Advertisement
E-Paper

কেন উত্তপ্ত হল শান্ত, শীতল লাদাখ? কী ভাবে জমা হল এই প্রবল ক্ষোভের বারুদ?

বিজেপির প্রতিশ্রুতিভঙ্গে বিক্ষুব্ধ লাদাখের বৌদ্ধরা মুসলিমদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন চার বছর আগেই। সম্প্রতি পুলিশের গুলিতে মৃত্যু, সোনম ওয়াংচুকের গ্রেফতার ও ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ তকমা হাওয়া দিচ্ছে ক্ষোভের আগুনে।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:৩৬
Why is calm and cold Ladakh turbulent

উত্তপ্ত লাদাখ। ছবি: পিটিআই।

হিমালয়ের কোলে শীতল মরু লাদাখ। এখানে বৃষ্টি পড়ে না। শীতে তুষারপাত। আপাতশান্ত এই ভূমে গত কয়েক দশক ধরেই চলেছে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ লেহ ও মুসলিম অধ্যুষিত কার্গিল জেলার শীতল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ২০১৯ সালেও কংগ্রেস নেতা আসগর আলি কারবালাই বলেছিলেন, চাপা এই দ্বন্দ্ব এতই তীব্র যে, বৌদ্ধদের দ্বারা মুসলিমদের সামাজিক বয়কট এখনও বিদ্যমান। তাঁরা মুসলিমদের কাছে জমিও বিক্রি করেন না।

কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের ক্ষোভ সেই লাদাখকে এমন উত্তপ্ত করে তুলেছে যে, দশকের দ্বন্দ্ব ভুলে লাদাখের সার্বিক মঙ্গলের দাবিতে এক হয়ে গিয়েছে লেহ এবং কার্গিল। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিকরণে লেহ-র সম্মতি আদায় করে পাল্টি খাওয়ার অভিযোগ ভারতের শাসকদলের বিরুদ্ধে। ‘ধোঁকা’ খাওয়ার দহন গত পাঁচ বছর ধরে বার বার মাঠে নামিয়েছে লাদাখের বাসিন্দাদের। ২০১৯ সালে ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রায় ১১,০০০ ভোটে লাদাখ লোকসভা কেন্দ্রে জেতা বিজেপি ২০২৪ সালে মাত্র ২৩.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে আসে। ক্ষোভের সেই ধিকিধিকি আগুনই জ্বলে উঠল সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ।

রামন ম্যাগসেসে পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ তথা পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে পাঁচ সপ্তাহব্যাপী শান্তিপূর্ণ অনশন প্রতিবাদের ১৪তম দিনে, অর্থাৎ ২৩ তারিখ, অসুস্থ হয়ে পড়েন দু’জন ষাট ও সত্তরোর্ধ্ব অনশনকারী। পরদিন হঠাৎ এক দল বিক্ষোভকারী লেহ শহরে বিজেপির লাদাখ কার্যালয়ে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় চার বিক্ষোভকারীর, আহত কয়েক ডজন। তারপর থেকেই চলছে কার্ফু, ধরপাকড়। বন্ধ মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা। এমনকি, মৃতদের শেষকৃত্যে কোনও জমায়েত হতে দেওয়া হয়নি, কোনও সংবাদমাধ্যমকে থাকতে দেওয়া হয়নি, তার কোনও ছবি তুলতে বা ভিডিয়ো রেকর্ড করতেও দেওয়া হয়নি। হঠাৎই লাদাখ যেন কাশ্মীর বা মণিপুর হয়ে উঠেছে।

Why is calm and cold Ladakh turbulent

পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার দাবিতে লাদাখে বিক্ষোভ। ছবি: পিটিআই।

হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার মূলত সোনমকেই দায়ী করেছে। তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে রাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া ছাড়াও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে তাঁর সংস্থার বিদেশি অনুদান গ্রহণের লাইসেন্স। তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানি চরের যোগ আছে, এমন অভিযোগও করেছে সরকার। সোনমের বিরুদ্ধে এই সব পদক্ষেপে বেড়েছে ক্ষোভের পারদ। প্রেস ক্লাব অফ লেহ-র প্রাক্তন সম্পাদক সেওয়াং গিরজিংয়ের কথায়, “হাস্যকর অভিযোগে সোনমের গ্রেফতারি কেউ মানতে পারছেন না। সোনমের গ্রেফতারি দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের দেশ কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।” বিজেপি অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ‘নিন্দনীয়’ মেনে নিয়েও তিনি জানাচ্ছেন, গুলি না-চালিয়েও উত্তেজিত যুবকদের নিয়ন্ত্রণ করা যেত। রিগজিনের প্রশ্ন, “স্বাধীনতার পর থেকে লাদাখিরা সর্বদা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান ও চিন— দুই প্রতিকূল প্রতিবেশীর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। এখন আমরা দেখলাম, পুলিশ নিজেদের মানুষের ওপর গুলি চালাল। তারপর প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যমের একাংশ মিলে প্রতিবাদীদেরই ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দিল! এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হবে না?”

গোড়ার কথা

১ মে, ২০১৯। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে লাদাখ আসনের জন্য নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল বিজেপি। প্রধান তিনটি প্রতিশ্রুতি ছিল, লাদাখের জন্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা, স্থানীয় ‘ভোটি’ ভাষাকে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে উপজাতি এলাকা হিসাবে লাদাখের অন্তর্ভুক্তি। প্রতিশ্রুতিতে বাজিমাত। ১০,০০০ ভোটে লাদাখ বিজয়।

তিন মাস পরে অগস্টের প্রথম সপ্তাহে, সংসদে বিল পাশ করে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য ক্ষমতা ও বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর নামে একটি এবং লাদাখ নামে আরেকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে দেওয়া হল। কাশ্মীর ক্ষুব্ধ, কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত লাদাখ। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় মুসলিমরা, মোট জনসংখ্যার ৪৬.৪ শতাংশ। তারপরে বৌদ্ধ (৩৯.৬ শতাংশ) এবং হিন্দু (১২.১ শতাংশ)।

Why is calm and cold Ladakh turbulent

জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশের গাড়ি। ছবি: পিটিআই।

কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের তকমা পেয়ে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ লেহ অঞ্চলে উৎসব হয়েছিল। তাঁরা অনেক দিন ধরেই কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছিলেন। অভিযোগ ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণের। তাঁরা শ্রীনগর নয়, লেহ থেকে শাসিত হতে চান। অন্য দিকে, কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ও রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কার্গিল অঞ্চলে হয়েছিল উত্তাল প্রতিবাদ। লেহ অঞ্চলের আনন্দ বাড়িয়ে জাতীয় তফসিলি উপজাতি কমিশন লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে পরের মাসেই। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই উধাও উৎসবের মেজাজ। প্রথম অশনিসঙ্কেত আসে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। লোকসভায় কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, লেহ এবং কার্গিল অঞ্চলে যে ‘অটোনমাস হিল কাউন্সিল’ আছে, তাদের দেওয়া ক্ষমতাগুলি ‘ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের সঙ্গে কমবেশি সঙ্গতিপূর্ণ।’ তখন থেকেই সন্দেহ শুরু হয়, তা হলে কি সরকার ষষ্ঠ তফসিলের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হঠছে? এ তো এক বিকল্প প্রস্তাব! এরপর ২০২০ সালের মার্চে তৃণমূল সাংসদ সাজদা আহমেদের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্র ঠিক একই কথা জানায়।

তত দিনে লেহ এবং কার্গিল জেলায় কর্মসংস্থান, জমি, সংস্কৃতি এবং পরিবেশ ইত্যাদি সুরক্ষার জন্য লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে কিছু শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয়ে গিয়েছে। স্থানীয়েরা বুঝেছেন, আমলাতান্ত্রিক এই শাসনে জনতার কণ্ঠস্বরের কোনও সুযোগ নেই। এরই মাঝে চাংথাং উপত্যকায় বিশাল সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫০,০০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তুতির খবর আসে। স্থানীয় সম্পদের উপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কা বাড়ে।

Why is calm and cold Ladakh turbulent

লাদাখে বিক্ষোভের ছবি। ছবি: পিটিআই।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং ৩৫এ-এর সুবাদে জম্মু ও কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারা কর্মসংস্থান, বৃত্তি এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা সম্পর্কিত বিশেষ সুবিধা তো পেতেনই, সঙ্গে শুধুমাত্র স্থায়ী বাসিন্দাদেরই ছিল রাজ্যে সম্পত্তির মালিকানার অধিকার। সুতরাং, স্থায়ী বাসিন্দা নন, এমন কেউ রাজ্যে জমি বা স্থাবর সম্পত্তি কিনতে বা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারতেন না। স্থায়ী নাগরিকের সংজ্ঞা, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইন তাদের বিধানসভার হাতেই ছিল। লেহ-র বাসিন্দারা ভেবেছিলেন, ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তি সেই নিয়ন্ত্রণগুলি আবার চালু করবে।

কিন্তু ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘লাদাখ অটোনমাস হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’ নির্বাচনের আগে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব বলেন, সংবিধানের ৩৭১ অনুচ্ছেদ, ষষ্ঠ তফসিল বা ‘ডোমিসাইল’ আইনের যে কোনও একটির অধীনে লাদাখের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হোক। আবার একটি বিকল্প প্রস্তাব! এটি ষষ্ঠ তফসিল অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হঠার স্পষ্ট ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সংগঠিত হন লেহ-র ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। দাবি আদায়ে গড়ে ওঠে ‘পিপল্‌‌’স মুভমেন্ট ফর সিক্সথ শিডিউল ফর লাদাখ’। সংগঠনের নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই বলেন, তাঁরা জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা হতে চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের ধারণা ছিল শ্রীনগর থেকে তাঁদের ‘রিমোট কন্ট্রোল’-এ চালনা করা হচ্ছে। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে তাঁদের মনে হচ্ছে, এখন তাঁদের দিল্লি থেকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা হচ্ছে। চাপে পড়ে নির্বাচনের পরেই এই নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু আবার পিছু হটে নির্বাচন মিটতেই।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে হাত মিলিয়ে নেন লেহ এবং কার্গিলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব। জোট বাঁধে ‘কার্গিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ (কেডিএ) এবং ‘লেহ অ্যাপেক্স বডি’ (এলএবি)। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁদের বলেন, লাদাখিদের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা ষষ্ঠ তফশিলে অন্তর্ভুক্তি ছাড়া অন্যান্য বিধানের অধীনেও নিশ্চিত করা যেতে পারে। কিন্তু লাদাখি নেতৃত্ব তা মানতে পারেননি। পিপল্‌‌স মুভমেন্ট ফর সিক্সথ শিডিউল ফর লাদাখ এবং কেডিএ যৌথ ভাবে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর লাদাখ ধর্মঘটের ডাক দেয়।

Why is calm and cold Ladakh turbulent

সোনম ওয়াংচুক। ছবি: পিটিআই।

সেই থেকে লাদাখের দুই প্রধান সম্প্রদায়, মুসলিম ও বৌদ্ধেরা পথে নেমেছেন কয়েক মাস অন্তর অন্তর। তাঁদের মূল দাবি চারটি। ১. রাজ্যের মর্যাদা ও বিধানসভার পুনরুদ্ধার, ২. ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে সাংবিধানিক সুরক্ষা, ৩. একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন-সহ নিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুরক্ষা এবং ৪. একটি অতিরিক্ত সংসদীয় আসন।

চাংথাঙের চারণভূমি

অগস্টের ২৪ তারিখ সোনম একটি চিঠি পান, যেখানে তাঁর সংস্থা, ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অল্টারনেটিভস লার্নিং’-এর জমির লিজ় বাতিল করে ভবন সরিয়ে ফেলার কথা বলা হয়। ক্ষুব্ধ সোনম সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টে বলেন, যখন থেকে তিনি লাদাখের বিশাল চারণভূমিগুলি স্থানীয়দের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলির হাতে দেওয়ার বিরুদ্ধে আর ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে লাদাখে সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও আদিবাসী অধিকারের সুরক্ষার দাবিতে কথা বলতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই তিনি এমন অনেক ‘উপহার’ পাচ্ছেন।

পূর্ব লাদাখের চাংথাং মালভূমি চাংপা উপজাতির আবাসস্থল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৪,০০০ মিটার থেকে ৭,০০০ মিটার পর্যন্ত। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ বসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। চাংথাং অঞ্চলের অনন্য সাংস্কৃতিক ও জৈবিক বৈচিত্র সংরক্ষণের লক্ষ্যে এটিকে ‘চাংথাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’ নামে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী চাংপারা ৩,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যাযাবর জীবন কাটাচ্ছেন। মূলত ছাগল ও ভেড়া পালন করেন। এ ছাড়া উপায়ও নেই। অত উচ্চতায় কৃষিকাজ প্রায় হয় না। যেটুকু এলাকায় সীমিত চাষাবাদ হয়, সেগুলি বিশ্বের সর্বোচ্চ কৃষিক্ষেত্রগুলির মধ্যে বিবেচিত। বিশেষ কিছু স্থানীয় প্রজাতির ভেড়া ও ছাগল ছাড়া কেউ শীতের তীব্র দিনগুলি টিকতেও পারে না। এঁরাই উৎপাদন করেন ‘কাশ্মের’, যা বিশ্বের সেরা ও মহার্ঘ পশমগুলির মধ্যে বিবেচিত। কাশ্মের থেকেই সৃষ্টি হয় বিখ্যাত পশমিনা পোশাক। কিন্তু তাঁদের জমির আনুষ্ঠানিক মালিকানা নেই। যে জমিতে তাঁরা মেষ চরান, সে সব জমির মালিক সরকার। চারণভূমি ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক অধিকারও নেই। তাঁদের বিষয়টি নিয়ে নজর কাড়তে সোনমের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের এপ্রিলে লেহ থেকে চাংথাং পর্যন্ত ১০ দিন ধরে পদযাত্রা হয়।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী চাংথাঙের জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বে সর্বনিম্ন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২.৫ জনেরও কম মানুষ সেখানে বাস করেন। এই অত্যল্প জনঘনত্বের জন্যই চাংপাদের যাযাবর জীবন সম্ভব হয়। আবার এই অত্যল্প জনঘনত্বের জন্যই লাদাখের এই সব জমির দিকে সরকারের নজর পড়ে। বৃহদাকার সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিপুল জমি প্রয়োজন। জনঘনত্ব বেশি হলে অধিগ্রহণকেন্দ্রিক নানা সংঘাতের সম্ভাবনা।

চাংথাং অঞ্চলের ফোব্রাং-এর বাসিন্দা লবজাং দাদুল পেশায় মেষপালক। তাঁর মতে, কোনও আইনি সুরক্ষা, স্বচ্ছতা এবং চাংপা পশুপালকদের সাথে অর্থপূর্ণ আলোচনা ছাড়াই এই প্রকল্প গড়ার চেষ্টা ন্যায়বিচার এবং আদিবাসী অধিকার উভয়কেই ক্ষুণ্ণ করে। তিনি বলেন, “স্থানীয়েরা উন্নয়নের বিরোধী নন। তাঁরা ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দাবি করছেন।” দাদুলের বক্তব্য, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে প্রথমেই নিখুঁত ভাবে পরিবেশগত প্রভাবের মূল্যায়ন করতে হবে। যে কোনও সিদ্ধান্ত হতে হবে স্থানীয়দের অংশগ্রহণমূলক। এ ছাড়া, চারণভূমিতে পশুপালকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য স্পষ্ট লিখিত চুক্তি, সৌরপ্রকল্পের সঙ্গে যেন পশুচারণও চলে, এমন প্রযুক্তির ব্যবহার, স্থানীয় চাকরিতে সংরক্ষণ ও রাজস্বে স্থানীয়দের ভাগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই সংসদে জানিয়েছে, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কোনও পরিবেশগত প্রভাবের মূল্যায়ন করার প্রয়োজন হয় না।

ক্ষোভের বিস্ফোরণ

আন্দোলনের মুখ হিসাবে সোনম উঠে এসেছেন ঠিকই। কিন্তু লাদাখে আন্দোলনের মূল শক্তি হল অ্যাপেক্স বডি, লেহ (এবিএল) এবং কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (কেডিএ)-এর মতো সংগঠনগুলি। সোনমের সৌজন্যে আন্দোলন আন্তর্জাতিক নজর টানতে পারলেও লাদাখের জনতার উপর লেহ-র নেতৃত্ব থুপস্তান ছেওয়াং, চেরিং দোর্জে প্রমুখ এবং কার্গিলের নেতা আসগর আলি কারবালাই ও সাজ্জাদ কার্গিলিরদের প্রভাব যথেষ্ট।

আনন্দবাজার ডট কম-কে চেরিং দোর্জে বলেন, “আপাতত পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত। তরুণরা ক্ষুব্ধ। সরকার খুব বেশি দমন করতে চাইলে ক্ষোভের বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। অতিরিক্ত বিধিনিষেধ ভাল নয়।” তাঁর সংযোজন, “আমরা জানি, ষষ্ঠ তফসিলের সুরক্ষা ছাড়া আমাদের কোনও নিস্তার নেই। সুতরাং পিছু হটার প্রশ্নই আসছে না।” ২৯ তারিখ লেহ-তে সাংবাদিক সম্মেলন করে থুপস্তানরা জানিয়ে দিয়েছেন, লাদাখের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না-হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা করবেন না। অক্টোবরের ৬ তারিখ একটি আলোচনার কথা সোনমদের অনশন চলার সময়েই, ২০ সেপ্টেম্বর, জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁদের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন কেডিএ-র নেতারাও। লাদাখের নেতৃত্ব যেহেতু বুঝিয়ে দিয়েছেন পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনার তদন্ত, জেল থেকে প্রতিবাদীদের মুক্তি ও তাঁদের নামে থাকা মামলা তুলে না-নিলে তাঁরা আর আলোচনায় বসবেন না, ৬ তারিখের আলোচনা তাই আপাতত বিশ বাঁও জলে।

Ladakh Unrest Ladakh Situation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy