Advertisement
E-Paper

দুই জনবাদীর লড়াই

জনবাদী রাজনীতির তাত্ত্বিক বেঞ্জামিন মোফিট যথাক্রমে তিনটি প্রদর্শনীমূলক উপাদানের কথা বলেছিলেন: ‘পিপল’ (জনতা/মানুষ), ‘ব্যাড ম্যানার্স’ (খারাপ ব্যবহার), ও ‘ক্রাইসিস’ (দুঃসময়)।

প্রমা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৫ ০৬:২০
Share
Save

দক্ষিণপন্থী জনবাদী রাজনীতির স্বর্ণযুগে দুই সুপরিচিত জনবাদী প্রেসিডেন্টের মাঝে সম্প্রতি দেখা গেল উগ্র তর্কাতর্কি। যা ঘটল, তাতে কূটনীতির দুনিয়ায় কার্যত বেনজির এক চিত্র পরিবেশিত হল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির বহুলচর্চিত বাগ্‌বিতণ্ডাকে নানা ভাবে দেখা যায়— তার মধ্যে একটি হতে পারে জনবাদের প্রদর্শনীমূলক (পারফর্মেটিভ) তত্ত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা।

জনবাদী রাজনীতির তাত্ত্বিক বেঞ্জামিন মোফিট যথাক্রমে তিনটি প্রদর্শনীমূলক উপাদানের কথা বলেছিলেন: ‘পিপল’ (জনতা/মানুষ), ‘ব্যাড ম্যানার্স’ (খারাপ ব্যবহার), ও ‘ক্রাইসিস’ (দুঃসময়)। বর্তমান জনবাদের প্রধান তিনটি চিহ্ন হিসেবে তিনি এই বিষয়গুলিকে উপস্থিত করেছেন। সাধারণত, দেশে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যদীর্ণ সন্ধিক্ষণে জনতার সামনে জনবাদী নেতা নিজেকে দুঃসময়ের ত্রাতা রূপে পরিবেশন করেন। তীব্র প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রকাশ্য ব্যবহারের দ্বারা, যার মধ্যে অনেক সময়ে সৃষ্টিছাড়া এবং কুরুচিপূর্ণ আচরণও থাকতে পারে— জনবাদী নেতা নিজেকে পেশ করেন তথাকথিত দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃবর্গের থেকে স্বতন্ত্র, ক্ষমতার মঞ্চে এক বহিরাগত, অথচ জনসাধারণের অত্যন্ত আপন এক যুগমানব/মানবী রূপে। বিশেষত দক্ষিণপন্থী জনবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে নেতার ভাবমূর্তিতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় এক দর্পশালী পৌরুষের ধারণা, যা অনেক সময়ে তাঁর সমর্থকদের কাছে সেই নেতাকে এক অনন্য ও অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব করে তোলে। এই নেতাকে দেখা হয় এক অনমনীয় ব্যক্তি হিসেবে, যিনি কখনও কোনও ভুল করতে পারেন না। এমন এক পরিস্থিতিতে— দুই জন জনবাদী নেতার মধ্যে সংঘাতপূর্ণ কূটনৈতিক আলোচনা যে যথেষ্ট বিতর্কের পরিসর তৈরি করতে পারে, তা বলা বাহুল্য।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম কার্যকালে চালানো একটি ক্ষেত্রসমীক্ষায় গবেষক জিয়োর্গস ভেনিজেলস ট্রাম্প সমর্থকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। অধিকাংশ সাক্ষাৎকারী সমর্থক জানিয়েছিলেন যে ট্রাম্পের বেপরোয়া জীবনযাত্রা, বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা, দ্ব্যর্থহীন বাক্য প্রয়োগের প্রবণতা, খামখেয়ালি শরীরী ভাষা ইত্যাদির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করেন তাঁরা। তাঁদের দেখা অন্যান্য পেশাগত রাজনীতিকদের থেকে ট্রাম্প এইখানেই অনেকাংশে আলাদা ছিলেন, এবং সেটাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর রাজনৈতিক আচারব্যবহারে শালীনতার ও প্রতিপক্ষের প্রতি সৌজন্যের স্বাভাবিক সীমা ঘন-ঘন লঙ্ঘিত হয়। সেই সীমা লঙ্ঘনই একই সঙ্গে তাঁকে তাঁর সমর্থকদের কাছের লোক করে তোলে। আবার তাঁদের ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিক পরিসরে অনুরূপ বল্গাহীন বা ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। নির্বাচনী জনসভায় ট্রাম্প হিলারি ক্লিন্টনের মতো রাজনৈতিক বিরোধীদের উদ্দেশে প্রায়শ ‘কদর্য’, ‘মিথ্যুক’ প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহার করে তাঁর সমর্থকদের থেকে তুমুল হর্ষধ্বনি কুড়িয়েছিলেন।

তিনি যখন দ্বিতীয় বার নির্বাচনে বিশাল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরলেন, তার পর থেকেই ধনকুবের ব্যবসায়ী ইলন মাস্কের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠতা এবং প্রশাসনে মাস্কের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ ট্রাম্পের জনবাদী নেতৃত্বকে আর এক অন্য মাত্রা প্রদান করল। মাস্কের অধীনে সদ্যগঠিত আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি বা সংক্ষেপে ‘ডোজ’ অন্যান্য সরকারি দফতরগুলিতে ব্যয়সঙ্কোচনের উদ্দেশ্যে বিপুল হারে কর্মী ছাঁটাই করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সব রকম প্রথা ভেঙে মাস্কের সঙ্গে ট্রাম্প ওভাল অফিসেই সাংবাদিক সম্মেলন করেন— যেখানে আমেরিকার রাজনৈতিক কাঠামোয় আমলাতন্ত্রের বাড়বাড়ন্তকে মাস্ক সোজাসুজি গণতন্ত্রের বিপদ বলে চিহ্নিত করেন। ওই প্রেস কনফারেন্স-এ মাস্কের আনুষ্ঠানিক পোশাক, শিশুসন্তান-সহ ঘরোয়া পরিবেশ তৈরি করে কথাবার্তা চালানো, তাঁর প্রতি ট্রাম্পের বশংবদ আচরণ সর্বসমক্ষে দেখানো, এই সবের মাধ্যমে ট্রাম্পের আগ্রাসী, সর্বশক্তিমান ও জনপ্রিয় নেতৃত্বের ভাবমূর্তি হয়তো কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। হয়তো সেই জন্যই জ়েলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স-এর ওই তীব্র বাদপ্রতিবাদ জরুরি ছিল— ট্রাম্পের ভাবমূর্তিটি পুনরুদ্ধারের একটি চেষ্টা ছিল। প্রসঙ্গত, মাস্কের অধীনে থাকা ‘ডোজ’ বিভাগটির নামটিও কিন্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় দক্ষিণপন্থী একটি ইন্টারনেট মিম চরিত্র থেকে ধার করা।

অন্য দিকে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কিকে ইতিমধ্যে অনেক গবেষকই মধ্যমপন্থী জনবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ট্রাম্পের মতোই কৌতুক অভিনয় ও রিয়ালিটি টেলিভিশনের সঙ্গে তাঁরও বেশ গভীর যোগ। তাঁর দীর্ঘ টেলিভিশন কর্মজীবনে জ়েলেনস্কি ইউক্রেনের সাবেক রাজনৈতিক দলগুলিকে ক্ষুদ্রস্বার্থান্বেষী, প্রাদেশিকমনস্কতায় পূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত ইত্যাদি বলে ব্যঙ্গ করে এসেছেন, এবং সেই জন্য যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছেন। নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কোকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রতীক বলে অভিহিত করেছিলেন, নিজেকে তুলে ধরেছিলেন নিপীড়িত জনতার প্রতিনিধি হিসেবে। ‘স্লুহা নারোদু’ (Sluha Narodu) বা ‘সারভেন্টস অব দ্য পিপল’ নামে তাঁর দল পরবর্তী কালে ইউক্রেনের রাজনীতিতে ঘোষিত ভাবে অরাজনৈতিক, দুর্নীতিবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডা নিয়ে নব উদারনৈতিক অবস্থান তৈরি করে ক্ষমতায় আসে।

রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লাগার পর তাঁর পরনে যোদ্ধার পোশাক, বাগ্মিতা ও আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা জ়েলেনস্কিকে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের প্রতীক করে তোলে। অবশ্য তার সঙ্গে সঙ্গেই ইউক্রেনের সমাজের একাংশের এমন অভিযোগও তৈরি হয় যে, দেশের দুঃসময়কে পুঁজি করে তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে পিছিয়ে দিচ্ছেন।

অনেক রকম প্রভেদ থাকলেও, ট্রাম্প ও জ়েলেনস্কি এই দুই জনবাদী নেতার সে দিনের রাজনৈতিক প্রদর্শনীটির উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত এক। নিজেকে সর্বগুণসম্পন্ন পুরুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করা, জনতাকে নিষ্ক্রিয় টেলিভিশন দর্শকে পরিণত করা। আবার একই সময়ে এও দেখা যায় যে এ-হেন জনবাদী নেতারা সক্রিয় ভাবে দর্শক জনতার সঙ্গে সরাসরি, আবেগী সংযোগ রেখে চলার চেষ্টা করছেন। সেই সংযোগকে তাঁরা তাঁদের গণতান্ত্রিক গ্রহণযোগ্যতা হিসেবে তুলে ধরছেন, যেন ওইখানেই দেখিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের নিজেদের যোগ্যতার পরিচয়। অথচ পাশাপাশি চলছে যাবতীয় অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ।

এই ভাবেই তাঁরা আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চকে তাঁদের নাটকীয় রাজনৈতিক প্রদর্শশালায় পরিণত করে ফেলছেন। অবশ্য ধারেভারে জ়েলেনস্কি আর ট্রাম্প মোটেই সমগোত্রীয় নন, তাই বৈঠকের শুরু থেকেই জ়েলেনস্কির পোশাক, কথা বলার ধরন ইত্যাদি নিয়ে কটূক্তি আর ঠাট্টা করতে দেখা যায় ট্রাম্প ও তাঁর দলবলকে। জ়েলেনস্কিও ট্রাম্পের কথার তীব্র প্রতিরোধ করেন।

লক্ষণীয়, সে দিনের বৈঠকে ট্রাম্পের ক্ষমতা প্রদর্শন এবং ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য বন্ধ করার কথা ঘোষণার পর দেখা যায়, কয়েক দিনের মধ্যেই জ়েলেনস্কি সমঝোতামূলক একটি বার্তা পাঠাচ্ছেন আমেরিকার উদ্দেশে। এই বার্তায় তিনি ট্রাম্প প্রস্তাবিত খনিজ চুক্তি সই করতে ও আমেরিকান নেতৃত্ব মেনে চলতে রাজি হয়েছেন।

তবে কিনা, সে দিনের বৈঠকের রেশ সহজে মিলাবে বলে মনে হয় না। তাঁদের ওই অভূতপূর্ব ও অসম বাদানুবাদ একটা বার্তা দিয়ে গেল। বলে গেল, এমনই প্রবল স্পর্শকাতর কূটনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের পরিসর আগামী দিনেও তৈরি হয়ে উঠবে। এবং তা তৈরি করতে এগিয়ে আসবেন ট্রাম্পের মতোই কোনও জনবাদী রাষ্ট্রনায়ক।

রাজনীতি বিভাগ, ক্রিয়া ইউনিভার্সিটি, অমরাবতী

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump Volodymyr Zelenskyy america Ukraine Russia Russia-Ukraine War

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}