E-Paper

আশ্চর্য প্রতিবাদের প্রবাহ

এই লেখক সমস্ত মন দিয়ে মানেন প্রাকৃতিক কৃষির প্রবক্তা মাসানোবু ফুকুওকাকে। বৃদ্ধির হার শূন্য শতাংশ হলে ক্ষতি নেই, যদি ওই শূন্যের আশ্রয়ে দেশের সিংহভাগ মানুষ সমৃদ্ধ হয়।

রুশতী সেন

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৪১

বৃষ্টি শেষে আকাশ কী নীল, যেন স্নেহ। মধ্যে/ পাখি উড়ছে। খোঁচা হয়ে আছে কাঁটা/ তারও মুখে আলো”— লাল স্কুলবাড়ি (১৯৭৮) সঙ্কলনের ‘নিসর্গে: মুক্তি’ নামের কবিতাটি প্রথম পড়েছিলাম কলেজজীবনে! ওই সঙ্কলন মণীন্দ্র গুপ্তের (ছবি) চতুর্থ বই। নীল পাথরের আকাশ, আমার রাত্রি, মৌপোকাদের গ্রাম অর্থাৎ আগের তিনটি বই তখনও পড়িনি। কেবল জানতাম, এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা-র অন্যতম সম্পাদক এই কবি। লাল স্কুলবাড়ি পড়ে মনে হয়েছিল, মুক্তির কোনও নতুন অবলম্বন কি এর পরতে-পরতে? নাকি বিষাদ আর তার উপশম মিশে আছে কবিতায়?

তাঁর গদ্যের বই চাঁদের ওপিঠে-র (১৯৯১) ‘উত্তরদ্বাদশ’ অংশে নিজের কবিতা-চর্চা আর সংসার-সমাজ প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন, “…ক্যাশ মেমোর সাদা পিঠে, বই কিংবা চায়ের বাদামি ঠোঙায় খসড়া করা কবিতা আমার সহজে উতরোয়। এক বন্ধু তার ব্যবসা উঠে যাবার পর ডেলিভারি চালানের একখানা আস্ত বই উপহার দিয়েছিল। ডিমাই অক্‌টেভো, পাতাগুলো পর পর হলদে, গোলাপি আর সাদা। লাল স্কুলবাড়ি-র প্রায় সব কবিতাই ওই ডেলিভারি চালানে লেখা।” মনে হল, ছাত্রজীবনে অপরিণত মুগ্ধতায় যাকে মনে হয়েছিল মুক্তি অথবা বিষাদের উপশম, তা আসলে আশ্চর্য প্রতিবাদের প্রবাহ; যে প্রতিবাদ মানুষের পণ্যরতি আর হিসাবনিকাশের বিরুদ্ধে, মানবসভ্যতার আত্মমগ্ন থেকে আরও আত্মমগ্ন অগ্রগমনের বিরুদ্ধে। এ প্রতিবাদে কোনও উচ্চকণ্ঠ নেই, সমর্থনের জন্য আকুলতা নেই, অসহমতে নেই কোনও উত্তেজনা।

তাঁর ছয় নম্বর কবিতার বই শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু-তে (১৯৯২) আছে ‘পূর্ণিমা’ নামের এক আশ্চর্য কবিতা। পূর্ণিমা মেয়েটি একা একা মধ্যগগন পাড়ি দিয়ে চতুর্দশী পেরিয়ে আসে অনন্ত দুর্ভাগ্য পিছনে ফেলে। আলাদা আলাদা পদবিতে আলাদা আলাদা ভবিতব্য তার। কোনও ভবিতব্যেই নেই কোনও বিশিষ্ট জীবন। “কিন্তু রাতের বেলা, ধোয়াপোঁছা পূর্ণিমা, তত সহজ মেয়ে না।” নিজের সম্ভাব্য সব বিকল্প দুর্ভোগের কথা শুনে “… সে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর/ গম্ভীর হয়ে দু হাত বাড়িয়ে বলল, ‘এসো, আমরা এই/ পূর্ণ নিশীথিনীর মধ্যে ডুব দি’।”

২০১১-য় নিজের কবিতাসংগ্রহ-র দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় মণীন্দ্র গুপ্ত লেখেন, “১৯৯৪ থেকে আমার কবিতা… পালটাচ্ছে… এখন কবিতায় লোকটা কম, তাকে ঘিরে থাকা হাওয়াবাতাসই বেশি। এখন সে লেখে আবহাওয়ার কবিতা।” পূর্ণিমার সিং-বিশ্বাস-বাগচি-সর্দার থেকে চতুর্দশী-অতিক্রান্ত পূর্ণিমায় উত্তরণের এই কবিতায় কি আবহাওয়ার কাছে সমর্পণের উপক্রমণিকা পড়ে নিতে পারেন পাঠক? অথচ তাঁর যে কোনও কবিতার মতো ‘পূর্ণিমা’তেও পাঠকের পারা কিংবা না-পারা, পড়া কিংবা না-পড়া প্রসঙ্গে কবি আশ্চর্য নির্লিপ্ত। পাঠকের জন্য তাঁর অনন্ত প্রতীক্ষা কখনও ব্যাহত হত না পাঠকের কাছে পৌঁছনোর অন্যায্য ব্যগ্রতায়। হরেক রকম সাহিত্য পুরস্কার প্রসঙ্গে অনায়াসে বলতে পারতেন তিনি, পুরস্কার এক রকম প্রলোভন, তা আশা করলে মন উত্তেজিত হয়, পেলে বিগলিত হয়, না পেলে হতাশায় ক্লিষ্ট হয়— এর কোনওটাই কবিতার পক্ষে অনুকূল নয়। নয় দশক অতিক্রান্ত তাঁর দীর্ঘ যাপনে নিজের ওই কথাকে তিনি লালন করেছেন সৃজনে, জীবনে।

এমন লালন ছাড়া লেখা যায় না অক্ষয় মালবেরি-র মতো আত্মকথা। আত্ম-কে বিলীন করে, কথার ভিতরকার কথা থেকে বিশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশকে নিজের জন্মভূমি, বরিশালের গৈলা গ্রামকে, সেই গ্রামের দৈনন্দিন সমাজনীতি-অর্থনীতিকে, হয়তো বা রাজনীতিকেও সবাক করে তোলা। সাংসারিকের সঙ্গে সামাজিকের, অর্থনৈতিকের সঙ্গে মানবিকের বিরোধ-সখ্য কত বৈচিত্রে মূর্ত হয় বর্ষীয়ান লেখকের বাল্যস্মৃতিতে। বিষয় আর তার বুনট যেন পরিপূরক একে অন্যের, গদ্যেরও অন্তহীন সুষমা। তুলির একটি বাড়তি টানও নেই, আবার নামমাত্র অংশও রঙের অভাবে রিক্ত নয়। অনেক দিন পরে, ২০১৩-য় গ্রন্থিত মণীন্দ্র গুপ্তের অসামান্য সৃজন রং কাঁকর রামকিঙ্কর পড়তে পড়তে তিন পর্বের অক্ষয় মালবেরি-কে (১৯৮১, ১৯৯৮, ২০০৪) ফিরে ফিরে মনে পড়ে।

দশ মাস বয়সে উনিশ বছরের মাকে হারিয়েছিলেন মণীন্দ্র। অজ্ঞান বয়স থেকেই শুনতে হত, “হায়, পোড়াকপালিয়া, জন্মাইয়াই মায়রে খাইছ!” বড়মা, ছোটমা, ‘ঐ ঘরের মা’-র সাহচর্য, গৈলা গ্রামের আকাশে ওঠা চাঁদের সখ্য, জঙ্গলের ভিতরে গাছপালায় ঢাকা ছোট্ট খাড়াই পাড়ওলা ডোবার উপরকার একবগ্‌গা ছোট সাঁকো, ডোবার বাসিন্দা গোসাপযুগল, গ্রামের বাস্তু, গ্রামের সাপ, গ্রামবালকদের আয়ত্তাধীন অফুরান প্রাকৃত ভাঁড়ার, সব ছেড়ে বালককে চলে যেতে হয়েছিল সুরমা উপত্যকায়, দিদিমার কাছে। এমনই ছিল মা-মরা ছেলেটির ঠাকুমা-দিদিমার পারস্পরিক চুক্তি— ঠাকুমার মৃত্যুর পরে ও-ছেলে দিদিমার হাতে যাবে।

স্কুলজীবন কাটিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া, বাল্য থেকে বয়ঃসন্ধির আট-আটটি বছর পার করা, সবই ওই উপত্যকায়। তার পর উঞ্ছবৃত্তির জীবিকা, জীবিকাহীনতা, সেনাবাহিনীর কাজে যোগদান। অক্ষয় মালবেরি-র দ্বিতীয় পর্বে আছে, “ঐ উপত্যকার সঙ্গে যে আমার বন্ধন হল না তার আসল কারণ… আমি ওখানে ছিলাম পরবাসী, পরভৃত… জীবনের শেষে, মনে হয়, এই পৃথিবীতেই আমি পরবাসী, পরভৃত।” পরবাসীর ব্যক্তিক বেদনা একাকার হয়ে যায় তাঁর চার পাশের পৃথিবীটার ভয়ঙ্কর অগ্রগমনকে প্রত্যক্ষ কররার অভিজ্ঞতায়। পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান (১৯৯৮) বা জনমানুষ ও বনমানুষ (২০০৩)-এর মতো গদ্যগ্রন্থে আধুনিক সমৃদ্ধি-প্রসারের একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে লেখক অনুভব করেন, প্রকৃতি, পাখি, কেঁচো, পতঙ্গের হাতে জন্মানো শাক-কন্দ-ফল-শিম-শস্যের বৈভব; মাটির উপরে মানুষের তুলনায় গাছের অনেক জোরালো স্বত্বস্বামিত্ব। অন্ন কুড়িয়ে প্রাণধারণ করা কুড়ানিজীবন পৃথিবী-আকাশ-বায়ুমণ্ডল-ঋতুচক্রের সঙ্গে ওতপ্রোত অন্বয়ে তাঁর কাছে ধরা দেয় মহাজীবনের এক দীন আর আলগা রূপের উপমায়; জমির মালিকানা নিষ্প্রয়োজন, চাই কেবল পরিষ্কার সীমানা-ঘেরা দেশ। আবহাওয়ার কবিতাতেই এ কবির পরিণত আত্মপরিচয়!

গৈলা গ্রাম পরদেশ হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাতে কোন চৈতন্যের উৎস? সমাজবিজ্ঞানের কোনও ক্ষেত্রে স্বীকৃত অধিকার ছাড়াই যে চেতনার বিষাদে নিশ্চিত বলা যায়, “দেশভাগ করতে না দিয়ে পাঁচশালা পরিকল্পনা না করে, গুচ্ছের আয়োগ-নিগম-পর্ষদ-দফতর না খুলে, ইংরেজরা চলে যাবার পর আমাদের উচিত ছিল দেশটাকে কয়েক বছর ফেলে রাখা… জাতির প্রাণশক্তি আর আত্মার শক্তি (তাতে) বাড়ত… দেশটা লুণ্ঠিত পিতলের ঘড়ার মত বেঁকেতুবড়ে টোল খেয়ে শূন্যগর্ভ হয়ে আছে অনেক দিন… ঘুম, নিরাময় আর শান্তি প্রথম দরকার… নিবৃত্তি… কর্মসন্ন্যাস… ত্যাগ বৈরাগ্য বা প্রত্যাহার নয়… স্রোতের মধ্যে স্রোত হয়ে লীন হয়ে থাকা।” পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান-এর এই লেখক সমস্ত মন দিয়ে মানেন প্রাকৃতিক কৃষির প্রবক্তা মাসানোবু ফুকুওকাকে। বৃদ্ধির হার শূন্য শতাংশ হলে ক্ষতি নেই, যদি ওই শূন্যের আশ্রয়ে দেশের সিংহভাগ মানুষ সমৃদ্ধ হয়।

রক্তিম পলাশ, সাদা দ্রোণ আর চালতার ঐশ্বর্যে ভরা অক্ষয় মালবেরি-র স্মৃতিতে সম্পন্ন মণীন্দ্র গুপ্ত আটাত্তর বছর বয়সে জীবনের প্রথম উপন্যাসের দুয়ারে পৌঁছেছিলেন। না, নায়ক ত্রিনাথের কোনও অক্ষয় মালবেরি নেই, গৈলা গ্রাম নেই। আস্তাকুঁড় থেকে গজিয়ে ওঠা এই ত্রিনাথ নিজের অতীতের সন্ধানে বেরোয়, তার সেই অতীত নিজেকেই বানাতে হবে। ত্রিনাথ আর লোকেশ্বরীর দাম্পত্য আর দাম্পত্যহীনতার গল্পই আছে প্রেম, মৃত্যু কি নক্ষত্র (২০০৫) উপন্যাসে। কিন্তু ওই ব্যক্তিগতে মিশে থাকে শূন্যগর্ভ দেশের উপর আয়োগ-নিগম-পর্ষদ-দফতরের নিরর্থক চাপ, উন্নয়নের নামে দেশজ জীবনযাত্রার ক্ষয়, পেট্রলের গন্ধে ফুলের সুবাস চাপা পড়া। নিশ্চিত বোঝা যায় না, ত্রিনাথ তার অক্ষয় মালবেরির দেশ খুঁজে পাবে কি না। তার অতীত নির্মাণ সার্থক হবে কি না।

দ্বিতীয় উপন্যাস নুড়িবাঁদর-এর (২০১৬) নায়ক প্রাকৃতিক জলধারার স্পর্শে নুড়ি থেকে বাঁদর হয়েছে; জীবন জুড়ে সে বুঝছে, মানুষ কত স্বার্থপর, হিংস্র, তুলনায় তথাকথিত মনুষ্যেতরদের কত মায়া! জ্ঞানী বাঁদরের গার্হস্থের সূচনায় উপন্যাস শেষ। সাহিত্য অকাদেমি ও রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ বনে আজ কনচের্টো-তে (২০০৯) পাঠক পাবেন ‘হরগৌরী নুড়ি’ কবিতাটি: “পৃথিবী যেন একটা গোলাকার হরগৌরী নুড়ি,/ হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার খেলতে ইচ্ছে করে।” এমন যাঁর বাসনা, তাঁর সৃজনে নুড়ি থেকে ব্যুৎপন্ন বাঁদর জন্ম নেবে, দোলা দেবে স্রষ্টার হাওয়াবাতাসের সৃজনবিশ্বে, এ তো স্বাভাবিক!

শেষ উপন্যাস নেংটি-র সমাপ্তি লেখকের নিতান্ত অসুস্থ শরীরে, মৃত্যুর পাঁচ মাস আগে। একান্ত সফল জীবন থেকে নেংটিমোহনের চিরবিদায়ের পরিণাম বদলাতে হল উপন্যাসের অন্তিমে। তখনও যে নেংটি ফিরতে পারেনি দেশের স্বাধীনতার বালাই মানা দেশান্তরে, তার গৈলা গ্রামে! অনেক দিন আগে মরে যাওয়া ঠাকুমা আর মায়ের সঙ্গে আকাশপথে নেংটির গৈলা যাত্রা। জীবিতরাও কেউ কেউ সহযাত্রী। কল্পবাস্তবের আঙিনা ব্যেপে ও-যাত্রা যেন অক্ষয় মালবেরি-র প্রথম পর্বের সেই নির্বস্তুক বিশ্বের দিকে। পাঠক কি বুঝেছিলেন, জীবনভর স্রোতের বিপরীতে তরী বাওয়া মানুষটি কল্পনা করছেন জীবন থেকে বিদায় নেওয়ার কাঙ্ক্ষিত চলন? মনে পড়ে যুগীপাড়ায় অনন্তজ্যাঠার দুর্গা গড়া দেখে দেখে যাঁর সৃজনপথের সূচনা, সেই রামকিঙ্কর জীবনের একেবারে শেষে বানিয়েছিলেন ছোট একটি দুর্গামূর্তি। রং কাঁকর রামকিঙ্কর-এর লেখক এ কাহিনি পরম মায়ায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

মণীন্দ্র গুপ্তের (২৪ অক্টোবর ১৯২৬-৩১ জানুয়ারি ২০১৮) মতো অনুত্তেজক প্রতিবাদে স্থিত, নির্লিপ্ত, অন্তর্মুখী মানুষটির শতবর্ষের সূচনায় ভাবি, বাস্তবে ছিলেন তো তিনি এই নিদারুণ পৃথিবীর চৌহদ্দিতে? নাকি তাঁর জীবনটাও এক কল্পবাস্তব? তাঁর নেংটি উপন্যাসের বিকল্প পরিণামের মতো?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Literature Poet Bengali Poet

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy