E-Paper

চাষি-বৌ নয়, মহিলা কৃষক

গত এক দশকে কৃষিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। বাড়তি আয়ের আশায় পুরুষরা গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমানোর ফলে কৃষি পরিচালনার দায়িত্ব ক্রমশ মহিলাদের উপর ন্যস্ত হচ্ছে।

দেবাশিস মিথিয়া

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৪

ভারত আজ ‘মহিলা নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন’-এর স্বপ্নকে সামনে রেখে এগোচ্ছে। এই স্বপ্নের কেন্দ্রে কৃষি, আর সেই কৃষিক্ষেত্রেই লুকিয়ে আছে নারীদের অন্যতম বড় বঞ্চনা— মজুরিহীন শ্রম। কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৪২ শতাংশ মহিলা হলেও তাঁদের শ্রম আজও আইন, অর্থনীতি ও সমাজ— সব ক্ষেত্রেই অদৃশ্য। বেশির ভাগ মহিলাই মজুরিহীন পারিবারিক শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অর্থনৈতিক বঞ্চনা শুধু নারীর প্রতি অবিচার নয়, এটি দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার পথে এক তীব্র বাধা।

গত এক দশকে কৃষিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। বাড়তি আয়ের আশায় পুরুষরা গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমানোর ফলে কৃষি পরিচালনার দায়িত্ব ক্রমশ মহিলাদের উপর ন্যস্ত হচ্ছে। গত এক দশকে কৃষিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ১৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিবিদরা একে ‘কৃষির নারীমুখীকরণ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে, সংখ্যার এই বৃদ্ধি নারীর ক্ষমতায়নের বদলে প্রায়শই অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (২০২৩-২৪) দেখায়, প্রতি তিন জন মহিলা কৃষিশ্রমিকের এক জন কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করেন। তাঁদের শ্রমকে উৎপাদনশীলতার অংশ হিসেবে নয়, বরং ‘পারিবারিক কর্তব্য’ হিসেবে দেখা হয়। এটি পিতৃতন্ত্রের গভীর প্রভাব। সমস্যার মূল জমির মালিকানা-ব্যবস্থায়। ভারতে ‘কৃষক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে জমির মালিক হওয়া জরুরি। অথচ দেশের মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ মহিলা জমির মালিক। এর ফলে কিসান ক্রেডিট কার্ড, কৃষি ঋণ, ফসল বিমা, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ— এ সব সুবিধা থেকে মেয়েরা বঞ্চিত। মরাঠাওয়াড়ায় স্বামী আত্মহত্যার পর বিধবা স্ত্রী যখন কৃষিকাজ চালিয়ে যান, তখনও সরকারি নথিতে মালিক হিসেবে স্বামীই থেকে যান; ফলে ঋণমুক্তি কিংবা ক্ষতিপূরণের অধিকারও মহিলা পান না। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক এবং আইনি অসমতার জটিল রূপ। মজুরিহীন শ্রমের সঙ্কট ফসল বিক্রির সময় আরও প্রকট। মহিলারা চাষের সমস্ত কাজ করলেও, সরকারি মান্ডি বা বেসরকারি ব্যবসায়ীরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য পুরুষের হাতেই তুলে দেন।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অদৃশ্য মহিলা কৃষিশ্রম ও গার্হস্থ পরিচর্যার কাজের বার্ষিক আর্থিক মূল্য ভারতের জিডিপির কমবেশি ৩ শতাংশ। এই শ্রমকে জাতীয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত না করার ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতার প্রকৃত চিত্র দেখা যায় না। একই সঙ্গে, খেতমজুর মহিলারা পুরুষের তুলনায় গড়ে ২০-৩০ শতাংশ কম উপার্জন করেন। যা শ্রম-বাজারে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের এক স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। বর্ণ, শ্রেণি এবং জনজাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে মহিলাদের উপর বঞ্চনার চাপ আরও বাড়ে। বিহার, উত্তরপ্রদেশ কিংবা ঝাড়খণ্ডে নিম্নবর্ণ ও জনজাতিভুক্ত মহিলাদের মধ্যে মজুরিহীন শ্রমের হার ৫০-৭০ শতাংশ। মজুরিহীন শ্রম এবং মজুরি বৈষম্যের সম্মিলিত চাপ সরাসরি দেশের মানব পুঁজির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মহিলাদের উপর মজুরিহীন কৃষি কাজ এবং গার্হস্থ কাজের ‘দ্বিগুণ বোঝা’ এসে পড়ে। এর ফলে, তাঁরা নিজেদের স্বাস্থ্য ও শিশুদের পরিচর্যা ও পুষ্টির জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। দুর্বল মানব পুঁজি দেশের ভবিষ্যতের কর্মশক্তি এবং উৎপাদনশীলতাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

তবে কিছু ইতিবাচক উদাহরণও রয়েছে। কর্নাটকের ‘ভূ-স্বামিনী’ আন্দোলন বা উত্তরপ্রদেশের ‘আরোহ অভিযান’ যৌথ মালিকানার মাধ্যমে মহিলাদের আইনি স্বীকৃতি বাড়িয়েছে। একশো দিনের কাজের প্রকল্প গ্রামীণ ক্ষেত্রে মজুরি-সমতা নিশ্চিত করে কৃষি মজুরির উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আফ্রিকার উগান্ডায় মহিলা নেতৃত্বাধীন কৃষক সংগঠনগুলি আয়ের উপর মহিলাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেছে, ভারতের জন্য যা শিক্ষণীয়। এই সঙ্কট মোকাবিলায় প্রয়োজন ত্রিমুখী সমাধান। প্রথমত, জমির মালিকানার সঙ্গে কৃষক পরিচয়কে আর বেঁধে রাখা যাবে না; কৃষিতে সক্রিয় প্রতিটি মহিলাকে কৃষক হিসাবে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ অঞ্চলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র ও পরিচর্যার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে মহিলারা উৎপাদনশীল শ্রমে বেশি সময় দিতে পারেন। তৃতীয়ত, কৃষি আয় ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের উপর মহিলাদের পূর্ণ আর্থিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, কৃষি–প্রক্রিয়াকরণ, বিপণন ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মতো উচ্চ মূল্যের কর্মক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নীতি–সহায়তা জরুরি।

বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি নীতি প্রণয়নের পরও বাস্তবায়নের স্তরে পঞ্চায়েত, কৃষি অফিস, বা ব্যাঙ্ক কর্মীদের মধ্যে লিঙ্গসংবেদনশীলতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে যে সুবিধাগুলি মহিলাদের কাছে পৌঁছনোর কথা, তা কাগজে-কলমেই আটকে থাকে। অনেক মহিলা তাঁর অধিকার সম্পর্কে অবগত নন। তার সুযোগে পরিবার বা সমাজের পুরুষ সদস্যরাই বিভিন্ন নীতি-প্রকল্পের সুবিধা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া, মহিলাদের শ্রমকে অর্থনৈতিক মূল্যায়নের একটি বিস্তৃত প্রচেষ্টা দরকার। দেশে শ্রমশক্তি সমীক্ষা বা কৃষি গণনায় ‘মজুরিহীন পারিবারিক শ্রম’ পরিমাপযোগ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করলে তবেই এর প্রকৃত পরিমাণ স্পষ্ট হবে। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন, খরা-বন্যা, ও বাজারের দামের ওঠা-নামা মেয়েদের উপর কী ভাবে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, সেটিও কৃষিনীতির মূলধারায় আনতে হবে। সঙ্কটের সময় সবচেয়ে বেশি কাজ পড়ে মহিলাদের উপরই— জল আনা, পশু চরানো, বীজ সংরক্ষণ, খাবার জোগানো।

কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মহিলাদের প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল বাজারের নাগাল, এবং সমবায় সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা করা গেলে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দ্রুত বাড়বে। নারীর শ্রম দৃশ্যমান হলে শুধু কৃষিই নয় গ্রামীণ অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, এবং দেশের মানব উন্নয়ন— সবই আরও স্থিতিশীল পথে এগোবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Farmers agriculture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy