E-Paper

তরুণের স্বপ্ন ও বিপ্লব

কলম্বো, ঢাকা, কাঠমান্ডু, জাকার্তা— একের পর এক শহর বা মহানগরী আজ তরুণের স্বপ্নে আন্দোলিত। সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কী ভাবে, কেউ জানে না।

রণবীর সমাদ্দার

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৬

সাম্প্রতিক ইতিহাসে গণবিক্ষোভ ও গণবিদ্রোহের বারংবার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাতে যুবসমাজের অংশগ্রহণ সবাই লক্ষ করেছেন। এ নিয়ে লেখালিখি হয়েছে অনেক। কিন্তু নাগরিক বিক্ষোভ, চাঞ্চল্য ও সমাবেশের মর্ম রূপে আমরা ক’জন তরুণের স্বপ্নকে দেখি? ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০-৭১ পর্যন্ত অভ্যুত্থানকে তরুণের স্বপ্ন রূপে ক’জন দেখেছেন, বা দেখতে সম্মত হবেন? এতে প্রথাগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আঘাত লাগে। এ ভাবে ভাবা বিসদৃশ মনে হয়।

অথচ, গত দ’দশক জুড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে তরুণ সমাজের অভ্যুত্থান ঘটেছে। ওয়াল স্ট্রিটে অবস্থান, কায়রোয় তাহ‌্‌রির স্কোয়্যার দখল, ইস্তানবুলের গেজ়ি পার্ক দখল, গত বছর কলকাতায় তরুণ-তরুণীদের রাস্তায় নামা নারীনিরাপত্তার দাবিতে— এই সবই তরুণের স্বপ্নের এক-এক দিক। এক সুস্থ, সহৃদয়, ন্যায়বোধে চালিত সমাজব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থার স্বপ্ন, এক দুর্মর আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষায় মতাদর্শের গভীরতা নেই, কিন্তু আবেগের প্রাবল্য আছে। আর আছে আকাঙ্ক্ষার প্রসারতা। সমাজের খুব কম অংশ থাকবে, যাকে তরুণের স্বপ্নের প্রাবল্য ছুঁয়ে যাবে না।

কলম্বো, ঢাকা, কাঠমান্ডু, জাকার্তা— একের পর এক শহর বা মহানগরী আজ তরুণের স্বপ্নে আন্দোলিত। সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কী ভাবে, কেউ জানে না। কে লক্ষ্য এই আন্দোলনের, সেটাও সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। তবে বৈষম্য ও নিপীড়ন ব্যবস্থার আশু প্রতীক যে সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি, তাদের অপসারণের অভিপ্রায় দুর্মর। তরুণ সমাজের এই কামনার তাৎক্ষণিক চরিত্র খেয়াল না করে উপায় নেই। নতুন শাসনব্যবস্থার চরিত্র কী হবে, কারা হবেন নতুন শাসক, কী হবে তার আদর্শ ও ঘোষিত লক্ষ্য এবং কর্মসূচি— এই সব চিন্তার স্থান তরুণের স্বপ্নে নেই। উন্মাদনা স্বপ্নকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। খাদের ধারে দাঁড়িয়েও এই চৈতন্য নেই। অতঃ কিম? স্বপ্নের ইতি কি এইখানেই? এর পরে শূন্যতা পূরণে কে আসছে, কারা কী চাইছে, ষড়যন্ত্রী কুটিল শক্তি কোথায় ওত পেতে আছে, এই দুর্ভাবনা নেই। রাস্তায় তো নামা গেল, কিন্তু রাস্তাই কি বাকি পথ দেখাবে?

সমগ্র দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে সংসদীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাস যুবসমাজের মধ্যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সব রাজনৈতিক দল দুর্নীতিগ্রস্ত। জনপ্রতিনিধিরা জনগণকে ব্যবহার করে স্বীয় উন্নতি বা স্বার্থে। বিচারবিভাগ প্রশাসনের কুকর্ম ও নিপীড়নমূলক কার্যকলাপে বাধা দেয় না। সংসদ বা ব্যবস্থাপক সভা কার্যকর বিভাগের কাজকর্মকে সিলমোহর দিতে ব্যস্ত থাকে। বড় বড় মাপের ও লোককে চমৎকৃত করার নানা উদ্যোগে কার্যকর বিভাগের যত নজর, সাধারণ মানুষের সমস্যা নিদানে তার দৃষ্টি কম— এই রকম নানা ধারণায় তরুণ প্রজন্ম আজ নৈরাশ্যের শিকার। প্রথাগত রাজনীতি থেকে কিছু পাওয়ার নেই, আজকের যুব অসন্তোষে সব কিছু ছাপিয়ে এই হল প্রধান কথা।

এই তরুণ ও যুব প্রজন্মের সামনে কর্মসংস্থান কোথায়? হয় মাঝপথে পড়াশোনা থামিয়ে কাজের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি দিতে হবে, সংসারের দায়িত্ব সামলাতে যে কোনও কাজে সম্মত হতে হবে। নয়তো রাজনৈতিক দলের কর্মী-বাহিনীতে যোগ দিয়ে কিছু আর্থিক সুরাহা যদি হয়। অনেকে চেষ্টা করে ছোটখাটো কিছু ব্যবসা চালাতে। তাতে সাফল্য কম, কিছু উপার্জনে একেবারে অনাহার থেকে হয়তো সংসার বাঁচে। কিন্তু এই স্বউদ্যোগের ভবিষ্যৎও ম্লান। পাড়ায় মাল সরবরাহ, টুকিটাকি কাজ করা— এই পরিবেশ নৈরাশ্যকে কমায় না, বরং বাড়ায়। সমাজ পরিবর্তনের আদর্শ ফিকে লাগে। এর পরও আরও এক পথ খোলা থাকে। অপরাধের আলোআঁধারির জগতের বাসিন্দা হয়ে যাওয়া।

সভ্য সমাজের কাছে এই আধা শ্রমজীবী যুবসম্প্রদায় হল অন্য এক জাতি। এদের থেকে দূরে সরে থাকলে জীবন নিরাপদ। নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রসারের অন্যতম পরিণাম হল অশান্ত, আশাহীন, দিগ্‌ভ্রান্ত, তরুণ ও যুবসমাজের জন্ম। যার জন্য সংসদীয় ব্যবস্থা, নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতি বিলাসিতা ও চাকচিক্যময় জগতে কোনও স্থান নেই। সমাজ থেকে নির্বাসিত এই সম্প্রদায়কে নিজস্ব উপস্থিতি ঘোষণা করতে হয় পথে নেমে। পথের রাজনীতি জানান দেয়, তরুণের স্বপ্ন বলেও কিছু ছিল, এখনও কিছু আছে।

অনুন্নত জগতে গড়পড়তা বয়স ২৫। শিক্ষা বাড়ছে, সমাজমাধ্যমের ব্যবহার বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। তার উপরে অতিমারি ও পরিবেশ বিপর্যয়জনিত নৈরাশ্য। শিক্ষাব্যবস্থারও বেসরকারিকরণ ঘটছে ও উচ্চশিক্ষা সঙ্কুচিত হচ্ছে। আজকের তরুণ সমাজ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া— এ রকম নানা দেশে নানা অধ্যাদেশের ফলে প্রায় এক স্থায়ী বেকারত্বের সম্মুখীন। এই শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় অত সহজে পরিযায়ী হতে পারবে না। দরিদ্রতর শ্রেণির তরুণ ও যুবকদের মতো তারা পরিযায়ী হতেও চায় না। কাঠমান্ডুর বিক্ষোভে তারা যেমন বলেছিল, আমরা কর্মসন্ধানে দেশ ত্যাগ করতে চাই না, আমাদের দেশেই আমাদের কাজ চাই। এটা নিশ্চিত করা সরকারের কর্তব্য।

এই তরুণ ও যুবকদের অনেকেই গ্রাম থেকে এসেছে। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছে। বাবা-মায়ের অবস্থা দেখেছে যে কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনে অথবা পরিযায়ী শ্রমিক হয়েও সংসারের অবস্থা ফেরেনি। শহর থেকে তাই তরুণদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পরিবেশের অবনতি, অতিমারিতে অর্থনীতির সঙ্কোচন— এ সবের মাঝে অর্থনৈতিক কর্মসংস্থানই বা কত বাড়বে?

তরুণদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠাকে ঠিক নিম্নবর্গের বিদ্রোহ বলা যাবে না। আবার চিরাচরিত বামপন্থী যুব ছাত্র অভ্যুত্থান রূপেও এই সব যুব ও তরুণ বিদ্রোহকে আখ্যায়িত করা যাবে না। মূলত মধ্য শ্রেণির থেকে আগত। কমবেশি শিক্ষিত, কর্মহীনতার শিকার এই সামাজিক স্তর আজ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে।

অনুন্নত অথবা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে তরুণদের এই পথে নামা একাধিক কারণ সম্বলিত। এই বিক্ষোভের আপাত দিগ্‌শূন্যতা তাকে অনেক ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অংশ করে তুলছে। আশু উন্নতি চাই, প্রত্যক্ষ জনাধিকার বা গণতন্ত্র চাই, দেশ চালাতে অংশগ্রহণের আশু অধিকার চাই। কিন্তু জানি না কোন পথে এই অধিকার অর্জিত হবে।

অন্য দিকে, স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলি ধিক্কৃত, নিন্দিত, পরিত্যক্ত। দুর্নীতির কলঙ্কে চিহ্নিত। কমিউনিস্ট থেকে মধ্যপন্থী কোনও রাজনৈতিক দলই এই নিন্দার ঝড় এড়াতে পারেনি। অবশ্য, সর্বত্র যুব অভ্যুত্থানের পরিণাম যে এক, তা নয়। শ্রীলঙ্কার চেহারা নেপাল বা বাংলাদেশ বা ইন্দোনেশিয়া থেকে আলাদা। কিন্তু প্রায় সর্বত্র দিগ্‌শূন্যতা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির দিকে দেশগুলিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমন কোনও বৈপ্লবিক রাজনৈতিক শক্তিও নেই, যে এই ছাত্র যুব তরুণ সমাজের অসন্তোষকে সমাজপরিবর্তনের পথে নিয়ে যাবে। এ এক নিখাদ জনবাদী পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়, সে সম্পর্কে চিরাচরিত বামপন্থীদের কোনও ধারণা নেই।

ভারতে এই ধরনের অভ্যুত্থানের কি কোনও সম্ভাবনা নেই? দিল্লির উপকণ্ঠে এক বৎসরব্যাপী কৃষক আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়ে ছিল পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের তরুণরা। একই ভাবে কোভিড অতিমারির সময় সংহতির পতাকা উড়িয়ে যারা ব্যাধিক্লিষ্ট জনসাধারণ এবং পরিযায়ী শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও প্রধানত তরুণ। সংহতি, সহমর্মিতা ও সামাজিক ন্যায়ের আদর্শে তরুণ সমাজকে সমাবিষ্ট না করতে পারলে, তরুণ সম্প্রদায়ের জাগরণ ব্যর্থ হয়ে থাকবে। বিভিন্ন কল্যাণকামী প্রকল্প, বেকারভাতা এবং কিছু অনিয়মিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে কত দিন তরুণের পথে নামাকে ঠেকানো যাবে?

ঔপনিবেশিক যুগে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের মধ্যে যিনি সর্বাপেক্ষা এ নিয়ে ভেবেছিলেন, তিনি সুভাষচন্দ্র। তরুণের স্বপ্ন নামক প্রবন্ধ সঙ্কলনে (১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) সুভাষচন্দ্র তরুণের স্বপ্নের অনন্যতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তরুণের স্বপ্নের আলোচনা করার সময় লক্ষ করেছিলেন ‘অবিশ্বাস ও নৈরাজ্যের পর্বতরাজি’ সামনে দাঁড়িয়ে। ‘অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা’ অনেক সময় বাধা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, তরুণসমাজ এই সব প্রতিবন্ধকতা মানবে না। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা চাই ভুল করার অধিকার’, ‘এখন আমাদের শাসন বা শোষণ করে কে?’ ‘এই নবজাগরণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কথা, সবচেয়ে বড় আশা— তরুণের আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ।’

তরুণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আমরা উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তির অপেক্ষায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Protest Politics demand

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy