আগে ছিল একখানা শিবরাত্রির সলতে পুত্রসন্তান আর কিলবিল করে বেড়ানো লক্ষ্মীমেয়ের দল। বাপ-ভাইয়ের পাতে সর, মাছ পড়তে দেখত। দেখত মা-ঠাকুমার ভাত নিম্নচাপের আকাশের মতো ভেজা, উচ্ছিষ্ট তরকারি। তখন লেখাপড়া করব বলাটাই ছিল লড়াই। আজকাল লক্ষ্মী নয়, দুর্গা ট্রেন্ডিং। বি এ, এম এ করলে তবে শিবঠাকুর আসবেন গাড়ি, বিদেশযাত্রার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কারণ, ফরসা, তন্বী, চাকুরিরতা পাত্রী চাই! কন্যাশ্রীতে টাকা ঢুকছে, মেয়ে পড়ছে, ঘর-গেরস্তালিও সামলাচ্ছে, ভাইয়ের পড়ার খরচ দিচ্ছে! ঠাকুমা বলেন, “আমাগো নাতনি দশভুজার ন্যায় সংসার সামলাইবো!” মেয়েরা এখন দশভুজা।
তবে যেন, দশটা হাত গছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে কি কমজোরি তাই? বুঝিয়ে দেওয়া— পুরুষের দু’হাতের সমান মেয়েদের দশটা হাত? অথবা, যাতে পিঠের কালশিটের প্রসঙ্গটা ঢেকে দেওয়া যায়?
অফিস ফেরত ক্লান্ত শরীরে খাবার বানানো, রাত একটায় ঘুমচোখে বাচ্চার ডায়াপার বদলানোটাও মেয়েদের পক্ষে মামুলি! বাসে মধ্যবয়স্ক পুরুষ স্পর্শ করছে। চেঁচালে, কনডাক্টরের নিদানে তোমায় নেমে যেতে হল। শুনলে, “গাড়ি নিলেই পারেন।” কেউ পিছু নিলে তুমি ফিরে তাকাও, মা শুনে ভীত হন, “সন্ধেতে পড়তে যেতে হবে না।”
যারা লোলুপ তাকায়, তারাই বলে, বাড়িতেই তো থাকো, রান্নাটুকুও পারো না! ক্যান্টিনে গসিপ, সর্বোচ্চ নম্বরের কারণ স্যরের সঙ্গে ‘সম্পর্ক’। কথা ঘোরে— স্লিভলেস পরবে না ফুলস্লিভ, সিগারেট খাবে না বিয়ারে চুমুক দেবে, বিয়ে করবে কি না? জানো দুর্গা, এরাই তোমার পায়ে মাথা নোয়ায়। তোমার অদ্ভুত আলো, ষষ্ঠী থেকে পরানো বাসি মালায় সাজানো নির্জীব মাটির শরীরের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা দেশ, মাটি আর তোমাকে মা বলেছি। তুমি সব পারবে। অসুরকে অস্ত্র বিঁধিয়ে অন্য হাতে আলুপোস্ত রাঁধবে, তৃতীয় হাতে অফিসের ইমেলও গোছাবে। ছেলের ড্রয়িংখাতায় ফুল আঁকবে। পেরেন্ট-টিচার মিটিংয়ে তুমিই যাও, শুনতে হয় আরও মনোযোগী হোন সন্তানের প্রতি।
বিসর্জনের পর অস্ত্রগুলো ডাঙায় ভেসে ওঠে। বস্তির ছেলেরা তা বিক্রি করে পাউরুটি খাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ওদের মায়ের কালশিটেগুলো ওরা চেনে, কিন্তু জলে ভাসানো দশভুজার সঙ্গে মিল পায় না। যদি দশটাই হাত, তবে অত্যাচার কেন সইতে হয়? নাকি দশটা হাতের জন্যই এত ভয়? তাই নিজেদের পছন্দের অস্ত্রে সাজায়। যেমন তোমায় সাজিয়েছিল শঙ্খ, চক্র, গদা, ত্রিশূলে। জানো, দেশে সবচেয়ে প্রচলিত অপরাধগুলির মধ্যে ধর্ষণ চতুর্থ। ২০২১-এর পরিসংখ্যানে সংখ্যাটা প্রায় ৩১৬৭৭। নথিহীনের সংখ্যাটা কেউ জানতেও চায় না। যে দেশে দাবি রাখতে হয় ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’, কন্যাশ্রী দিয়ে অচলায়ন ভাঙতে হয়, সেখানে কোথাও কি দশ হাত আমাদের রক্ষা করেছে?
ঠাকুমা বলতেন, “মা আইবো আমাগো কাছে। বাপে আইতে দিবো না, মাকে ধমকায়, বাজ পড়ে মা কান্দে, তাই বিষ্টি হয়।” জানলাম, বাবারা মায়েদের বকতে, মারতে পারে। আর মায়েরা কাঁদে। তিতলির ক্যারাটে ক্লাস শেষে মা নিতে যান। পথটা অন্ধকার। আজেবাজে লোকের আনাগোনা। ক্যারাটে শিক্ষা শরীরে শক্তি দিলেও মনের ভয়ের কাছে হারে। অস্ত্র থাকলেও তার নিয়ন্ত্রণ দশভুজাদের হাতে নেই। রিমা বাবার কাঁধে বিয়ের দেনার উপরে বরের বাইকের শখটা চাপাতে পারে না। স্বামীর অত্যাচারের বিষয়েও কিচ্ছু বলে না। রিমার দেহ মর্গে শনাক্ত করতে হয়। মা ওকে দশভুজা হতে বলেছিলেন, তাই দশমীতেই বিসর্জনে গেল। দেশে ১৮-৪৯ বছর বয়সি বিবাহিতাদের প্রায় ৩০%-ই এমন গার্হস্থ হিংসার শিকার। তার ৩% গর্ভবতী।
খবর বেরিয়েছে— ‘হাউসফুল ওটি’। সন্তানসম্ভবারা জন্মাষ্টমীতে কোলে গোপাল চাইছেন। শরীরের তোয়াক্কা না করেই দম্পতিরা সিজ়ার করাতে চাইছেন। লক্ষ্মী-সরস্বতী পুজোয় এমন হিড়িক নেই। লক্ষ্মী-সরস্বতীরা যে পরের বাড়ির সম্পদ। দশভুজা হলে, আমাদের রক্ষায় অচেনা বাড়ি অচেনা মানুষ কেন বেছে দেয়?
ছেলেদের খেলা খেলবে! শুনেও এগিয়ে যাওয়ার লড়াইটা ভিতরের শক্তি দিয়েই চালিয়েছেন মীরাবাই চানু, সিন্ধু, দীপারা। তবে আমাদের সিংহবাহিনী সাজিয়ে কপাল চিরে ত্রিনয়ন টেনে বার করে দশটা হাত কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া কেন?
তাই এ বার লড়াই হবে দশ হাত, ত্রিনয়ন ছাড়াই। কাজ-ফেরত ক্লান্ত শরীরে রাতের খাবারটা না রাঁধতে পারলে ‘বাড়ির বৌ’ বলে অনুতাপে ভোগাতে চাইলে লড়াই হবে। বাসে-ট্রেনে বদমায়েশি করলে গন্তব্যের আগে নামবই না। শক্তিটা আছে, দশ হাত ছাড়াই।
শিব আর শক্তির আরাধনা করি, তবু শক্তিকেই কেন সমাজের নিয়মানুযায়ী অস্ত্র বেছে নিতে হয়! যেখানে ধর্ষক রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে, আইনের মারপ্যাঁচে পথে-ঘাটে বুক ফুলিয়ে ঘোরে, সেখানেই দশভুজার আরাধনা শ্রেষ্ঠ উৎসব! রক্তমাংসের দশভুজারা রাজনীতির তরজায়, চায়ের দোকানে, ট্রেনের চর্চায় বারংবার নিগৃহীতা হন। যে মাটিতে মেয়েদের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে সেখানেই দশভুজা হয়ে ওঠার পাঠ পড়ানো হয়। যার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়— এই সব কোরো না, তুমি যে মেয়ে! দশমীতে নদীতে মাটির হাতগুলো গলতে থাকে, ত্রিনয়নে জমে শেওলা। আবার প্রস্তুতি শুরু জ্যান্ত দশভুজা বানানোর। দশ হাতের সুপারপাওয়ার তা হলে প্রয়োজনই হত না, যদি দেবী নয়— শুধু ‘মানুষ’ বলে মেয়েদের ভাবা হত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)