E-Paper

বহু প্রাণের বিনিময়ে

ভারতে সশস্ত্র বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৪৬-এর পরে ষাট-সত্তরের দশকে আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধে পশ্চিমবঙ্গে এবং আরও দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আন্দোলনের ভরকেন্দ্র সরে যায় কিছুটা বিহারে এবং বড় আকারে অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে।

শুভজিৎ বাগচী

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৫ ০৪:১০
রক্তমূল্য: মাওবাদী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ, ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে, পলামু, ২৭ মে।

রক্তমূল্য: মাওবাদী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ, ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে, পলামু, ২৭ মে। ছবি: পিটিআই।

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মাওবাদী (সিপিআই-মাওবাদী) নেতৃত্বাধীন নিষিদ্ধ ও সশস্ত্র আন্দোলন বড় পালাবদলের মুখে। গত ২১ মে দলের সাধারণ সম্পাদক নম্বলা কেশবরাও মারা গিয়েছেন। দীর্ঘ পাঁচ দশক পরে দলের কোনও সাধারণ সম্পাদক নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মারা গেলেন। মাওবাদীরা নিজেরাই ঘটনাটিকে ‘বড় ব্যর্থতা’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই পরিস্থিতিতে, গত সাত দশকে সশস্ত্র বামপন্থী আন্দোলন কেন ভারতে টিকল না, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যেতে পারে।

ভারতে সশস্ত্র বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৪৬-এর পরে ষাট-সত্তরের দশকে আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধে পশ্চিমবঙ্গে এবং আরও দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আন্দোলনের ভরকেন্দ্র সরে যায় কিছুটা বিহারে এবং বড় আকারে অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে। তবে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটা মৌলিক তফাত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ছোট ছোট স্কোয়াড গঠন করে ‘শ্রেণিশত্রু’ নিশ্চিহ্ন করার উপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। অন্ধ্রপ্রদেশে জোর দেওয়া হয়েছিল গণসংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপরে। স্কোয়াডও ছিল।

গণসংগঠন কয়েকটি কাজ করেছিল। যেমন, তীব্র জাতপাতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং সামাজিক লড়াই, ছোট এবং ভূমিহীন কৃষকের জমির অধিকার স্থাপনের লক্ষ্যে আন্দোলন প্রভৃতি। জমি বিতরণে তাঁরা বেশ সফল হন। এর ফলে গরিব, ভূমিহীন ও প্রধানত দলিত পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে শুরু করেন, তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ওই দুই রাজ্যে এমন অনেক অধ্যাপক, আমলা বা ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা জানেন যে তাঁদের উন্নতিতে ‘আন্নালু’দের (বড় দাদা বা নকশাল) ভূমিকা ছিল। এই কারণেই ছত্তীসগঢ়ের ‘জনযুদ্ধ’-এ শহিদের দেহ তেলঙ্গানার গ্রামে এলে হাজারে হাজারে মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন। লক্ষণীয়, সব রাজনৈতিক দলের নেতারাও যান, মালা দেন।

আশির দশকের মাঝামাঝি নকশালরা বোঝেন, তাঁদের সময় ফুরোচ্ছে। রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার অনুধাবন করেছে যে ‘আন্নালু’রা মূলস্রোতের রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন, তেলুগু ছবিতে নিয়মিতই নকশাল নায়ক দেখা যাচ্ছে। পুলিশি অভিযান শুরু হয়। ইতিমধ্যে নকশালপন্থীরা পাশের রাজ্য মধ্যপ্রদেশের বস্তার ডিভিশনে (বর্তমানে ছত্তীসগঢ়ে) ঘাঁটি তৈরির কাজ শুরু করেছেন। ২০০৪ সালে দু’টি প্রধান নকশালপন্থী দল একত্রিত হয়ে গঠন করে সিপিআই-মাওবাদী। ওই সময়েই তারা স্কোয়াড, প্লাটুন, কোম্পানি থেকে গেরিলা ব্যাটালিয়ান গঠন করে ফেলে। অন্ধ্রে বিশ বছরে চার-পাঁচ জনের স্কোয়াডই তারা গঠন করতে পেরেছিল।

ওই সময়ের কথা বলেছিলেন চাম্বালা রবিন্দার। ২০১০ সালে তাঁদের সামরিক ঘাঁটি দেখাতে বস্তারের অবুঝমাড় অঞ্চলে আমায় মাসখানেকের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন মাওবাদীরা। তাঁদের দু’টি সামরিক কমান্ডের উত্তর কমান্ডের প্রধান ছিলেন রবিন্দার। সামরিক শিবির ঘুরতে ঘুরতে তিনি বলছিলেন, “তেলঙ্গানায় অনেক ভাল কাজ করেছিলাম। কিন্তু টিকতে পারিনি। কারণ গেরিলা বাহিনী গঠনের উদ্যোগ করা হয়নি। বস্তারে তিন দশক টিকে আছি, কারণ এখানে প্রথমেই সেনাবাহিনী নির্মাণের উপরে জোর দিয়েছিলাম।” মাওবাদীদের মতে, দল ও বাহিনীর সবচেয়ে বড় সাফল্য, বহুজাতিক সংস্থাকে রুখে ছত্তীসগঢ়ের বিশাল খনিজসম্পদ জনজাতি গোষ্ঠীর হাতে রাখতে পারা। চার দশক টিকে থাকার এটাও একটা কারণ।

গত সপ্তাহে ফোন করেছিলাম রবিন্দারকে। তিনি এখন হায়দরাবাদে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন, স্থানীয় কলেজের নিরাপত্তা প্রধান, সঙ্গে স্ত্রী ও কিশোরী কন্যা। ২০১৪ সালে আত্মসমর্পণ করেন রবিন্দার। জানতে চাইলাম, তেলঙ্গানাতে সামাজিক ন্যায় ও ছত্তীসগঢ়ের সামরিক ঘাঁটি দুটোই রাষ্ট্রেরবিপরীতে টিকল না কেন? তেলুগু টানের হিন্দিতে রবিন্দার বলেন, “বিশ্লেষণে ভুল ছিল, সমাজের পরিবর্তন হয়েছে।”

এই ‘ভুল’-এর নানান ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তবে প্রধান ব্যাখ্যাটি নিয়ে হয়তো সংশয় নেই। তেলঙ্গানা এবং ছত্তীসগঢ় দুই জায়গাতেই কিছু ভাল কাজ করলেও, জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে মাওবাদীরা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারেননি। কেন? তাঁদের সাময়িক সাফল্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে না-পারার যুক্তিটি। ২০০৭-এ মাওবাদীদের ইউনিটি কংগ্রেসে ‘মুক্ত অঞ্চল’ গঠন করে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কথা বলা হয়েছিল। পার্টির এই লাইনের পরিবর্তন হয়নি।

এই তত্ত্বের প্রবক্তা মাও জেদং এবং তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু সেই বক্তব্য তো তিনি রেখেছিলেন আজ থেকে প্রায় নয় দশক আগে— চিন বিপ্লবের সময়! আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল তাত্ত্বিকদের অনেকে মনে করেন, এই নীতিতে বর্তমানের ভারতে এগোনো সম্ভব নয়।

রাষ্ট্র যেখানে অপেক্ষাকৃত ভাবে দুর্বল, সেখানে ‘মুক্ত অঞ্চল’ গঠন করে কিছু দিনের জন্য লড়াই চালানো সম্ভব, আন্দোলন প্রসারিত করা অসম্ভব। রাষ্ট্র ‘মুক্ত অঞ্চল’-এ প্রবেশ করলে লড়াই শেষ। তবুও মাওবাদীরা চার দশক টিকে ছিলেন কারণ ছত্তীসগঢ়ের বস্তার ডিভিশন প্রায় চল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার, কেরলের থেকে সামান্য বড়। এই আয়তন এবং অনুন্নয়নের কারণেই মাওবাদীরা এত দিন টিকতে পেরেছেন, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের লালগড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছেন কয়েক বছরে।

অন্যান্য তিনটি কারণও আলোচনা করা যেতে পারে। এক, সমাজের একটা চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনৈতিক ভাবে ভারতীয় সমাজ অনেকটাই দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে। সর্বত্রই বামপন্থা স্তিমিত। অতীতে মাওবাদী এবং জনজাতি গোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নাগরিক সমাজের যাঁরা কথা বলেছেন তাঁদের অনেকেই হয়কারাগারে, অথবা মামলা লড়ছেন। বাকিরা উদাসীন, হয়তো ভয়েই। ইজ়রায়েলি রাজনীতিবিদ জাভি সুকোতে সম্প্রতি বলেছেন, প্যালেস্টাইনিদের মৃত্যু সম্পর্কে চরম উদাসীনতা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। ১৫ মে ১০০ জনকে মারা হয়েছে, হয়তো কেউ জানেও না। মাওবাদী ও জনজাতি গোষ্ঠীর সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।

দুই, রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি দ্রুত বেড়েছে। মাওবাদ দমনকারী ২০০৯ সালের ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ থেকে ২০২৫-এ ‘অপারেশন কাগার’ পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্র মাওবাদ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছে। ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নকশালবাদ দমন বিভাগের যুগ্মসচিব এম এ গণপতি (পরে ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি গার্ডের ডিরেক্টর জেনারেল) একটি জাতীয় প্ল্যান বানিয়েছিলেন। সেটাই মাওবাদ দমনের নতুন কৌশলের ভিত্তি।

এই পরিকল্পনায় একটি বিষয়ের উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পার্টির ক্যাডারদের ভাল রকম অর্থ এবং চাকরির নিরাপত্তা দিয়ে পুলিশে আনা। এর ফলে ছত্তীসগঢ় পুলিশের সংখ্যা ও শক্তি বেড়েছে, কেন্দ্রের বাহিনীর উপরে নির্ভরতা কমেছে। গণপতিই বললেন সে কথা। অর্থাৎ, দুর্বল ছত্তীসগঢ় পুলিশ রাতারাতি পেশাদার যোদ্ধা পেয়ে গেল, প্রায় কোনও প্রশিক্ষণ না দিয়েই। গত ২১ মে যখন হামলা হয়, তখন আত্মসমর্পণকারী সদস্যদের বিরাট ভূমিকা ছিল, কারণ তাঁরা অঞ্চল চেনেন। মাওবাদীরাই বিজ্ঞপ্তিতে সে কথা জানিয়েছেন।

তিন, তেলঙ্গানার ধাঁচে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের উপরে বস্তারে জোর দেয় সরকার। প্রকল্প থেকে চুরিও কমায়। আন্দোলন ক্ষইতে শুরু করে।

প্রশ্ন উঠছে মাওবাদী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী, সাংবাদিক তেলঙ্গানার এন বেণুগোপাল বললেন, “যত দিন শোষণ থাকবে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও চলবে। গোপন সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে। কিন্তু সেই লড়াইয়ের সঙ্গে প্রকাশ্য রাজনীতির প্রয়োজন কতটা, নির্বাচনে আসা উচিত কি না— এ বিতর্কও চলবে। আন্দোলনই পথ খুঁজে নেবে।”

জনযুদ্ধের এই প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার প্রাণ গিয়েছে, এখনও যাচ্ছে, সব পক্ষেই। সেটা বন্ধ করাই আপাতত লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে ভারতের নাগরিক সমাজের একাংশ অস্ত্রবিরতি এবং শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন মাওবাদীরা। কেন্দ্র এখনও মুখ খোলেনি। এই আবেদন গৃহীত হলে অসংখ্য নির্দোষ প্রাণ বাঁচবে।

এটাই এই মুহূর্তে কাম্য।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Maoists CPI-Maoist Central Government indian politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy