E-Paper

ধৈর্যের আগুন জ্বালাত কবিতা

কবির সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে মারিয়ো প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে কিনল নেরুদার কবিতার বই এলিমেন্টাল ওডস, লোসাদা এডিশন। চিঠি দিতে গিয়ে কথা বলার সুযোগ পেল কবির সঙ্গে। কবির কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা শুনল।

রিমি মুৎসুদ্দি

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৩০

শব্দ পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক নেশা। কারণ, শব্দই একটা ছোট শহরের রেস্তরাঁয় কাজ করা সাধারণ মেয়েকেও নিজেকে দেবী ভাবতে শেখায়।— আন্তোনিয়ো স্কারমেতার বার্নিং পেশেন্স (স্প্যানিশ ভাষায়, আরদিয়েন্তে পাশিয়েন্‌শিয়া) উপন্যাসে এক অক্ষরজ্ঞানহীন মা মেয়েকে বলছেন এই কথা। মেয়েটির নাম বিয়াত্রিস গঞ্জালেস। এই বিয়াত্রিস নামটি শুনেই পরে চমকে উঠেছিলেন পাবলো নেরুদা। বিয়াত্রিস তো দান্তের নায়িকা!

কবিতার সঙ্গে এই সময়ে সাধারণ জনগণের আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি না, এই প্রশ্নে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের বোদ্ধারা, রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা সকলেই যখন নানা মতে বিভক্ত, তখন আন্তোনিয়ো স্কারমেতার আরদিয়েন্তে পাশিয়েন্‌শিয়া (জ্বলন্ত ধৈর্য) উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে। উপন্যাসটি স্কারমেতা উৎসর্গ করেছেন, পাবলো নেরুদার স্ত্রী “মাতিল্ডে উরুতিয়াকে, আর নেরুদারই মাধ্যমে, তার বশংবদ কুম্ভিলকদের।”

নেরুদার কুম্ভিলক শব্দটাও উপন্যাসের অন্যতম উপাদান। আইলা নেগ্রা-র সাধারণ একটি পোস্টম্যান মারিয়ো হিমেনেথ, নেরুদার কবিতার কুম্ভিলক। এই কুম্ভিলকই এমন এক প্রতিস্পর্ধী চরিত্র এই উপন্যাসে, যার মধ্যে দিয়ে কবিতা, প্রেম ও বিপ্লবের এক মিথস্ক্রিয়া ঘটে যায়।

আইলা নেগ্রা দ্বীপে সকলেই জেলে, কিন্তু মারিয়ো হিমেনেথ নামে সতেরোর তরুণটি ভালবাসে সকালবেলার রোদের আমেজ। মাছ ধরার কাজ চায় না সে। একমাত্র সম্বল একটি সাইকেল নিয়ে উপস্থিত হয় স্থানীয় ডাকঘরে। সাইকেলের কারণেই চাকরিটি পায়। দ্বীপের সকল বাসিন্দাই অক্ষরজ্ঞানহীন, কেবল এক জন ছাড়া, তাই মারিয়োর মনে হয় কাজের একদমই চাপ হবে না তার। যাঁরা পড়তে পারেন না তাঁদের কে চিঠি লিখবে, কেবল এক জনের জন্য আর কতই বা চিঠি আসবে?

সেই এক জন শিক্ষিত মানুষটি পাবলো নেরুদা। কার্যত দেখা গেল, এই এক জন মানুষের জন্য অজস্র চিঠি, পত্রিকা, জার্নাল প্রতি দিন আসে। মারিয়োকে অনেক চড়াই পেরিয়ে কবির বাড়িতে চিঠি পৌঁছতে আসতে হয়। আইলা নেগ্রার মৎস্যজীবী মানুষদের অক্ষরজ্ঞান নেই, তবু অক্ষরের সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেকের মৌখিক পরিচয়— পাবলো নেরুদার কবিতার মধ্য দিয়ে।

কবির সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে মারিয়ো প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে কিনল নেরুদার কবিতার বই এলিমেন্টাল ওডস, লোসাদা এডিশন। চিঠি দিতে গিয়ে কথা বলার সুযোগ পেল কবির সঙ্গে। কবির কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা শুনল। শুনে মারিয়ো বলেছিল, ‘উদ্ভট’। কবি প্রথমে শব্দটিকে নির্দয় সমালোচনা মনে করলেন। কিন্তু মারিয়ো যখন বলল, কবিতা শুনতে শুনতে তার একটি উদ্ভট অনুভূতি হচ্ছে, মনে হচ্ছে শব্দগুলো যেন এ-পাশ থেকে হুড়মুড়িয়ে ও-পাশে চলে যাচ্ছে— নেরুদা জিজ্ঞেস করলেন, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো? মারিয়ো ‘হ্যাঁ’ বলায় নেরুদা বললেন, ওটা কবিতার ছন্দ। মারিয়ো বলল, কবিতাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে সে এই শব্দগুলোর নৌকায় চড়ে কোথাও যাচ্ছে। কবি চমকে উঠলেন। বললেন, মারিয়ো নিজের অজানতেই জীবনে প্রথম একটি উপমা তৈরি করেছে। বললেন, “সব চিত্রকল্প, সব উপমাই ও রকম চট করে আসে, দুর্ঘটনার মতো করে।”

নেরুদার কবিতার মাধ্যমে মারিয়োর বিয়াত্রিসকে প্রেম নিবেদন, নেরুদার ঘটকালিতে বিয়াত্রিসের মায়ের এই বিয়েতে মত দেওয়া, নেরুদার বন্ধু সালভাদর আইয়েন্দে-র চিলির সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সব যেন একের পর এক ঘটতে থাকে। আইলা নেগ্রার মানুষ রাজনৈতিক ভাবে আইয়েন্দেকে সমর্থন করেন, নেরুদার কবিতার ভূমিকাও তাতে কম নয়।। রাজনৈতিক নেতার পাশে কবিও যেন তাঁদের নেতা।

নেরুদা ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হয়ে চলে গেলেও আইলা নেগ্রাকে ভুলতে পারেন না। কবির অনুরোধে একটি টেপ-রেকর্ডারে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ, পাখিদের কলতান, ভোরবেলায় জেলেদের মাছ ধরার কোলাহল সব রেকর্ড করে মারিয়ো ফ্রান্সে পাঠায়। পরবর্তী সময়ে চিলির গৃহযুদ্ধ, আইয়েন্দের নির্মম হত্যা বাধ্য করে কবিকে আবার আইলা নেগ্রায় ফিরে আসতে। কিন্তু এ বার অন্য রকম, কবি এখন জেনারেল পিনোশে-র হাতে গৃহবন্দি।

কবির মৃত্যু ও সৈন্যদের হাতে মারিয়োর ধরা পড়া এ উপন্যাসের পরিণতি যেন এক জরুরি বার্তা বহন করছে। কবিতাই হয়তো পেরেছিল মানুষের মধ্যে ভালবাসা সংক্রামক করতে। আজ যখন ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কারণে কবিতার আসর থেকে কবি বিতাড়িত, নির্বাসিত হন লেখক, তখন আরও বেশি করে মনে পড়ে এই জ্বলন্ত ধৈর্যের আখ্যান আন্তোনিয়ো স্কারমেতা লিখেছেন তাঁর নির্বাসনকালে। নিজের দেশে উপন্যাসটি প্রকাশ করতেও পারেননি। পরে উপন্যাসটি সিনেমায় রূপান্তরিত হয়েছে ইল পোস্তিনো নামে। উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক সাগুফতা শারমীন।

উপন্যাসের শেষে লেখক জানান, মারিয়ো হিমেনেথের কবিতার খবর কেউ জানে না। যে পত্রিকা সংস্থা কবিতা প্রকাশ করত, তা পুড়িয়ে দিয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের সেনাবাহিনী। আইলা নেগ্রায় নেরুদার বাড়িতে সেনা পাহারা ছিল বহু দিন। তবুও সমস্ত চিলির মানুষ অপেক্ষা করেছিল— এক দিন অবসান হবে স্বৈরাচারের। যে অপেক্ষার নাম লেখক দেন ‘জ্বলন্ত ধৈর্য’। আমাদের সময়েও সেই একই অপেক্ষা, জ্বলন্ত ধৈর্যের।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Poem Literature Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy