ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দু’দিন ঘোরতর আকাশযুদ্ধ হওয়ার পরেই যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। যদিও আশঙ্কা থাকছেই যে, পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ প্ররোচনার কারণে মাঝেমধ্যেই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করবে— কিন্তু, তার পরও ভারতকে হয়তো দীর্ঘমেয়াদে সংযম দেখাতে হবে। সর্বাগ্রে মনে রাখতে হবে যে, ভারতের আর্থিক, তথা রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা এবং বৃদ্ধির সম্ভাবনা পাকিস্তানের তুলনায় অনেক ভাল— বস্তুত, দু’দেশের মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না। যুদ্ধের কারণে ভারতের সেই গতিময়তা মন্থর হয়ে পড়ুক, তা কাম্য নয়।
সাধারণ পর্যটকদের খুন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মদতপ্রাপ্ত জঙ্গিরা যে ভারতকে যুদ্ধে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, তার পিছনে কাশ্মীর নিয়ে তাদের চিরাচরিত অন্যায্য দাবি যেমন আছে, তেমনই আছে সেনাবাহিনীর নিজস্ব ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রশ্ন। কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক ক্ষমতা দেয় পাকিস্তানে। এ দিকে, সীমিত যুদ্ধ অস্ত্রের ভান্ডার বাড়াতে সাহায্য করে, এবং তার ফলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আরও বাড়ে। কিন্তু, অর্থব্যবস্থা কি চাঙ্গা হয়? ভারতকে যুদ্ধে টেনে এনে কি পাকিস্তান নিজেদের জাতীয় আয় বাড়াতে চায়?
গত দু’শো বছরের মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রায় চারশো যুদ্ধের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দেশের গণ্ডির মধ্যে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের কারণে মাথাপিছু জাতীয় আয় কমে যায় অন্তত ৭ শতাংশ। নিজেদের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে যুদ্ধ হলে, এবং সেই দেশ বিজয়ী হলেও কিন্তু মাথাপিছু জাতীয় আয় ৫ শতাংশের কাছাকাছি হ্রাস পায়। যদি কোনও দেশে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে, সে দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় কমে যায় লক্ষণীয় রকম। স্বাভাবিক অবস্থায় মাথাপিছু জাতীয় আয় যা হতে পারত, গৃহযুদ্ধ হলে তার অন্তত ১০% কম হয়।
কিন্তু, কোনও দেশ যদি অন্য দেশে গিয়ে যুদ্ধ করে, তা হলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, সে দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়েছে ৫-৮%! যে দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যুদ্ধ চলাকালীন তাদের মাথাপিছু আয় কিছুটা কমে যায় বটে, কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে তা শুধু পুরনো অবস্থায় ফিরে আসে তা-ই নয়, টপকে যায় সেই স্তরকে। আর যারা যুদ্ধ শুরু করেনি কিন্তু যুদ্ধে নামতে বাধ্য হয়েছে, তাদের আয় স্বাভাবিকের থেকে অনেক নীচে চলে যায় অস্ত্রশস্ত্রের খরচ জোগাতে।
এই তথ্যগুলো কিন্তু এমন সব যুদ্ধের হিসাব থেকে সংগৃহীত, যেখানে আগ্রাসনের কারণে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ছোটখাটো অন্তর্দেশীয় সংঘর্ষ, সীমান্ত সংঘর্ষ, এমনকি যে ক্ষেত্রে শুধু সামরিক পরিকাঠামোতে আঘাত হানা হয়েছে তেমন সংঘর্ষও বাদ দেওয়া রয়েছে। ভারতের দিক থেকে দেখলে, এই সীমিত যুদ্ধে কোনও পাকিস্তানি নাগরিককে লক্ষ্য করে আঘাত হানা হয়নি, ফলে এই তথ্যভান্ডারে এটা যুদ্ধ বলে গণ্য নাও হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান সরাসরি ভারতের ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চল আক্রমণ করেছে। সে আক্রমণ সম্পূর্ণ প্রতিহত হলেও তাতে উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
প্রশ্ন হল, যুদ্ধ কাকে বলে? এক বছরের মধ্যে অন্তত এক হাজার প্রাণহানি হলে তবেই প্রথাগত পরিমাপ অনুসারে তাকে যুদ্ধ বলা হয়। অবশ্য, সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটির উপসালা কনফ্লিক্ট ডেটা প্রোগ্রাম (ইউসিডিপি)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, এক বছরের মধ্যে যদি অন্তত ২৫টি মৃত্যু ঘটে থাকে, তা হলেই তাকে যুদ্ধ বলা যাবে। ফলে ভারত পাকিস্তানের সীমিত যুদ্ধও দ্বিতীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘যুদ্ধ’ বলে পরিগণিত হবে। এই পরিমাপ অনুসারে ভূমিকম্পের মতো যুদ্ধেরও মাত্রা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সেই মাত্রা এক থেকে পাঁচ-এর মধ্যে থাকলে তা ছোটখাটো সশস্ত্র সংঘর্ষ বলে পরিচিত হবে, যেমন ডোকলামের সংঘর্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাঁচের থেকে বেশি— সাত মাত্রার যুদ্ধ— যা হয়েছে, তা মূলত ভিয়েতনাম যুদ্ধ, পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধ ইত্যাদি। গত পাঁচ বছরে অবশ্য সশস্ত্র সংঘর্ষ দ্বিগুণ হয়েছে সংখ্যায়। পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় ৪৫টি, আফ্রিকায় ৩৫টির বেশি, এশিয়াতে ২১টি এবং ইউরোপে ৭টি সংঘর্ষ ঘটেছে বিভিন্ন কারণে, এবং এর অনেকগুলোই অাজও সম্পূর্ণ থামেনি।
যুদ্ধের ফলে আক্রমণকারী দেশের জাতীয় আয় বাড়ে বটে, কিন্তু লাভের হিসাব কষার সময় অন্যান্য ক্ষতির কথাও মাথায় রাখতে হবে। জাতীয় আয় পরিমাপের সময়ে অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন হিসাবের অন্তর্গত হয়, কিন্তু প্রাণহানি এবং সম্পত্তি ধ্বংসের পরিমাণ হয় না। সুতরাং, এমন হতেই পারে যে প্রাণহানি অনেক হল, কিন্তু যুদ্ধকালীন উৎপাদনের সাহায্যে মোট জাতীয় আয়ও বেড়ে গেল— তখন কিন্তু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই দেখাবে যুদ্ধরত দেশের ক্ষেত্রে। ফলে, জাতীয় আয় পরিমাপের খাতায় সচরাচর যে সব হিসাব থাকে না, সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত না করলে যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব কম-বেশি, এমনকি বিকৃতও দেখাতে পারে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসিমোগ্লু অবশ্য আগেই দেখিয়েছেন যে, যুদ্ধের দরুন আর্থিক বৃদ্ধির উপর প্রভাব তেমন কিছু পড়ে না। তবুও, অনেক দেশ মনে করে যে, মানুষকে অনুৎপাদক কাজের থেকে স্থানান্তর করিয়ে যদি যুদ্ধের উৎপাদনে জুতে দেওয়া যায়, তা হলেই জাতীয় আয় বাড়বে। যুদ্ধের সময়ে লোহা, তেল, খনিজ পদার্থ, আর শস্যের দাম বাড়ার প্রবণতা থাকে বাড়তি চাহিদার জন্যে; অনেক ক্ষেত্রে গোলাবারুদের মধ্যে দিয়ে ঘটা ধ্বংসের দরুন জোগান কমে যায় বলেও তা হতে পারে। আধুনিক যুদ্ধে এর প্রতিফলন বেশি করে পড়ে শেয়ার বাজারে; অনেকের পুঁজির ক্ষতি হয় লক্ষণীয় রকম। তবে কালোবাজারি করে সাময়িক লাভ হওয়াও বিচিত্র নয়।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও যে গোষ্ঠী সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা কাশ্মীর ছাড়া আর কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়, তা বোঝা জরুরি। যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সব সময়েই নেন ধনী ক্ষমতাবান মানুষরা, আর মরেন সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কাশ্মীর বাদ দিয়ে আর্থিক উন্নতির অন্য দিশা দেখা না গেলে এই যুদ্ধের অবসান নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)