প্রশাসকের কর্তব্য সহজ নহে। আর্থিক সামর্থ্য এবং নাগরিকের চাহিদা, দুইয়ের সামঞ্জস্য রাখিবার কাজটি কঠিন। তাই সরকারি চিকিৎসায় রাজ্যবাসীকে অগ্রাধিকার দিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল করেন নাই। পর পর অনেকগুলি জনসভাতেই তিনি এই উদ্বেগ ব্যক্ত করিয়াছেন যে, এ রাজ্যে ব্যয়সাধ্য চিকিৎসাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হইতেছে, কিন্তু তাহার সুযোগ লইতে ভিন রাজ্যের রোগীদের ভিড় বাড়িতেছে। তাঁহার উদ্বেগ অসঙ্গত নহে। অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসাক্রম, হাসপাতাল-পরিষেবা দুর্মূল্য। বিনামূল্যে ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রার্থীর সংখ্যা প্রচুর, তাই প্রতীক্ষারত রোগীদের সারণি দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইতেছে। কেহ এক বৎসর, কেহ তাহারও অধিক সময় অপেক্ষা করিতেছেন অস্ত্রোপচারের জন্য। অর্থ, সময়, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, প্রয়োজনের তুলনায় কোনওটিই এ রাজ্যে যথেষ্ট নাই। রাজ্যে নূতন অনেকগুলি হাসপাতাল গড়িয়াও তাহাতে চিকিৎসক আনা যায় নাই। অতএব সুষ্ঠু বণ্টনের কোনও একটি পদ্ধতি বাহির করিতেই হইবে। মুখ্যমন্ত্রী তাহাই করিতেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের অধিকার সর্বাগ্রে সুরক্ষিত করিতে চাহেন। তাঁহার কথা হইতে এমনই ইঙ্গিত মিলিয়াছে যে, রাজ্যবাসী নিখরচায় চিকিৎসার যে সকল সুযোগ পাইবেন, তাহার সকলই অন্যান্য রাজ্যের রোগীরা পাইবেন না।
তর্ক উঠিতে পারে, চিকিৎসায় সকলেরই সমান অধিকার। বিশেষত অন্য রাজ্যের মানুষ তো একই দেশের নাগরিক, সর্বত্র রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে একই সুযোগ মিলিবে না কেন? প্রশ্নটি নীতির নহে, অর্থনীতির। নৈতিক দৃষ্টিতে সকলেরই উত্তম মানের চিকিৎসা পাইবার কথা, সমস্যা অর্থের বরাদ্দে। সকল রাজ্যের সরকার সরকারি চিকিৎসায় সমান বরাদ্দ করে নাই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বরাদ্দের সদ্ব্যবহার হয় নাই। রাজ্যবাসীর অর্থে ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যবস্থা করিলে তাহাতে রাজ্যবাসীর অধিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত। সে ক্ষেত্রে ‘সমান সুযোগ’-এর নীতি মানিলে বহু রাজ্যবাসীর স্থান হইবে প্রতিবেশীদের পশ্চাতে। রাজ্যের সরকার সেই ব্যবস্থা মানিতে পারে না। সরকারি ভর্তুকি না মিলিলে যে চি়কিৎসাগুলি স্বল্পবিত্তের অধরা থাকিয়া যায়, সেগুলির জন্য প্রতিটি রাজ্যের সরকারকে অর্থ বরাদ্দ করিতে হইবে। ‘তোমার আছে, আমি পাইব না কেন?’ বলিয়া প্রতিবেশী রাজ্যের নাগরিককে বঞ্চনার কথা এ ক্ষেত্রে তোলা চলে না।
তবে কোন চিকিৎসাগুলির ক্ষেত্রে রোগীর ঠিকানা বিবেচিত হইবে, তাহা সতর্কতার সহিত বিবেচনা করিতে হইবে। কিছু ক্ষেত্রে আপৎকালীন চিকিৎসাও ব্যয়বহুল হইয়া উঠিতে পারে, যথা দুর্ঘটনার ফলে মস্তিষ্কে চোট। আহতের প্রাণ বাঁচাইতে তখন তাঁহার ঠিকানার কথা ভাবিলে চলিবে না। ভিন রাজ্যের সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কথাও ভাবিতে হইবে, যাঁহারা পশ্চিমবঙ্গে বাসরত সন্তানের উপর নির্ভরশীল। ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে না মিলিলে তাঁহাদের অচিকিৎসিত থাকিবার সম্ভাবনা বেশি। অর্থাৎ মানবিকতার শর্তগুলি মানিতে হইবে। ভিন রাজ্যের রোগীদের ব্যয়সাধ্য চিকিৎসাগুলির আলাদা মূল্য কী পদ্ধতিতে ধার্য করা হইবে, তাহাও গভীর বিবেচনার বিষয়। কাজটি সহজ নহে, কিন্তু এড়াইলে আরও বড় অন্যায় হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy