থাপত্যের মতোই ক্ষয়ে যাচ্ছে বিষ্ণুপুরের অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা বহু ছোট-মাঝারি মন্দিরও। পারিবারিক ভিটেয়, উত্তরপুরুষদের চোখের সামনে।

অথচ দেশে, রাজ্যে সরকারি আইন বাঁচিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ট্রাস্টের নামে বা গবেষণাকেন্দ্র বলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন মন্দির— হাসপাতাল, স্কুল, সড়ক তৈরি হওয়ার বদলে। ‘ধাম’ শব্দ নিয়ে ঝগড়া বাধছে। আর ইউনেস্কো বা কেন্দ্র-রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের স্বীকৃতি না পেয়ে, আইনি জটিলতায়, উপেক্ষায় ক্রমে ধ্বংস হচ্ছে বহু প্রাচীন স্থাপত্য, সৌধ, হর্ম্য। বিষ্ণুপুরের পর্যটক-প্রবাহ থেকে দূরে থাকা মন্দিরগুলোর মতোই: যারা দেখেছিল এক দস্যু রাজার সাধক হয়ে ওঠা, লুটেরা বর্গিদের তাড়াতে মুসলমান নবাবের প্রতাপ; আর দলমাদল নিয়ে রুখে দাঁড়ানো স্বয়ং মদনমোহনের, হলই বা তা লোকবিশ্বাস!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bishnupur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy