E-Paper

বিপ্লবের ভোলবদল

এটাই প্রথম প্রজন্ম, যারা জ্ঞান হওয়া ইস্তক অনলাইন দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-স্ন্যাপচ্যাট-টুইটার-ইউটিউবের দুনিয়া এদের স্বাভাবিক চারণভূমি। তাদের পরস্পরের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমও ইন্টারনেট, আবার সাংস্কৃতিক লেনদেনও ইন্টারনেটেই।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:২২
সাহস: বিভিন্ন সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে তরুণ প্রজন্ম। কাঠমান্ডু, ৮ সেপ্টেম্বর।

সাহস: বিভিন্ন সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে তরুণ প্রজন্ম। কাঠমান্ডু, ৮ সেপ্টেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

গোটা দুনিয়ার স্বৈরশাসকদের মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে জেন জ়ি। নেপাল থেকে মাদাগাস্কার, শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ থেকে পেরু, গত কয়েক বছরে আক্ষরিক অর্থেই যত্রতত্র জেন জ়ি-বিপ্লব ঘটেছে, উৎখাত হয়েছে শাসকের সিংহাসন। ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জন্ম যাদের, তারাই জেনারেশন জ়ি— সংক্ষেপে জেন জ়ি বা জ়ুমার। তরুণরা বিপ্লব করবে, বস্তুত তরুণরাই বিপ্লব করবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই— যুগে যুগে কবিরা আঠারো বছর বয়সের জয়গান করেছেন। কিন্তু, এই ‘আঠারো’র সঙ্গে অতীতের বিভিন্ন কালপর্বের ‘আঠারো’-র এমন কিছু মোক্ষম অমিল রয়েছে, যাতে আজকের বিপ্লবের চরিত্রটি বুঝতে গেলে জেন জ়ি-কে আলাদা ভাবে দেখতেই হবে।

যেমন, এটাই প্রথম প্রজন্ম, যারা জ্ঞান হওয়া ইস্তক অনলাইন দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-স্ন্যাপচ্যাট-টুইটার-ইউটিউবের দুনিয়া এদের স্বাভাবিক চারণভূমি। তাদের পরস্পরের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমও ইন্টারনেট, আবার সাংস্কৃতিক লেনদেনও ইন্টারনেটেই। পাড়া-শহর-দেশের গণ্ডি টপকে খুব সহজে বিশ্ব-নাগরিক হওয়া যায় আজ। আবার, বিভিন্ন সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, এই প্রজন্ম খবর সংগ্রহের জন্য সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের মুখাপেক্ষী নয়— দুনিয়া জুড়ে কী ঘটছে, সে খবরও তারা সমাজমাধ্যম থেকেই পায়। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা বা পাড়ার দাদাদের প্রভাব জেন জ়ি-দের উপরে কম; তুলনায় বেশি প্রভাব পড়ে আন্তর্জাতিক ঘটনাক্রমের। ইন্টারনেট এই প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করেছে— বেশ কয়েক জন তরুণ পাশাপাশি বসে থেকেও গল্প করার বদলে প্রত্যেকে তাকিয়ে আছে নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে, এই দৃশ্য আমাদের সবারই কম-বেশি চেনা; আবার, ইন্টারনেটই এদের সংযুক্ত করেছে— ক্যালিফোর্নিয়ায় তরুণরা বিক্ষোভ দেখালে কলকাতায় তার অনুরণন ঘটে, ক্ষোভের কারণগুলো মিলে যেতে থাকে।

ক্ষোভের কারণ, প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে, ব্যক্তিগত। জেন জ়ি জন্মেছে, বড় হয়ে উঠেছে এমন একটি সময়ে, যখন ৯/১১ ঘটে গিয়েছে, ২০০৭ সালের আর্থিক সঙ্কট ঘটেছে, কোভিড-এর লকডাউন ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর দুনিয়ায় উদার অর্থনীতির যে হাওয়া বয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে, তা-ও ক্রমে ক্ষীণ হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের জন্য সুযোগ কমেছে, শোষণ বেড়েছে— নিদেনপক্ষে, তেমনটা হচ্ছে বলে মানুষ মনে করেছেন। পাশাপাশি বেড়েছে আর্থিক বৈষম্য। এক দিকে কিছু লোকের তুমুল সমৃদ্ধি, আর অন্য দিকে অনেকের ক্রমশ কাহিল হতে থাকা আর্থিক অবস্থা— সমাজমাধ্যমের কল্যাণে এই বাস্তব আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে তরুণদের সামনে। আজ বাদে কাল মা-বাবার চাকরি থাকবে কি না, এই প্রজন্মের অনেকই জানে না; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পৃথিবীটাকে আরও কতখানি পাল্টে দেবে, সেখানে আদৌ তাদের চাকরি জুটবে কি না, জানে না সেটাও। আর, এই পুরো ঘটনাটাই ঘটছে সেই পৃথিবীতে, যার চালিকাশক্তি হল নির্বিকল্প ভোগবাদ। বিপণনের বয়ান স্থির করে দিয়েছে ভাল থাকার অর্থ— আরও বেশি কিনতে পারা, আরও নতুন জিনিস কিনতে পারা, নিরন্তর কিনে চলতে পারা। সেই ভাল থাকা অনিশ্চিত হলে ক্ষোভ জমছে স্বাভাবিক ভাবেই। তার পর, কোনও একটি কারণে বিস্ফোরণ ঘটছে তার।

এই অনিশ্চিত সময়ের দখল নিয়েছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি। না, জেন জ়ি তার আগের প্রজন্মগুলির তুলনায় বেশি ঝুঁকছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে, তার কোনও প্রমাণ নেই। বরং, বিভিন্ন দেশে যে সমীক্ষা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, আগের প্রজন্মের তুলনায় বরং জেন জ়ি-ই কম ভোট দিচ্ছে দক্ষিণপন্থীদের। কিন্তু, সমর্থক হয়ে ওঠা এক কথা, আর প্রভাবিত হওয়া অন্য এক। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি চলে মূলত ভয় তৈরি করে— আগের থেকে খারাপ থাকার ভয়, সুযোগ হারানোর ভয়, আধিপত্য খোয়ানোর ভয়। সেই ভয় প্রভাবিত করেছে জেন জ়ি-কেও। সমাজমাধ্যম তাদের সব খবরের উৎস, তা চালিত হয় নির্দিষ্ট অ্যালগরিদম মেনে— যে ধরনের খবর তারা পড়ে, অ্যালগরিদম তাদের সমানে তেমন খবরই দেখিয়ে যেতে থাকে। সে খবর মিলে যায় তাদের সঙ্কুচিত বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গেও। জেন জ়ি ভয় পায়, ভয় পেতে পেতে রেগে যায়, রেগে যেতে যেতে কোনও এক দিন কোনও একটা কারণে ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

কিন্তু, সে ক্ষোভ ব্যক্তিগত— নিজের অপ্রাপ্তি থেকে তার জন্ম। অতীতের আঠারো যেমন স্বপ্ন দেখত দিনবদলের, যৌথ খামারের, জেন জ়ি-র বিপ্লব সেই রোম্যান্টিকতাহীন। তাদের জন্ম, বড় হয়ে ওঠা এক উত্তর-আদর্শবাদী সময়ে— ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘটার পর। তদের বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিবাদ আসলে এই সময়ের ফসল— যেখানে সমষ্টি বলতেও বড় জোর বোঝায় নিতান্ত ‘পিপ্‌ল লাইক আজ়’-কে, আর্থ-সামাজিক অবস্থানে আমাদের পাশাপাশি থাকা মানুষকে। ফলে, এই প্রজন্মের কাছে যে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। লিঙ্গ-পরিচয় বাছার অধিকার থেকে ইন্টারনেটে অবাধ মতপ্রকাশের অধিকার যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পরিবেশ সচেতনতার রাজনীতিও শেষ অবধি ব্যক্তির জায়গা থেকেই তৈরি হয় এই প্রজন্মের কাছে। সরকারকে দুর্নীতিমুক্ত করার দাবিও শেষ অবধি ব্যক্তিরই দাবি— দুর্নীতি কমলে ব্যক্তির জন্য কাজের সুযোগ বাড়বে, সহজ হবে ভোগবাদের দুনিয়ায় যোগ দেওয়া। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের চেয়ে ব্যক্তির ভাল থাকা নিশ্চিত করার বিপ্লব ভাল না খারাপ, সেই বিচারের প্রয়োজন নেই— বিশেষত, অতীতের সে সব বিপ্লবের যত কঙ্কাল এ দুনিয়া দেখেছে, তার পর তাকে আলাদা করে মহিমান্বিত করার আগে দু’দণ্ড ভেবে নেওয়া ভাল— এখানে শুধু এটুকু মনে রাখলেই হবে যে, জেন জ়ি-র বিপ্লব একেবারে চরিত্রগত ভাবে আলাদা। বিশ শতকের দুনিয়া ‘রাজনীতি’কে যে অর্থে চিনেছে, সে অর্থে জেন জ়ি-র বিপ্লবে রাজনীতি নেই, প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার তাগিদও নেই।

বরং, এক ধরনের স্পষ্ট ‘কনফর্মিজ়ম’ আছে— সমাজে যে প্রতিষ্ঠিত উচ্চাবচতার সম্পর্ক, তাকে মেনে চলার প্রবণতা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, যত দেশে জেন জ়ি খুব রেগে গিয়ে উৎখাত করেছে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসককে, তার কোথাওই তারা সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেনি। নিজেদের সরকার গড়েনি, নিজেদের হাতে তুলে নেয়নি প্রতিষ্ঠানের ভার। বরং, বেছে নিয়েছে এমন কাউকে, যিনি প্রচলিত ব্যবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত— কিন্তু, আগের শাসকের পন্থী নন। কোনও দেশে তিনি পূর্বতন স্বৈরশাসকের রোষে পড়া সামাজিক উদ্যোগপতি, কোনও দেশে ভূতপূর্ব বিচারক, কোথাও আবার কোণঠাসা বিরোধী দলনেতা। কোথাও শাসনক্ষমতা গিয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। দেশের শাসনব্যবস্থাকে তাঁরা চরিত্রগত ভাবে পাল্টে দেবেন, এমন দাবি এই নতুন প্রধানরা করেননি, সে প্রত্যাশাও নেই তাঁদের কাছে। জেন জ়ি আশা করেছে, তাঁরা ক্ষমতাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখবেন, আর্থিক সমৃদ্ধির সুযোগ আরও বেশি পৌঁছে দেবেন ‘পিপ্‌ল লাইক আজ়’-এর কাছে। দুনিয়ার ইতিহাস আগে কখনও বিপ্লবের এমন সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞা দেখেনি।

রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসকরাও নিশ্চিত ভাবেই বিশ্লেষণ করছেন এই বিপ্লবের চরিত্র। বুঝে নিচ্ছেন, কোথায় কতখানি জায়গা ছাড়লে জেন জ়ি-র ক্ষোভ পৌঁছবে না বিস্ফোরণের তাপমাত্রায়। উল্টো দিকে, যে বিরোধী নেতারা ভাবছেন জেন জ়ি-র ক্ষোভকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার কথা, তাঁরাও হিসাব কষে দেখছেন, জেন জ়ি-র মন ছোঁয়ার জন্য কোন প্রশ্নগুলিকে তাঁরা গুরুত্ব দেবেন, আর কোন প্রশ্নগুলিকে ঠেলে দেবেন পিছনের সারিতে। যুক্তি বলে, রাজনীতির উভয় মেরুই দ্রুত পৌঁছে যাবে একটি সম-অবস্থানে— যেখানে শ্রেণিগত শোষণ থেকে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির অন্যায্যতা, জাতিবিদ্বেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বৈষম্য, কোনও প্রশ্নই আর প্রথম সারিতে থাকবে না। শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের জন্য আরও সুযোগ তৈরির দাবির গুরুত্ব কোনও মতেই খাটো করার নয়, কিন্তু সেটাই যদি রাজনীতির একমাত্র বিবেচ্য হয়ে ওঠে, তবে কাদের লাভ আর কত জনের ক্ষতি, সে কথা ভাবতেই হবে। জেন জ়ি-র বিপ্লবকে বুঝতে গেলে এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Protest Politics Revolution

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy