বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতির গতিছন্দ বিভিন্ন প্রকৃতির হলেও বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয় না। —ফাইল চিত্র।
ভারতের অর্থনীতিতে কী ঘটে চলেছে, তা কখনই বুঝে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, সব বিষয় নিয়েই পরস্পর বিরোধী মতামত আর বর্ণনা এই ভূমিতে খেলা করে। যেমন এক দিকে ভারতীয় বাণিজ্য ক্রমাগত ‘অলিগোপলিস্টিক’ (যে অবস্থায় প্রতিযোগিতা অল্প কয়েক জন বিক্রেতা বা উৎপাদকের মধ্যে সীমিত থাকে) চরিত্রের দিকে ঢলছে এবং অর্থনীতির বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রধান খেলোয়াড়রা পায়ের তলায় শক্ত জমি পেতে শুরু করেছে।
এর ফল হিসাবে অর্থনীতি এক ঘনবদ্ধ আকার প্রাপ্ত হচ্ছে। ইস্পাত অথবা সিমেন্ট, বিমান পরিবহণ বা মোটরগাড়ি নির্মাণ, টেলি-যোগাযোগ কিংবা ব্যাঙ্কিং, সুপরিকল্পিত খুচরো ব্যবসা বা গণমাধ্যম, বন্দর অথবা বমানবন্দর— সর্বত্রই সীমিত সাধ্যের খেলোয়াড়দের হয় কিনে নেওয়া হচ্ছে (খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে ফিচার বা মেট্রোর মতো সংস্থাকে, বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে জিভিকে-কে, বন্দরের ক্ষেত্রে কৃষ্ণপত্তনমকে), নয়তো তাদের ব্যবসা তলানিতে গিয়ে ঠেকছে (বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে কিংফিশার, জেট এয়ার এবং গো এয়ার), অথবা তারা চরিত্রগত ভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে (যেমনবেশ কিছু সরকারি ব্যাঙ্ক, টেলিকমের ক্ষেত্রে ভিআই) বা একেবারেই তারা বাজার ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে (ফোর্ড এবং জিএম এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ)।
এ সবের পাশাপাশি অন্য দিকে, পোর্টফোলিয়ো ম্যানেজমেন্ট সংস্থা মার্সেলাসের তরফে তথ্যবিশ্লেষণ থেকে জানা যাচ্ছে, ‘কর্পোরেট ভারত’-এর ৪৬ শতাংশের মতো বিস্ময়কর পরিমাণে আয়ের উৎসমাত্র ২০টি সংস্থা। আরও বিশদ ভাবে দেখলে বোঝা যায়, এই শীর্ষস্থানীয় ২০টি সংস্থা দশকের পর দশক কাটিয়ে দিয়েছে প্রায় কোনও পরিবর্তন ছাড়াই। যারা পড়ে থেকেছে, তারা মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠান। যদি কেউ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থাগুলির ব্যাপারে খতিয়ান নেন,তা হলে দেখতে পাবেন যে, তাদের মধ্যে ১৫টি সব থেকে বেশি লাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং গত দু’দশকের (২০০২-২০২২) মধ্যেই তারা প্রাধান্য লাভ করেছে।
শীর্ষস্থানে এই দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার বিষয়টি গত কয়েক দশকের কাহিনি না-ও হতে পারে। এটা নিশ্চিত যে, ১৯৯২-২০০২দশকটিতে‘কর্পোরেট ভারত’ বেশ কিছু উথালপাথালের সাক্ষী ছিল। কারণ, এই সময়েই বাণিজ্য পরিচালনার পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে বিপুল বদল আসে। এই বদলের পিছনে আবার সব থেকে বড় কারণটি ছিল অর্থনৈতিক সংস্কার। অর্থনীতির চূড়ায় এই নতুন স্থিতাবস্থা থেকে এ কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দেশের অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা বা পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত ভাবে কমে এসেছে। সেই কারণেই উপরোক্ত ওলটপালটের দশকটিতে শীর্ষে উঠে আসা প্রথম ২০টি সংস্থা একযোগে সুরক্ষিত অবস্থায় দাঁড়াতে সক্ষম হয়। যা থেকে এ কথাই মনে হয় যে, শেষ পর্যন্ত যে ২০টি সংস্থার নাম উঠে আসে, সেগুলি হিসাবের মধ্যে ছিলই। তুলনায় ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উঠে আসা সংস্থাগুলি, যাদের বেশির ভাগই ছিল বিদেশি মালিকানাধীন, তারা হিসাবের বাইরে থেকে যায়। এদের মধ্যে কোকাকোলা, স্যামসাং এবং বশ্-এর মতো অনেকেই এই মুহূর্তে বাজারে সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ‘অলিগোপলিস্টিক’ প্রাধান্যের বিপরীতে এরা সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ার বাজারে সব থেকে বেশি মুনাফার সন্ধান দিয়েছে। এই মুনাফা যে বিপুল অঙ্কের শেয়ারমূল্যের সংস্থা থেকে এসেছে, এমন নয়। বরং তা এসেছে মাঝারি এবং ক্ষুদ্র অঙ্কের সংস্থাগুলির মধ্যে থেকেই। যে সম্বৎটি শেষ হতে চলেছে এবং বিগত পাঁচটি সম্বতের দিকে তাকালে বিষয়টি সত্য বলেই মনে হয়। মার্সেলাসের দেওয়া পরিসংখ্যান প্রকৃতপক্ষেই দেখায় যে, শীর্ষস্থানীয় ২০টি সংস্থার শেয়ারহোল্ডাররা গত দশকটিতে তুলনামূলক ভাবে লাভের মুখ কমই দেখেছেন। সব মিলিয়ে বার্ষিক গড় হিসাবে দেখলে এটি স্পষ্ট হয় যে, ২০০২-১২ দশকে শেয়ারহোল্ডাররা যেখানে ২৬ শতাংশ মুনাফা লাভ করেছিলেন, তার ঠিক পরের দশকেই সেই অঙ্কটি ১৫ শতাংশে নেমে আসে। ‘অলিগোপলি’ থেকে জন্মানো সুরক্ষার কাহিনিটিকে এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে মেলানো যায় না।
বিষয়টিকে খুব সরল ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে এ কথা বলাই যায় যে, ২০১২-২২ দশকটিতে অর্থনীতির বৃদ্ধি ছিল তুলনামূলক ভাবে ধীর। সেই কারণেই শেয়ারহোল্ডারদের পকেট ভারী হয়নি। এবং এই ধীরগতির বৃদ্ধির কারণেই বাজারের অপেক্ষাকৃত ছোট খিলাড়িদের পক্ষে এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্থাগুলি ঠিক কী উপায়ে বড় খেলোয়াড়দের তুলনায় শেয়ারহোল্ডারদের বেশি মুনাফা দিতে পারল, সেটা একটু ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ক্ষেত্রগুলিতে এক রকমের স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি হয় করব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে (এক রাশ পরোক্ষ করের বদলে পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি চালু হওয়ার বিষয়টি মনে রাখা দরকার)। তাছাড়াও ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ লেনদেন, নগদের প্রবাহ-নির্ভর ঋণ নেওয়ার সুবিধা বৃদ্ধি ইত্যাদি পুঁজিকে সহজলভ্য করে তোলে। সুসংগঠিত খুচরো ব্যবসার বিকাশ তাদের কাছে বাজারে প্রবেশের বিষয়টি আরও সহজ করে দেয়। আঞ্চলিক সংস্থাগুলির কাছে উন্নততর পরিকাঠামোর বিষয়টিও বড় মাপের সুযোগকে সম্ভব করে তোলে।
এ সবের ফলে আবার অন্য একটি বিষয়ও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। বহু বৃহৎ সংস্থা বিপুল উৎসাহের সঙ্গে বিনিয়োগ করলেও তার ফল তেমন সুবিধার দাঁড়ায়নি। এ থেকে ‘টুইন ব্যালান্স শিট ক্রাইসিস’ (যে পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কগুলি প্রবল চাপের মধ্যে থাকে এবং বাণিজ্য সংস্থাগুলির ক্ষমতা এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকে যে, তারা তাদের ঋণ পরিশোধ করতেও ব্যর্থ হয়) জন্ম নেয় এবং বড় সংস্থাগুলিকে শেষ পর্যন্ত আহত করে। বেশ কিছু সংস্থা দেউলিয়া হয়ে পড়ে এবং তাদের চেয়ে বড় সংস্থা সস্তায় তাদের কিনে নেয়। এর ফলে আবার বাজারেসংহতি ফিরে আসে। এই পর্বে কর্পোরেট লভ্যাংশ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর সাপেক্ষে সার্বিক ভাবে ঢিমে তেতালায় চলতে শুরু করে। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার অবস্থায় রয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে বিক্রয়ঘটিত বৃদ্ধির অঙ্ককে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে।
জিডিপির অংশ হিসাবে লভ্যাংশের পরিসংখ্যান অবশ্য এখনও পর্যন্ত ২০০৮-এর স্তরে ফিরে যেতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতির গতিছন্দ বিভিন্ন প্রকৃতির হলেও বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ব্যাঙ্কে টাকা থাকা সত্ত্বেও এবং ঋণের মাত্রা কম থাকলেও বৃহৎ সংস্থাগুলি আগামী দশককে তাদের প্রাধান্য বিস্তারের কাজে ব্যবহার করবে। হয়তো বাজার যে পরিমাণে সেই প্রাধান্যকে চাইছে, তার খানিক বেশিই নিয়ে তারা হাজির হবে। যাই হোক, এ থেকে এমন কিছু প্রমাণিত হয় না যে, অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্থাগুলি বিপাকে পড়বে। বৃহত্তর কর্পোরেট ক্ষেত্রে প্রাণস্পন্দন কিন্তু এখনও অব্যাহত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy