E-Paper

জেলবন্দির আইনি সুরক্ষা

১৯ নভেম্বর, ২০০৯ ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের দিন শোভার ১৮ বছর বয়স হয়নি। অথচ, পুলিশ তাকে সাবালক দেখিয়ে মামলা সাজিয়ে সাধারণ আদালতে চালান করে।

রঞ্জিত শূর

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:০৫

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসাবে ১৫ বছর জেল খাটার পর বেকসুর খালাস পেলেন শোভা মুন্ডা। ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ির মেয়ে শোভা। ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ সালে গ্রেফতার হন, ঘাটশিলায় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ মামলায় যুক্ত করা হয় তাঁকে। ঘাটশিলা পুলিশের এফআইআর-এ কিন্তু তাঁর নাম ছিল না। শোভার স্বামী রাজেশ মুন্ডা ‘মাওবাদী’ অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পরে হঠাৎই ঘাটশিলার শ্বশুরবাড়ি থেকে শোভাকে গ্রেফতার করা হয়। চার বছর পরে ঘাটশিলা সেশন আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয়। জামিন দূর স্থান, এক দিনের জন্য প্যারোলও পাননি শোভা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর লাগাতার প্রচেষ্টায় ১ জুলাই, ২০২৫ ঝাড়খণ্ড হাই কোর্ট শোভাকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে। মেদিনীপুর জেল থেকে শোভা মুক্তি পেলেন ২৪ জুলাই।

শোভার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তরফে ঘটেছে আর একটি ভয়ঙ্কর অন্যায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দিল্লির একটি সংস্থা সারা দেশে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মহিলা বন্দিদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালাচ্ছিল। তারা দেখতে পায়, ১৯ নভেম্বর, ২০০৯ ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের দিন শোভার ১৮ বছর বয়স হয়নি। অথচ, পুলিশ তাকে সাবালক দেখিয়ে মামলা সাজিয়ে সাধারণ আদালতে চালান করে। বেলপাহাড়ির আদিবাসী পরিবার অন্যায়টি বুঝতেও পারেনি। আদালতে বা শোভার উকিলকেও জানাতে পারেনি। তৎকালীন জুভেনাইল জাস্টিস আইন অনুযায়ী শোভার বিচার হওয়ার কথা ছিল জুভেনাইল কোর্টে। নাবালক অপরাধী হিসেবে বিচারে দোষ প্রমাণিত হলেও শোভার সাজা হত সংশোধনের জন্য তিন বছর হোমে থাকা। পনেরো বছর জেলে পচতে হত না।

গত ১৫ বছর ধরে শোভার স্বামী রাজেশ মুন্ডাও জেলে আছেন। সংশোধনাগার আইন এবং জেল কোড অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী দু’জনই যদি জেলবন্দি থাকেন তবে তাঁদের এক জেলে রাখতে হবে এবং সপ্তাহে দু’দিন দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ করে দিতে হবে। কিন্তু বার বার জানানো সত্ত্বেও শোভা এবং রাজেশকে কখনও এক জেলে রাখা হয়নি। শোভা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কয়েক বার ভিডিয়ো-তে কথা বলতে দেওয়া হয়েছে শুধু।

কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা মডেল জেল বিধিনিয়ম বা ‘ম্যানুয়েল’ (পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এই ম্যানুয়েল সম্প্রতি গ্রহণ করেছে) জেলবন্দির ন্যায্য বিচার পাওয়ার ব্যাপারে জেল সুপারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। নতুন ফৌজদারি আইন ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ বা বিএনএসএস-এর ৪৭৯ ধারায় বিচারাধীন বন্দিদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, যাঁরা প্রথম বার কোনও অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা যে অভিযোগে বন্দি, তার সম্ভাব্য সাজার সর্বোচ্চ মেয়াদ সাত বছর বা কম হলে, এবং সাজার এক-তৃতীয়াংশ জেলে কাটিয়ে থাকলে, সেই বন্দিকে জামিন দিতে হবে। অন্য অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সাজার অর্ধেক সময় বন্দিজীবন কাটানো হয়ে গেলে তাঁকে জামিন দিতে হবে। এই জামিন পাওয়ার ব্যাপারে জেল সুপারদেরই উদ্যোগ করতে হবে। কিন্তু জেল সুপাররা কি এ বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত? নানা মামলায় বিভিন্ন জেলের সুপারদের কথাবার্তা বলে সমাজকর্মীদের মনে হয়েছে, এই দায়িত্বের কথা তাঁরা যেন প্রথম শুনলেন। জেল সুপাররা এখনও মনে করেন, কারা বিভাগ আর বিচার বিভাগের মাঝে চিনের প্রাচীরের মতো অবিভেদ্য বিভাজন রয়েছে। অথচ, আইন সে কথা বলছে না। বিশেষত মহিলা অপরাধীদের নমনীয়তার সঙ্গে দেখার কথা বলা রয়েছে আইনে। ইতিবাচক বৈষম্য (পজ়িটিভ ডিসক্রিমিনেশন) করার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু, এ রাজ্যের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এ বিষয়ে চর্চা হচ্ছে না। ফলে মহিলা-বন্দিরা আইনত প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মেদিনীপুর জেলে আর এক জন রাজনৈতিক বন্দি কল্পনা মাইতি প্যারোলহীন ১৫ বছর টানা জেল খাটছেন। ১৪ বছর জেল খেটে থাকলে বন্দির মামলা ‘রেমিশন বোর্ড’-এ যাওয়ার কথা। তা-ও হয়নি। এ দেশে জেলবন্দিদের অন্তত ৬৫ শতাংশ হতদরিদ্র, দলিত বা মুসলমান। আইনি অধিকার সম্পর্কে তাঁরা অবহিত নন। তার উপর বন্দি যদি মহিলা হন, তাঁর বিপন্নতা আরও বেড়ে যায়। রাষ্ট্রীয় হেফাজতের জেলজীবনে সারাক্ষণই ভয়ে কাঁটা হয়ে বাঁচতে হয়। বন্দি যতটুকু পায়, সবই যেন অতিরিক্ত, দয়ার দান। মডেল জেল ম্যানুয়েলে বলা আছে, মহিলা বন্দিদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রকে সদা সচেতন থাকতে হবে। হয় উল্টোটা। বহরমপুর জেলে অভিযোগ উঠেছে, পুরুষ নিরাপত্তা কর্মীদের জামাপ্যান্ট, অন্তর্বাস কাচতে বাধ্য করা হচ্ছে মহিলা-বন্দিদের।

স্টেট লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটির যাঁরা প্রধান কর্মকর্তা, তাঁরা অধিকাংশই অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে পূর্ণ সময়ের কর্মী রূপে নিযুক্ত। সেই সব দায়িত্ব সামলে বন্দির স্বার্থরক্ষায় যথেষ্ট মনোযোগ তাঁরা দিতে পারেন না। দিতে কতটা আগ্রহী, সে প্রশ্ন না-ই বা করা হল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়। ভাল ভাল সিদ্ধান্ত হয়, কাজ হয় না। এই জন্য দেখা যায়, আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ যতই বলুক যে, বিচারাধীন বন্দিদের জামিন দিয়ে জেলগুলিতে ‘ওভারক্রাউডিং’ অর্থাৎ অতিরিক্ত বন্দির ভিড় কমাতে হবে, কাজের বেলা তা হয় না। এই একটি সমস্যার সমাধান করতে পারলে জেলবন্দিদের জীবনধারণের মানে খানিকটা উন্নতি হতে পারে, মনে করেন জেল বিশেষজ্ঞরা। তা হচ্ছে কই?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

correctional home Prisoners

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy