মৌমাছি, মৌমাছি,/ কোথা যাও নাচি নাচি/ দাঁড়াও না একবার ভাই।”— ছড়ায় ছড়ায় অনুরোধ করলেও, মৌমাছিদের দাঁড়ানোর সময় কোথায়! মাত্র কয়েক দিন বা বছরের জীবন তাদের। তার মধ্যেই লক্ষ কোটি ফুলে ঘুরে পুষ্পরস ও রেণু সংগ্রহ করে। সংগ্রহের সময়েই ঘটে পরাগমিলন। ফুল থেকে ফল হয়। ফলের বীজ থেকে গাছ। সেই ফল বা ফসল খেয়ে পৃথিবীর সব পশুপাখি বাঁচে। বাঘ-সিংহের মতো মাংসাশী যে নিরামিষভোজীদের খেয়ে বাঁচে, তাদের খাবার তৈরি হয় পরাগমিলনের মাধ্যমেই। অর্থাৎ, পরাগমিলন না হলে আমরা খেতে পাব না। ফলন কমবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে ও পৃথিবী জুড়ে খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবে।
২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস। জীবাশ্মের পরীক্ষায় জানা যায়, ক্রিটেসিয়াস যুগে এক প্রজাতির বোলতা থেকে মৌমাছিদের উৎপত্তি। অর্থাৎ, ডাইনোসরদের সময়ে ফুলের রস ও রেণু সংগ্রহকারী পতঙ্গের আবির্ভাব হচ্ছিল। এমন উদ্ভিদ জন্মাচ্ছিল, যারা বর্ণময় ফুল ফুটিয়ে পুষ্পরস ও রেণুর বিনিময়ে পরাগমিলনকে কার্যকর ও সুনিশ্চিত করতে চাইছিল। পৃথিবীতে ২০,৪০০ প্রজাতির মৌমাছি আছে। এদের ১০% ঘর-সংসার বেঁধে একত্র থাকে। আমরা তাদের কাউকে কাউকে দেওয়ালের ফাটলে, কার্নিসে, পাহাড়ে, জানলার গায়ে, গাছের কোটরে চাক বাঁধতে দেখেছি। এক সঙ্গে কয়েক হাজার বা লক্ষ মৌমাছি থাকে। বাকি ৯০% থাকে একা। তাদের ৭০%-এর বাসা মাটির নীচে। আমরা যাদের চিনি, তারা মধুমৌমাছি (হানি-বি)। তাদের থেকে মধু ও মৌচাকজাত প্রসাধনী, ওষুধ মেলে। বাকি যে হাজার হাজার প্রজাতির মৌমাছি একা মাটির নীচে থাকে এবং মধু উৎপাদন করে না, তাদের খবর আমাদের কাছে নেই। মধু উৎপাদন ছাড়াও মৌমাছিদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান— পরাগমিলন। ফলের আকার, পুষ্টি, বীজ সংখ্যা, থোকায় ক’টা ফল থাকবে, সব নির্ধারণে মৌমাছিদের ভূমিকা আছে।
চাষের খেতে কীটপতঙ্গ-নাশক, নাইট্রোজেনযুক্ত সারের বহুল ব্যবহার, বিশ্ব উষ্ণায়ন, কারণে অকারণে জঙ্গল ঝোপঝাড় আগাছা কেটে ফেলা, পরিশুদ্ধ জলের অভাব, মাটিদূষণ, নগরায়ণ— নানা কারণে মৌমাছিদের শারীরিক অবনতি ঘটেছে। প্রতি বছর বাংলায় মধু সংগ্রহের মরসুমে, বিশেষত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কোটি কোটি মৌমাছি মারা যায় বিষের প্রভাবে। যে ফসলের পরাগায়নে গিয়ে এত মৌমাছি মরছে, সে ফসল নিরাপদ হওয়া অসম্ভব। মৌমাছি ও অন্যান্য প্রাণী যারা মাটিকে আশ্রয় করে, তারা কেউ বাঁচবে না যদি মাটি, জল ও বায়ুদূষণ চলে, ভারী ভারী যন্ত্র চাষের খেতে ব্যবহৃত হয়। ভারী যন্ত্র তাদের ঘরবাড়ি ভাঙে। মাটি শক্ত হয়ে বসে যায়। যৎসামান্য কর্ষণে অতীতের পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি এখন লুপ্তপ্রায়। মৌমাছিদের বাঁচাতে ওই চাষ পদ্ধতি অবলম্বন প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনে ফুলেদের বার্ষিক ক্যালেন্ডার এলোমেলো হয়ে গিয়েও মৌমাছিদের ভারী সমস্যা। বিভিন্ন ঋতুতে ফুলেরা হয় অনেক আগে নয়তো অনেক পরে ফুটছে। ফলে মৌমাছিদের খাবারের অভাব। দুর্বলতার কারণে রোগ, মড়ক লাগছে। পতঙ্গনাশকের প্রভাবে স্মৃতিভ্রংশ। মৌমাছি আর ঘরে ফেরে না। ফিরলেও বাকি মৌমাছিরা অনেকে সেই বিষে আক্রান্ত হয়।
মধুর জন্য গুরুত্ব পেলেও মনে রাখা দরকার, মধুমৌমাছিরা কয়েকটি মাত্র প্রজাতি মিলে পৃথিবীর সব ফুলের পরাগমিলন ঘটাতে পারে না। আকন্দ ও জারুল ফুলের রস বা রেণু সংগ্রহে আসে মূলত কৃষ্ণনীল ভ্রমর আর ছোট্ট হুলবিহীন মৌমাছি। আপেলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরাগমিলনকারী পতঙ্গ অ্যান্ড্রেনা। দশটা মধুমৌমাছির কাজ একটা অ্যান্ড্রেনা একাই পারে। অ্যান্ড্রেনারা মাটির নীচে একা থাকে। মানুষের আদর-যত্ন পায় না। আজ তারা এত কম যে, বিদেশি মৌমাছির বাক্স বসিয়ে আপেলের পরাগমিলন ঘটাতে হচ্ছে। লঙ্কা, বেগুন জাতীয় গাছের ফুলের পুংদণ্ডগুলোকে বুকের পেশি দিয়ে জড়িয়ে ধরে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে ঝাঁকিয়ে পরাগরেণু বার করতে হয়। এই কাজ কেবল কয়েক রকমের ভ্রমর, পাতাকাটা মৌমাছিরা পারে। কারণ, এই সব ফুলের সঙ্গে সহ-অভিযোজনের মাধ্যমে এই কাজটার প্রয়োজনেই তারা ওই পেশি তৈরি করতে পেরেছে। এই ভাবেই নানা ফুলের সঙ্গে নানা মৌমাছির সম্পর্ক তৈরি হয়েছে লক্ষ কোটি বছর ধরে। তাই সব প্রজাতির মৌমাছিরই বাঁচা জরুরি। নয়তো খাদ্যশৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
এ বছর দেশ জুড়ে পেঁয়াজ চাষিদের হাহাকার। কারণ, পেঁয়াজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরাগমিলনকারী পতঙ্গ ‘অ্যাপিস ডোরসাটা’ (গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য নাম দিয়েছিলেন ‘বাঘা মৌমাছি’) অনেক খেতেই মিলছে না। এতে দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন ৩০-৪০% কমতে পারে। খেতে মৌমাছিরা পর্যাপ্ত হলে ফলন অনেকটা বাড়ে।
বিশ্ব জুড়ে মৌমাছিদের গভীর সঙ্কট; যা পক্ষান্তরে আমাদের বিলোপের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই ফলন, ফসল বৈচিত্র, খাবারে পুষ্টি কমছে। হাত দিয়ে পরাগমিলন করতে হচ্ছে ফসলে। সময় বেশি নেই। স্কুল-কলেজ’সহ নানা পরিসরে ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন। চিলি, পেরু, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, রাশিয়া-সহ নানা দেশে মৌপালকেরা তুমুল আন্দোলন করছেন মৌমাছিদের অধিকার নিয়ে। বলা হয়, আমরা যে খাবার খাই, তার প্রতি তিন গ্রাসের এক গ্রাস মৌমাছিদের দান। বার্ধক্যে উপনীত হলে আমরা মূলত অবসর যাপন করি। কিন্তু একটা মধুমৌমাছি সেই সময় রস রেণু সংগ্রহে বেরোয়, এবং ওই কাজ করতে করতেই বিদায় নেয়। যারা এত নিষ্ঠাভরে সারা পৃথিবীর খাবার, পরনের কাপড় বোনার উপাদান তৈরি করছে, তাদের জন্য কিছুই করব না?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)