Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

আজও ভাবায় পঞ্চাশ পেরনো গুপী-বাঘা

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই সিনেমার আবেদন আজও অমলিন। আপাত ভাবে ছোটদের জন্য হলেও, এর মাঝে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে নানা ভাবনা লুকিয়ে আছে। যা ভেবে দেখলে বিস্মিত হতে হয়। লিখছেন শ্যামলচন্দ্র দাসগল্পের সঙ্গে সাজসজ্জা, গীত রচনা, আবহসঙ্গীত-সহ চিত্রনাট্যে পরিচালক সত্যজিৎ রায় কিছুটা বদল এনেছিলেন। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুদি কানু কাইনের ছেলে গুপী কাইন ক্রমে ‘গাইন’ হয়ে যায়। কিন্তু সিনেমায় দেখা যায়, আসরে বসা গ্রামের কয়েক জন বৃদ্ধের মধ্যে জনৈক বৃদ্ধ গুপীকে ঠাট্টা করে পদবী ‘গায়েন’ বলতে বলে রাজাকে।

গুপী বাঘা।  ফাইল ছবি

গুপী বাঘা। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৯ ০১:৫৪
Share: Save:

জীবনের প্রথম অর্ধ যাঁরা পার করে এসেছেন তাঁদের অনেকেই সিনেমা হলে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (মুক্তি ৮ই মে, ১৯৬৯) সিনেমাটি দেখেছেন। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই সিনেমার আবেদন আজও অমলিন। আপাত ভাবে ছোটদের জন্য হলেও, এর মাঝে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে নানা ভাবনা লুকিয়ে আছে। যা ভেবে দেখলে বিস্মিত হতে হয়।

যেমন, ধরুন ‘শুন্ডী’ শব্দটি। যা সম্ভবত ‘হুন্ডি’ বা ‘হান্ডি’ শব্দজাত। ‘হুন্ডি’ শব্দটি নগদ অর্থ-প্রাচুর্যের পরিচয়বাহী। সমালোচকদের একাংশ মনে করেন, তাই ‘ধনসম্পদশালী’ রাজ্যটির নাম তাই শুন্ডী। এর বিপ্রতীপে হাল্লা। যার অর্থ ‘কোলাহল’ বা শোরগোল। হাল্লা রাজ্যের রাষ্ট্রনীতিতেও কলহ এবং বিবাদের বাড়াবাড়ি। সিনেমায় মন্ত্রী চালিত হাল্লা-রাজা বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এই অর্থগুলিকেই স্পষ্টতা দিয়েছে। গুপি গেয়েছেন, ‘...দেখে হাল্লা রাজার দাপাদাপি, উড়ে গেল প্রাণেরপাখি’। কোথাও যুদ্ধবাজদের প্রতি একটা তীক্ষ্ণ বিদ্রুপও কাজ করে।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫)-র গল্প ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ অবলম্বন করে এই সিনেমা। কিন্তু, গল্পের সঙ্গে সাজসজ্জা, গীত রচনা, আবহসঙ্গীত-সহ চিত্রনাট্যে পরিচালক সত্যজিৎ রায় কিছুটা বদল এনেছিলেন। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুদি কানু কাইনের ছেলে গুপী কাইন ক্রমে ‘গাইন’ হয়ে যায়। কিন্তু সিনেমায় দেখা যায়, আসরে বসা গ্রামের কয়েক জন বৃদ্ধের মধ্যে জনৈক বৃদ্ধ গুপীকে ঠাট্টা করে পদবী ‘গায়েন’ বলতে বলে রাজাকে। গল্পে শুন্ডী, হাল্লা-র উপরে আক্রমণ করছে। সিনেমায় ঠিক উল্টো। গল্পে কোথাও এই দুই রাজা যে ভাই তার ইঙ্গিত ছিল না। কিন্তু সিনেমায় রয়েছে। বস্তুত শিল্পের প্রকৃত সৌন্দর্য সম্ভবত শান্তি নিয়ে আসায়। বিশৃঙ্খলতা, যুদ্ধ, অশান্তিকে থামাতে সঙ্গীতের ভূমিকা রয়েছে। এক গায়ক ও এক বাদক দু’জনে মিলে পাশাপাশি থাকা দুই রাজার মধ্যে যাতে যুদ্ধ না বাঁধে সেই চেষ্টা করেছেন। অথচ একদা তানপুরাধারী গোপীনাথকে আমলকী গ্রামের রাজা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। বাঘাকেও হরতুকী গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর বিশ্রী বাজনার জন্য। কিছু কাল পরে অতিপ্রাকৃত, আধিভৌতিক সমঝদার মেলে তাঁদের গান-বাজনার। তাঁরা দু’জনে ‘হাজার ভূতের রাজার’ তিন দয়া বা বরের সৌজন্যে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক মঙ্গলের চেষ্টা করতে থাকেন। তিন দিন পর যে যুদ্ধের জন্য হাল্লা রাজার সেনারা রওনা দেবেন, তা থামানো জরুরি বলেও তাঁরা মনে করেন। হাল্লা-গোষ্ঠীর প্রতিজ্ঞা—‘শুন্ডীর দিও পিণ্ডি চটকে, ...নিস্তার নাহি কাহারও সটকে’। কিন্তু, সৈন্য, উট, হাতি, ঘোড়া –সহ সামরিক ক্ষমতায় অনেক পিছিয়ে সম্পদে সম্বৃদ্ধ শুন্ডী। কোথাও যেন দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারের ছবিটি ফুটে ওঠে।

যুদ্ধ তো কোনও সমাধান নয়। ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা, যুদ্ধ করে করবি কি তা বল? মিথ্যা অস্ত্রশস্ত্র ধরে, প্রাণটা কেন যায় বেঘোরে, ...পরস্পরে যুদ্ধে অমঙ্গল’-এর মতো গানে পরিচালক যেন সে কথাই বোঝাতে চান। বোঝাতে চান, যুদ্ধের অনিবার্য পরিণাম হিসেবে উঠে আসে মানবিক মূল্যবোধের অবনমন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়। গুপী ও বাঘা যেন ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’-এর বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চান। তাই, তাঁরা অপদৈবিক, অপভৌতিক আশীর্বাদে মণ্ডা, মিঠাই নিয়ে এসে হাল্লা রাজার সেনাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় আর হাল্লার রাজাকে অতিপ্রাকৃত শক্তির মাধ্যমে শুন্ডী নিয়ে চলে যান। ফলে যুদ্ধ যায় থেমে। দুই ভাই নিজেদের ফিরে পান। শুধু যুদ্ধাকাঙ্ক্ষাই নয়, ভ্রাতৃত্বের দুর্বলতাও হাল্লা রাজার ছিল। তাই প্রাথমিক ভাবে যুদ্ধে তিনি নারাজ ছিলেন। কাগজের পায়রা বানিয়ে শুন্ডীর রাজা-ভাইকে শান্তির বার্তাও দিতে চেয়েছেন। বস্তুত সেই যুদ্ধাকাঙ্ক্ষা ও ভ্রাতৃত্ববোধের যে সঙ্ঘাত তার প্রেক্ষিত কি আজও বদলেছে? বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু উল্টো কথাই বলে।

এই তাত্ত্বিক আলোচনা না ঢুকেও বলা যায়, এই সিলেমায় গল্প ও গান মিলেমিশে এক সর্বজনীন ভাষা তৈরি করেছে, যা শ্রোতাকে আকর্ষণ করে। তাঁকে প্রাণের আরাম জোগায়, মনের মুক্তি দেয়। প্রমাণ করে সাধারণের কাছে পৌঁছতে, ছোটদের কাছে পৌঁছতে গান কী ভাবে সবার অস্ত্র হয়ে ওঠে— ‘সুরেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা, প্রাণেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা/ এ ভাষা এমন কথা বলে বোঝেরে সকলে, উচা, নিচা, ছোট, বড় সমান’।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE