Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Russia-Ukraine War

ইউক্রেনের যুদ্ধের ক্ষতি কি শুধু দুটো দেশের মানুষেরই?

এই যুদ্ধ গোটা বিশ্ব বাজারেই এক বিশাল অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। আর মানবিক ক্ষতির অঙ্ক পেরিয়ে বাজারের লাভের অঙ্কও কষা শুরু হয়ে গিয়েছে।

Ukraine war and global challenge

যুদ্ধের অনুরণন নাড়িয়ে দিতে পারে গোটা বিশ্বের আর্থিক সমীকরণকে। — ফাইল চিত্র।

সুপর্ণ পাঠক
সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৩৬
Share: Save:

যুদ্ধ নয় শান্তি চাই! কিন্তু চাইলেই কি পাওয়া যায়? অশান্তির গতিবিদ্যা খুবই জটিল। কিন্তু জমি দখলের লড়াইয়ে যে অন্যতম প্রধান কারণ আর্থিক, তা নিয়ে কোনও মহলেই কোনও সংশয় নেই। ইউক্রেন যুদ্ধও এই গতিবিদ্যার ব্যতিক্রমী অধ্যায় নয়। এক বছর ধরে চলে আসা এই যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব বাজারে সুদূরপ্রসারী। কৃষি সংশ্লিষ্ট শিল্পের পুনর্বিন্যাস থেকে শুরু করে দুর্ভিক্ষের ইন্ধন— বিশ্বের আগামী দিনের আর্থিক ইতিহাসে এই যুদ্ধ একটা আলাদা পরিচ্ছেদ নিশ্চয়ই দাবি করবে।

কিন্তু আজ? এই যুদ্ধ গোটা বিশ্ব বাজারেই এক বিশাল অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। আর মানবিক ক্ষতির অঙ্ক পেরিয়ে বাজারের লাভের অঙ্কও কষা শুরু হয়ে গিয়েছে। যেমন সারের বাজার। প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর সারের বাজার ছিল চিন এবং রাশিয়ার একচেটিয়া। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞায় সারের বাজারে কানাডার আধিপত্য একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে।

এক দিকে যেমন কৃষি সংশ্লিষ্ট বাজারে আধিপত্যের লড়াই শুরু হয়েছে, অন্য দিকে খাদ্যশস্যের সরবরাহ শৃঙ্খল ঘেঁটে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়ছে মুদ্রাস্ফীতির উপরও। জি২০ গোষ্ঠীর বৈঠকে এসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ড বলেছেন মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাঁদের লড়াই অব্যাহত। মার্চ মাসে আরও ৫০ শতাংশ বিন্দু সুদের হার তাঁরা বৃদ্ধি করবেন। মুদ্রাস্ফীতিকে ২ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা থেকে তাঁরা সরছেন না। চাহিদার উপর রাশ টানতে যা যা করার তাঁরা করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, আর্থিক বৃদ্ধির উপর যে প্রভাব এই মুহূর্তে উন্নত দুনিয়ায় দেখা যাচ্ছে তা স্বল্পস্থায়ী। আর্থিক শৃঙ্খল এবং সম্পদের অঙ্কে উন্নত দুনিয়ার যে অবস্থান তাতে এই চাপ নিতে কোনও অসুবিধা হবে না।

কিন্তু এ তো অঙ্ক। আজ যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে মুদ্রাস্ফীতির হার ২৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে তাঁর অসহায়তার কথা গোপন করেননি। কিন্তু তাঁর আরও বড় চিন্তার কারণ হল তাঁর দেশের কৃষির উৎপাদন কমছে। কিন্তু এটা কি শুধু তাঁরই উদ্বেগ?

ইউক্রেনকে বিশ্বের খাদ্যশস্যের ঝুড়ি বলা হয়। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সরবরাহকারী হিসাবে ১০ শতাংশ খাদ্যশস্যের বাজার দখলে ছিল ইউক্রেনের। আর তার ৩০ শতাংশই ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সমীক্ষা বলছে ইউক্রেনের ২৫ শতাংশ কৃষিজীবী হয় উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন, না হলে কমিয়ে দিয়েছে উৎপাদন। তার কারণ একটাই। যুদ্ধের কারণে বাজারে পৌঁছনোই একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সেই যুদ্ধের কারণেই রফতানি মার খাচ্ছে। কারণ বিশ্ব বাজারে পৌঁছে ওঠা যাচ্ছে না।

ক্রিস্টিন লাগার্ডের দাবি তাঁরা মুদ্রস্ফীতির সঙ্গে লড়াই থেকে পিছু হঠবেন না। গত তিন মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মুদ্রাস্ফীতির গড় হার ১১ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু কয়েকটি সদস্য দেশে তার হার এখনও ১০ শতাংশ থেকে নামতে নারাজ। আর মুদ্রাস্ফীতি সূচকের অঙ্কে খাদ্যের দামের অবদান ২০ শতাংশের মতো।

এ বার লাগার্ড মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই নিয়ে যতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকুন না কেন ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য আসা কমার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা আর সরবরাহের মধ্যে ফাঁক আরও বাড়বে। তাই চিন্তার জায়গা তৈরি হচ্ছে। আট শতাংশ থেকে দুই শতাংশে নামানোর দৌড়টা কঠিন। কারণ সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমানোর চেষ্টায় যে বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা আমরা জানি। আসলে উন্নত দুনিয়ায় বৃদ্ধির হার নিয়ে দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ কিন্তু সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর লড়াইয়ে বিনিয়োগের খরচ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়া। আর ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সুবিধা হল খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে স্বনির্ভর থাকা। কিন্তু উন্নত দুনিয়ায় সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতও তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকছে না।

সাধারণ নাগরিকের দুর্দশার কারণেই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হানিকর। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধ এ বার বোধহয় অনেক বেশি করে তার আর্থিক অভিঘাতকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। যেমন সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষতুল্য অবস্থা। কোভিড, উষ্ণায়ন এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের মিলিত প্রভাবে সোমালিয়ার নাগরিকদের না খেয়ে কাটাতে হচ্ছে। বিশ্বের যে দু’টি দেশ উষ্ণায়নের বলি হিসাব শীর্ষে রয়েছে, তার মধ্যে সোমালিয়া অন্যতম। সোমালিয়া খাদ্যশস্যের নিট আমদানিকারী দেশ। পশুচারণ মূল পেশা। পর পর খরার কারণে সে পেশা লাটে উঠেছে। খাদ্যশস্যে আমদানির মূল দেশ ছিল ইউক্রেন। যুদ্ধের কারণে তার খরচ এত বেড়ে যায় যে তা সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায়। সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দাম দিয়েও রোজের রুটি জোগার করা কঠিন হয়ে গিয়েছে সোমালিয়ায়। এমনিতেই রাজনৈতিক ভাবে অস্থির এই অঞ্চল আরও অস্থির হয়ে উঠেছে ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণেই। আর্থিক শৃঙ্খল ভাঙলে রাজনৈতিক শৃঙ্খলও যে ভেঙে পড়ে তার কার্যকরণ বুঝতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। তাই ইউক্রেনের যুদ্ধের এই অভিঘাত সুদূরপ্রসারী।

আর ইউক্রেনের নিজের অবস্থা? যে দেশ বিশ্বের খাদ্যশস্যের ঝুড়ি হিসাবে পরিচিত ছিল সেই দেশের নাগরিকই এখন তাঁর মাসিক খরচের ৫০ শতাংশ শুধু খাবারের উপরই ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের মুদ্রাস্ফীতির একটা বড় অংশই খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধির কারণে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা বলছে যুদ্ধের প্রথম ছয় মাসেই ইউক্রেনের গ্রামের মানুষের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।

আমরা যে ভাবেই ভাবি না কেন, ইউক্রেনের এই যুদ্ধ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আজ বিশ্বায়নের দুনিয়ায় কোনও যুদ্ধ একটি বিশেষ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ থাকলেও তার অনুরণন কিন্তু নাড়িয়ে দিতে পারে গোটা বিশ্বের আর্থিক সমীকরণকেই। কিন্তু আমরা কি হ্রদয়ঙ্গম করতে রাজি? নাকি আমরা চোখ থেকেও অন্ধ হয়েই বাঁচব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Russia-Ukraine War Ukraine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE